স্বাধীনতার ৭৫
মুক্ত গদ্য — ৩
অমৃতের সন্ধানে ভারতের স্বাধীনতা
বিশ্বেশ্বর রায়
ভারতবর্ষ স্বাধীন হয়েছে পঁচাত্তর বছর হয়ে গেল। সময়কালটা নেহাত কম নয়। বর্তমানে চলছে সেই স্বাধীনতার 'অমৃতকাল', সরকারের নির্দেশনায়। এই অমৃতকালে আপামর জনসাধারণের জিহ্বাগ্র কতটুকু অমৃত বা গরলের স্বাদ পাচ্ছে আমি সেই প্রসঙ্গে যাচ্ছি না। আমি আমার শৈশব ও কৈশোরকালের কিছু স্মৃতিচারণ করবো। আমার জন্ম ঠিক স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে। বাবা ছিলেন স্বাধীন ভারতের পঞ্চায়েত ব্যবস্থার প্রাথমিক অবস্থার ইউনিয়ন বোর্ডের প্রথম নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট। (আমাদের এলাকার) তারও অনেক আগে আমার প্রপিতামহ ছিলেন মনোনীত প্রেসিডেন্ট। সেই বাল্যাবস্থায় প্রথম দেখেছিলাম গান্ধী-টুপি, গান্ধীজির ছবি, নেতাজির ছবি ঘরের দেওয়ালে শোভা পেতে। আর ছিল ত্রিবর্ণরঞ্জিত পতাকা। আরও দেখেছিলাম বাবাকে পাঠানো রাষ্ট্রপতির তাম্রপদক ও শংসাপত্র। তখন শুধুমাত্র ওটুকুকেই স্বাধীনতার স্মারক হিসেবে জানতাম। পরে যখন হাইস্কুলে উঠলাম তখন স্বাধীনতার বৃহত্তর এবং ভিন্নতর অর্থ উপলব্ধি করতে শুরু করলাম ধীরে ধীরে। তখন স্বাধীনতার বাল্যাবস্থা। ছোট-বড় সব নেতার মধ্যে ছিল দেশ গড়ার এক অদম্য সদিচ্ছা। তার উপর পূর্ব পাকিস্তান থেকে অগণিত শরণার্থীর নিরন্তর স্রোত। সবকিছু সামলেও দেশ গড়ার জন্য রাষ্ট্রনেতাদের আত্মত্যাগ মানুষকে অনুপ্রাণিত করতো। কিন্ত তারপর ধীরে ধীরে ঘূণপোকার মতো নেতা-মন্ত্রী থেকে শুরু ক'রে ছোট-বড় আমলাদের মধ্যে দৃশ্যমান হতে লাগল স্বার্থত্যাগের পরিবর্তে স্বার্থপরতার কদর্য লিপ্সা। যা উত্তরোত্তর দাবানলের মতো প্রায় সব দলের সব নেতা-নেত্রীর মধ্যে ছড়িয়ে পড়লো। আজ, বলতে দ্বিধা নেই, রাজনীতি একটা পেশা বা ক'রে খাওয়ার প্ল্যাটফর্ম ছাড়া কিছু নয়। এখন দেশ, মানুষ গৌণ। মুখ্য দল এবং আত্মোন্নতি। তাই স্বাধীনতা প্রাপ্তির পঁচাত্তর বছর অতিক্রান্ত হবার পরও দেশের এক তৃতীয়াংশ মানুষ দারিদ্র-সীমার নীচে। অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান--মানুষের প্রাথমিক চাহিদাগুলিই পূরণ হয়নি। এক শ্রেণীর মানুষের হাতে অর্থ, ক্ষমতা ইত্যাদির অফুরন্ত ভাণ্ডার। আর বিপরীত দিকে অশিক্ষা, অনাহার, অপুষ্টি, জীবন-জীবিকার অনিশ্চয়তা। এর মধ্যেই আমরা অমৃতের সন্ধান করে চলেছি। যে অমৃত উত্তোলনের সম শ্রমদাতা সুরাসুর সকলেই, কিন্তু অমৃতের ভাগিদার সবাই হয়নি। আজও সেই ট্র্যাডিশান চলেছে। যারা দেশের সম্পদ গড়ে তারা সেই সম্পদের ভাগিদার নয়। সবই আত্মস্থ ক'রে নেয় নিষ্কর্মা সুবিধাভোগী শ্রেণী।
তাই আমার মনে হয় স্বাধীনতার এই পঁচাত্তর বছর অন্য চুয়াত্তরটি বছরের মতোই সাধারণ মানুষের কাছে নেহাতই একটা বৈশিষ্ট্যহীন দিন হিসেবেই পরিগণিত হবে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন