ভালো আছি কিনা বলতে আজকাল খুব কষ্ট হয়- কেন ?
- পার্থ সারথি চক্রবর্তী
ভালো লাগার অনুভূতিগুলো যেন দিনদিন দূরে সরে যাচ্ছে। আমার এক বন্ধু , যে কলেজে পড়ায়, কেমন আছিস জানতে চাওয়ায় বলছিল ভালো আছি বলতে খুব কষ্ট হয় । গড়পড়তা এটাই মোটামুটি সবার অবস্থা । কোথায় যেন ভালো থাকার বা ভালো বোধ করার তাল কেটে যাচ্ছে । আমরা প্রায় সব কিছুই হাতের মুঠোয় পেয়েও ভালো থাকতে বা অন্যকে ভালো রাখতে পারছিনা । কিন্তু কেন । কি কারনে ?
পাড়ার এক প্রবীন নাগরিক যাকে কাকু বলে ডাকি তার সাথে দেখা হয়েছিল সেদিন সন্ধ্যায়। কাকুর ছেলে সাত বছর ধরে বোস্টনে থাকে, আর দেশে ফিরবে কিনা নিশ্চয়তা নেই । বছরে দুবার আসে, কাকুও বার দুয়েক গিয়েছিলেন বোস্টনে , কিন্তু তার বোধহয় সেখানে থাকতে বিশেষ ভালো লাগেনা । যদিও কিছু বুঝতে দিতে চাননা, ভালো থাকার বোধহয় চেষ্টা বা ভান কিংবা দুটোই করেন। বাজার থেকে ফেরার সময় সকালে কাশেমদার রিকশা করে আসছিলাম। আসার পথে কথা হচ্ছিল। ওনার ছোট ছেলেটা একটা বাসে খালাসির কাজ করে , মাইনে মাসে ৩৫০০ টাকা । কিন্তু কাজ কামাই করলে, তা যে কারনেই হোক , মাইনে কেটে নেয় । আর বড়টা জয়পুরে নির্মাণ শ্রমিক ।কাশেমদা বলল এখন আর আগের মত ভালো নেই । কেন ?
এই কেনর উত্তর পাওয়া কঠিন জানি , বা আদৌ পাওয়া যাবে কিনা তাও জানা নেই । আজ থেকে বছর দশেক আগে ফিরে গেলেও দেখা যাবে , মানুষ অনেক সহজ সরল ছিল , তার আচরণ ছিল অনেক সাদাসিধে । তার চাহিদা ছিল অনেক সীমিত । একজনের সাথে অন্যের যোগাযোগ ছিল নিবিড় । পাড়ার উৎসব গুলো ছিল ঘরোয়া । এখন সেখানে বিগ বাজেট , থিম পুজা । জমকালো আয়োজন , আলোর রোশনাই । তাতে আপত্তি করার বা করলেও তা শোনার বা শোনানোর কেও নেই , অন্তত প্রকাশ্যে । হোক বড় আয়োজন । কিন্তু কোথায় যেন প্রানের অভাব বোধ হয় কিনা ! আসলে মানবিক বন্ধনের জায়গা গুলো ক্রমশ আলগা হয়ে যাচ্ছে । সমাজবিজ্ঞানীরা বলেন মানুষ ই একমাত্র বায়লজিকাল এবং সামাজিক জীব । তারাই একমাত্র ভাবনাচিন্তা করতে পারে যৌক্তিক ভাবে । মনে হয় সেই জায়গায় কোথাও যেন ভাঁটা পড়ছে অথবা ধরণটা পুরোপুরি বদলে যাচ্ছে । মানুষ ধীরেধীরে সময়ের সাথে সাথে আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছে । সে ভাবছে শুধু তার কথা বা তাকে নিয়ে আবর্তিত হয় যে কজন মুষ্টিমেয় লোক , শুধুই তাদের কথা । এর পেছনে কাজ করছে ভোগবাদের চরম ইচ্ছা আর অসীম স্বার্থপরতা । তাই আমরা দেখতে পাই পথের পাশে পরে থাকা অসুস্থ পথচারীর দিক থেকে অক্লেশে মুখ ফিরিয়ে চলে যেতে পারি আমরা । তথাকথিত আইনী ঝামেলার কথা ভেবে দুর্ঘটনাগ্রস্তর দিকে দেখেও দেখিনা। পরিস্থিতি এমন জায়গায় পৌঁছচ্ছে যে পাশের পাড়া তো দুরস্থান , পাশের বাড়ির খবর ও আমরা রাখিনা । তার সামাজিক প্রভাব পড়ছে নব প্রজন্মের উপর। তারা তাদের বাবা মাকে দেখছে পাগলের মত ছুটতে তাদের জন্য , তাদের সাফল্যের জন্য, সে ভাল স্কুলে ভরতি হোক বা পরীক্ষায় প্রথম হওয়াই হোক । তার জন্য তারা কখন সখন সত্য-মিথ্যার বাছবিচার করছেন না । স্বার্থপরতা ধীরে ধীরে প্রবিষ্ট হচ্ছে সন্তানের মনে । ক্ষয় ধরছে আদর্শ বা মূল্যবোধে । ঘুণ ধরছে মানবিকতাতে । মহীরুহ হয়ে উঠছে আত্মকেন্দ্রিকতা আর স্বার্থপরতা । কারন যে বীজ আজ রোপিত হছে শিশুর অন্তরে, সকলের অলক্ষ্যে ; তাই রুপ নিচ্ছে বিষবৃক্ষের ,কিছুদিন বাদে । বড়দের প্রতি , গুরুজন দের প্রতি সম্মানবোধ কি , ন্যুনতম সৌজন্য দেখাতে ভুলে যাচ্ছে নবপ্রজন্ম । এর মুলে হয়ত আমরা নিজেরাই ।চরম স্বার্থপরতা , অন্যের প্রতি উদাসীনতা আর যেন তেন প্রকারেন নিজের কাজ চরিতার্থ করার উদগ্র বাসনা আমাদের ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে এক তুমুল অনিশ্চয়তার দিকে ।
উত্তরণের পথ খুঁজতে হবে আমাদেরকেই। আর সেই পথে হাঁটতে হবে।তবে তা কিন্তু শুরু করতে হবে নিজের ঘর থেকেই । কথায় আছে -আপনি আচারি ধর্ম পরেরে শিখায় ।আমাদের ঘরের ক্ষুদ্রতম সদস্যকে দিয়ে এই পাঠ শুরু করতে হবে । স্বার্থপরতা ত্যাগ করতে হবে । আত্মনির্ভরতা আবশ্যিক , কিন্তু আত্মকেন্দ্রিকতা পারিত্যাজ্য । সমাজ গঠনের পাঠদান করা দরকার নবপ্রজন্মকে । এই বোধ জাগানো খুব দরকার যে একা ভালো থাকলে , সেই ভালো থাকা স্থায়ী হতে পারে না । আর সমাজের একজন ভালো না থাকাও সংক্রামক রোগের মত । সকলের প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে পাশে থাকতে হবে।আমরা সমাজবদ্ধ জীব , এটা ভুলে গেলে চলবে কেন? উপরের জনৈক বন্ধু বা পাড়ার কাকু বা কাশেমদা আমাদের ই লোক , এই সমাজের প্রতিনিধি। সবাইকে ভালো রাখতে পারলেই আমরা ভাল থাকব, বা সমাজ ভালো থাকা সম্ভব । মূল্যবোধ আর নৈতিকতাকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। জাগাতে হবে সৌ-ভ্রাতৃত্ববোধ । ভারতীয় সমাজের সুপ্রাচীন সংস্কার বাঁচিয়ে রাখতে হবে, কুসংস্কার কে চিরতরে বিদায় জানাতে হবে । দেখাই যাক না। আশায় বাঁচে চাষা ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন