স্বাধীনতার৭৫
মুক্ত গদ্য —৪
স্বাধীনতায় আর একজন ভগীরথ
ভবেশ বসু
স্বাধীনতা পঁচাত্তর।মোচড় দিয়ে উঠল শরীর।শরীর নাচলে মনও নৃত্য করে। তখনই নৃত্যের সব সরঞ্জাম এসে যায়।কতদিন পতাকা হাতে দৌড়াই নি।মাঠ,আল পথ পেরিয়ে ছুটছি।একটা বাঁশকঞ্চির কি জোর।সাদা কাপড় রাঙিয়ে নিয়ে ছিলাম।ছোট কাপড়।তাতে তিন রঙ।তিন পাড় শাড়ি।এই আমার মা।এই আমার পিতা।এই মাঠ ভরা ধান।সরসে কড়াই।সবই আমার।আল দিয়ে পৃথক করা জমি।তবু মনে হল,সবই আমার।আমাদের।আমাকে সঙ্গ দিল পাখি।মাঠের ব্যাঙ।কেঁচো কৃমি।বাতাসে নড়ছে এক টুকরো পতাকা।বাতাস যেদিকে,তার উল্টো দিকে আমি।ছুটছি আর ছুটছি।স্বাধীন ভারতের সন্তান আমি।এই গ্ৰামে আমার বাড়ি।নদী ঘেরা গ্ৰাম।নদী ঘেরা জঙ্গল।বাড়ি আমাদের মাটির।বাবা বলতেন এই রাজপ্রাসাদ।এখানেই আছে ধনদৌলত।গুপ্তধন।সকালে সূর্য কিরণ।রাতে চাঁদের হাসি।বাঁশ বনে এসে চাঁদ ডুবে তখন,তখন ভয় হতো।অভয় দিয়েছে মা।আমরা এখন স্বাধীন।খোকা,আঁধারেও পথ চলা যাবে।যেমন আমি এখন ছুটছি।আমাকে দেখে সাপখোপও ভয়ে কাঁপে।ভয় তো আঁধারের।আলোর ভয় হবে কেন।রাতে শুয়ে আছি।মায়ের হাত আমার কপালে।বলছেন,এমন করেই ছুটতে হয় খোকা।ছুটেই জ্ঞান শিক্ষা।সমাজ চেতনা।এই আনন্দই সংসার।এই খুশিই সন্ন্যাস।দুই আনন্দ এক হলে দেশ গড়া যাবে।ডাকাতেরা চলে গেছে।গৃহকোণ আবার সাজিয়ে নাও।আর মনের কোণে ঝড় রেখো না।মেঘ না। বিদ্যুৎ নয়।বাজ পড়বে না এখন।
—স্বাধীনতা কে মা?
—এক মায়ের নাম।এক পিতার নাম
—আমার মাতা পিতার নাম কি?
মা হাসলেন।সিঁদুর মাখা মাথা তার।কপালে ত্রিনয়ণ।ত্রিশূল হাতে ঘুমিয়ে আছেন বাবা।মা আদর দিচ্ছে আমায়।যেন গনেশ কোলে নিয়েছে।এক টুকরো আঁচলে মুখ মুছিয়ে দিলেন।
—মা,পতাকা কি ?
—এই তো পতাকা।তোমার মুখে চাপা দিলাম।আঁচল চাপা।
—বল না মা,মাতা পিতার নাম কি?
—আমার নাম,পিতার নাম—ভারতবর্ষ।
ঘুম ভেঙে গেল আমার।চমকে উঠে মাকে খুঁজছি।হাতড়ে হাতড়ে যাকে ধরলাম,সে স্ত্রী।পাশে অঘোরে ঘুমিয়ে আছে আমার সন্তান।যার জীবন এখন ঠিকানাহীন।ডাকঘরে অনেক চিঠি পড়ে থাকে।ঠিকানা না থাকায় প্রাপক পায় নি।আমার সন্তান ঠিক সেরকমই।স্ত্রী সবসময় আধ ঘুমে।ডাকলেই সাড়া দেয়।জেগে থাকে।তিথি অমাবস্যায়।তিথি পূর্ণিমাতেও।আলোতেও এখন না কি পথ ভয়ঙ্কর।পাশের বাড়ির ঝুপড়ি হতে বাচ্চাটা কাঁদে।তার চিৎকারে ভাতের হাঁড়ি উল্টে যায়।সেদিন শাড়ি ছেঁড়া এক মহিলা হাজির।আঁচলটুকুই সম্বল।হাড় জিরজিরে চেহারা।চোখে দেখে না।রুক্ষ চুল।ভিক্ষায় আছে।সকলেই সাক্ষর।কিন্তু নিরক্ষর।রাধা কৃষ্ণ ভাগ হয়ে যাচ্ছে।প্রতিদিন হচ্ছে।যে পোশাকে বাহিরে যাই,তাতে লাল ছোপছোপ দাগ।কিসের দাগ নারী জানে।তবু সে আমায় অভয় দেবে।আমার ছেলেবেলা,আমিই ভুলেছি?
—চলো না গো,আবার পতাকা ওড়াই।মাঠ ধরে ছুটে যাই।
—পতাকা তো ঘরে নেই!
—কিনে আনবো।কত লোক তো আনছে!
—পতাকা কিনে ওড়াবে?মায়ের আঁচল রাখো নি?
"মা" শব্দে কেঁপে গেল বুক।সন্তান উঠে পড়েছে।কখনো সে পতাকা বায়না ধরে নি।আজ বায়না করল।এই প্রথম।নারী তার আঁচলটা ছিঁড়ে দিল নিমেষে।ভোর হয়ে এসেছে।তাই নিয়ে ছুটল সন্তান।দেখাদেখি সকলেই বাহিরে এসেছে। স্বাধীনতা পঁচাত্তর।পঁচাত্তর পর্বেরও বেশি ভাগ হয়ে থাকা মানুষ এক গঙ্গায় মিশছে।ভগীরথ সামনে।
আমার সন্তানই ভগীরথ।আমাদের সন্তান।আমরা পারি নি।মাতাপিতার পরিচয় জানি না।সেই পরিচয় দিতে এবার সন্তানই গঙ্গা ডেকে তুলল।এবার ক্ষুধা থেকে একশো চল্লিশ কোটির মুক্তি।
—চলো সুজাতা,মায়ের আঁচল পেয়েছি।আমরাও ছুটে যাই!
লেখা আহ্বান
আপনিও এই বিভাগে আপনার মৌলিক ও অপ্রকাশিত একটা মুক্ত গদ্য লিখে পাঠিয়ে দিন অঙ্কুরীশা-র পাতায়।
মেল— ankurishapatrika@gmail. com
খুব ভালো লাগলো পড়ে, যেন জীবন্ত এক ছবি।
উত্তরমুছুন