-
ঈশ্বরের চেয়েও ঈশ্বরঃ
শ্রদ্ধা ও স্মরণে - অশোককুমার লাটুয়া
বিদ্যাসাগর প্রাতঃস্মরণীয় ক্ষণজন্মা পুরুষ। চরিত্রগৌরবে এখনও তিনি অনন্য এবং অদ্বিতীয়। কৃতজ্ঞচিত্তে তাঁকে শ্রদ্ধার্ঘ্য জানিয়ে মধু কবি লিখেছেন-
The man to whom I appealed has the genius and wisdom of an ancient sage, energy of an Englishman and the heart of a Bengalee mother.
রবি কবির নিবেদন —
' তিনি নবীন ছিলেন এবং চিরযৌবনের অভিষেক লাভ করে বলশালী হয়েছিলেন। তাঁর এই নবীনতাই আমার কাছে সবচেয়ে পূজনীয়, কারণ তিনি আমাদের দেশে চলার পথ প্রস্তত করে গেছেন।'
তাছাড়া তাঁর সম্পর্কে আরো বলা হয়,
' ঈশ্বরচন্দ্রকে নতুন করে চিনতে হবে, দেশের তরুণ - তরুণীদের কাছে, কিশোর - কিশোরীদের কাছে নতুন করে চেনাতে হবে। বিদ্যাসাগর মানে মাতৃভক্তি নয়, বিদ্যাসাগর মানে বিধবা - বিবাহ নয়, বিদ্যাসাগর মানে দয়া - দাক্ষিণ্য নয়, বিদ্যাসাগর মানে হল ইস্পাত, যে ইস্পাত দিয়ে তৈরী হয় জাতীয় জীবনের কাঠামো। '
বীরসিংহের সিংহশিশু বিদ্যাসাগর জন্মেছিলেন ১৮২০ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর। পিতা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, মা ভগবতী দেবী। দারিদ্র্য ছিল নিত্যসঙ্গী। কিন্তু দারিদ্র্য হার মেনেছে তাঁর কঠোর কঠিন জীবনযুদ্ধের কাছে। ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় নামটি ঢাকা পড়ে গেছে তাঁর ' বিদ্যাসাগর ' উপাধির আড়ালে। সংস্কৃত সাহিত্য, ব্যাকরণ, ন্যায়, বেদান্ত, স্মৃতি, অলঙ্কার প্রভৃতি বিষয়ে পান্ডিত্যের জন্য তিনি পেয়েছিলেন ' বিদ্যাসাগর ' উপাধি।
মাত্র ২১ বছর বয়সে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে সংস্কৃত বিভাগে অধ্যাপনাতে শুরু হয় তাঁর কাজের জীবন। কাজের কুশলি দক্ষতায় সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ হন তিনি। বিশেষ বিদ্যালয় পরিদর্শকের পদেও নিযুক্ত হয়েছিলেন তিনি। মতবিরোধের কারণে স্বাধীনচেতা বিদ্যাসাগর দুটি পদেই ইস্তফা দিয়েছিলেন একই সঙ্গে। ঝাঁপিয়ে পড়লেন তিনি সমাজসংস্কার, শিক্ষাবিস্তার ও সাহিত্য সাধনায়। তাঁর সংবেদনশীল হৃদয়, গভীর দেশানুরাগ, আত্মমর্যাদাবোধ এবং স্বাজাত্যভিমান আমাদের মেরুদণ্ডকে প্রচন্ড আত্মবিশ্বাস। ঈশ্বরচন্দ্রের মূর্তিটি সামগ্রিক হয়ে ওঠে বিধবাবিবাহের নিরন্তর সংগ্রামে। তাঁর আন্তরিক চেষ্টায় ১৮৫৬ খৃষ্টাব্দের ২৬ জুলাই ' বিধবা বিবাহ আইন ' পাস হয়। ১৮৫৬ — ১৮৬৭ পর্যন্ত এগারো বছরে বিদ্যাসাগর মোট ষাটজন বিধবার বিয়েতে নিজের রোজগারের বিরাশি হাজার টাকা খরচ করেছিলেন। তিনি পরাশর সংহিতা থেকে-
' নষ্টেমৃতে প্রব্রজিতে ক্লীবে চ পতিতে পতৌ
পঞ্চস্বাপৎসু নারীণাং পতিরন্যো বিধিয়তে।। 'ইত্যাদি শ্লোক উদ্ধার করে প্রমাণ করেন যে বিধবাবিবাহ শাস্ত্রানুমোদিত। বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহের বিরুদ্ধেও সমাজশাস্ত্রীদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নারীমুক্তি আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন।
স্ত্রী শিক্ষা নারীমুক্তি আন্দোলনের প্রাথমিক শর্ত। রক্ষণশীলদের সঙ্গে তর্কযুদ্ধে মহানির্বাণ তন্ত্র থেকে নারীশিক্ষার পক্ষে উদ্ধৃতি তুলে ধরলেন —
' কন্যাপ্যেবং পালনীয়া শিক্ষণীয়াতি যত্নতঃ। '
বিদ্যাসাগরের গাড়িতে এই মটো লেখা থাকত। এই মটো বিদ্রোহেরই নামান্তর।
১৮৪৯ সালে বেথুন বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করলে বিদ্যাসাগর তার প্রথম সম্পাদক হলেন। শিক্ষাবিভাগের ইন্সপেক্টর পদের সুবাদে তিনি জেলায় জেলায় বালক বিদ্যালয়ের সঙ্গে সঙ্গে বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। ১৮৫৭ — ১৮৫৮ সালের মধ্যে ৩৫ টি বালিকা বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা হন। কলকাতায় তাঁর প্রতিষ্ঠিত মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশন, বীরসিংহ গ্রামে মায়ের নামে প্রতিষ্ঠিত ভগবতী বিদ্যালয় শিক্ষানুরাগের পরিচয়।
সংস্কৃতে পন্ডিত হয়েও ইংরেজি ভাষাতে দক্ষতা দেখিয়েছেন বিদ্যাসাগর। ইংরেজিতে লেখা তাঁর এডুকেশন রিপোর্টগুলি যেকোনো ইংরেজকেই ঈর্ষান্বিত করবে সন্দেহ নেই। ঠাকুর দেবতা সম্পর্কে উদাসী
হয়েও মানুষকেই দেবতা বলে
মনে করতেন দয়ার সাগর
বিদ্যাসাগর।
বাংলা গদ্যের আলপথকে তিনি রাজপথে পরিণত করেছেন। তিনি গদ্যলেখক নন, গদ্যকে শিল্পের মর্যাদা দিয়ে তিনি হয়ে উঠেছেন গদ্যশিল্পী এবং বাংলা গদ্যের যথার্থ জনক।
অনুবাদকরূপে আত্মপ্রকাশ তাঁর। ১৮৪৭ খৃষ্টাব্দে হিন্দি ' বৈতাল পচ্চীসী ' থেকে বাংলায় লিখলেন ' বেতাল পঞ্চবিংশতি '। এরপর কালিদাসের ' অভিজ্ঞান শকুন্তলম্ ' নাটক থেকে বাংলায় অনুবাদ করলেন ' শকুন্তলা। ' ভবভূতির ' উত্তর রামচরিত ' নাটক এবং বাল্মিকী রামায়ণ অাশ্রয় করে লেখা হল সীতার বনবাস। শেক্সপিয়রের ' কমেডি অফ এরর্স ' নিয়ে লিখলেন ভ্রান্তিবিলাস। ভাবানুবাদে এই লেখাগুলি বেশ সরস এবং উপভোগ্য।
অনূদিত পাঠ্যগ্রন্থগুলিও উল্লেখযোগ্য — মার্শম্যানের হিস্ট্রি অফ বেঙ্গল অবলম্বনে তাঁর লেখা বাংলার ইতিহাস গ্রন্থটি একটি মাইলফলক। এছাড়া চেম্বার্সের রুডিমেন্ট অফ নলেজ এবং বায়োগ্রাফিক্স নিয়ে লেখা তাঁর গ্রন্থ দুটি হলো বোধোদয় আর জীবনচরিত। ১৮৫৬ তে ঈশপের ' ফেবলস্ ' নিয়ে লিখলেন কথামালা। অনুবাদ হলেও গ্রন্থগুলি যথার্থ মৌলিক গ্রন্থের মর্যাদা পেয়েছে।
বিদ্যাসাগরের মৌলিক গ্রন্থের সংখ্যাও কম নয়। সংস্কৃত ভাষা ও সংস্কৃত সাহিত্য শাস্ত্র বিষয়ক প্রস্তাব বাঙালির লেখা সংস্কৃত সাহিত্যের প্রথম ইতিহাস। সমাজসংস্কারমূলক রচিত দুটি গ্রন্থ হলো বিধবা বিবাহ চলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক বিচার এবং বহু বিবাহ রহিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক বিচার। অভ্রান্ত যুক্তি ও তথ্যে গ্রন্থ দুটি সমৃদ্ধ। অত্যন্ত সংক্ষেপে লেখা তাঁর আত্মচরিতটির নাম বিদ্যাসাগর চরিত। বন্ধু রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কন্যা প্রভাবতীর অকাল মৃত্যুতে ব্যথিত বিদ্যাসাগর লিখেছিলেন ছোট্ট একটি গদ্য
' প্রভাবতী সম্ভাষণ '। তাঁকে নিয়ে ব্যঙ্গ বিদ্রূপের যোগ্য জবাব দিতে কস্যচিৎ উপযুক্ত ভাইপোস্য ছদ্মনামে তিনি লেখেন অতি অল্প হইল, আবার অতি অল্প হইল এবং ব্রজবিলাস। এমন উচ্চাঙ্গের রসিকতা বাংলা সাহিত্যে বিরল। ১৮৮৬ তে উপযুক্ত ভাইপো সহচরস্য ছদ্মনামে বিদ্যাসাগরের আর একটি লেখা 'রত্নপরীক্ষা'। ১৮৫৫ তে লেখা বর্ণপরিচয় বাংলা গদ্যের সম্পদ। ' একদা এক বাঘের গলায় হাড় ফুটিয়াছিল ' — এ গল্প এবং 'জল পড়ে পাতা নড়ে ' চিরকালের শিশুমনের পৃথিবী।
সহজ সাধুভাষা, সংস্কৃতপ্রধান গম্ভীরভাষা,রঙ্গকৌতুকের ভাষা, সরল সংলাপধর্মী গদ্য দিয়ে সাজানো বিদ্যাসাগরের লিখনশৈলী। বাংলা মায়ের গৌরব বিদ্যাসাগর ১৮৯১ সালের ২৯ জুলাই পৃথিবী ছেড়ে চলে যান। কিন্তু না, তাঁর মৃত্যু নেই — তিনি মৃত্যুঞ্জয়। তিনি তাঁর চরিত্রের যে অক্ষয় বটবৃক্ষ রোপণ করে গেছেন তার ছায়া আজ তীর্থস্থানে পরিণত হয়েছে। আগামী প্রজন্মের কাছে প্রেরণার দীপশিখা। তিনি ঈশ্বরের চেয়েও ঈশ্বর।
আজ তাঁর ১৩০ তম প্রয়াণ দিবস। উত্তরসূরী হিসাবে কবির সাথে কন্ঠ মিলিয়ে বলি —
'সাগরে যে অগ্নি থাকে, কল্পনা সে নয়।
চক্ষে দেখে অবিশ্বাসীর হয়েছে প্রত্যয়।।'
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন