ধারাবাহিক রহস্য উপন্যাস ( পর্ব-৬)
মুখোশের আড়ালে
আবীর গুপ্ত
দোতলার ছোট্ট ঘরটা একটা কোণে করিডোরের শেষে। কোনো জানালা
নেই। এমনকি করিডোরের নানা জায়গায় সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো থাকলেও এই ঘরে কিন্তু
কোন ক্যামেরা নেই। একটা লোহার টেবিলের দুপাশে চারটে লোহার চেয়ার। কমিশনার সাহেব হেসে
বললেন –
- এই রুমটা কয়েদিদের সঙ্গে
যদি কখনো ইন্টারোগেশনের দরকার হয় সেই ভেবে বানানো হয়েছিল। কোন কাজে আসে না, পড়েই
আছে। আমি যতদূর জানি গত দু'বছরের মধ্যে একদিনের জন্যও ব্যবহার করা হয়নি। ঘরটা লক করা
থাকে। চাবি আমার কাছে থাকে, তাই নিশ্চিন্ত হয়ে তোমাকে ডেকে নিয়ে এলাম। এবারে বল তো
তোমার কী মনে হচ্ছে?
- আমি যে লজেন্সগুলো নারকোটিক্স
ডিপার্টমেন্টে টেস্টের জন্য পাঠিয়েছিলাম এবং তার রিপোর্ট হাতে পেয়েছি সেটা সম্পূর্ণ গোপন রেখেছিলাম। যাঁকে টেস্টের জন্য দিয়েছিলাম তিনি আমার অত্যন্ত পরিচিত এবং তিনি নিজেই টেস্টটা করে নিজেই কম্পিউটারে টাইপ করে
রিপোর্টটা আমার দিয়েছেন যাতে কেউ জানতে না পারে। এরপর রিপোর্টটা আমি আপনার এখানে মিটিংয়ে
এসে আপনার হাতে দিয়েছিলাম। আপনি রিপোর্টটা পড়ে বাকিদের শুনিয়েছিলেন। চারটে লজেন্সে
কোকেন পাওয়া গিয়েছিল। ওরাও আমাকে রক্তমাখা চারটে লজেন্স পাঠিয়েছে। অর্থাৎ, ওরা খবর
পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে চারটে রক্তমাখা লজেন্স আর টাকা বাক্সে ভরে আমাকে পাঠিয়ে দিয়েছে।
কোন কুরিয়ার সংস্থার মাধ্যমে পাঠায়নি, সম্ভবত কাউকে টাকা দিয়ে ফিট করেছিল প্যাকেটটা
আমার বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার জন্য। হরিকাকাকে জিজ্ঞাসা করে এটা বুঝতে পেরেছি কারণ হরিকাকাই
প্যাকেটটা রিসিভ করেছিল। খবরটা আপনি লিক করেন নি, তাহলে? সম্ভবত মিটিংয়ে যে দশজন উপস্থিত
ছিলেন তাদের কেউ ওদের লোক। সেই লোকটিই খবরটা ওদের দিয়েছে।
- ওঃ, মাই গড! আমি ভাবতেই পারছি
না। আর ইউ শিওর?
- স্যার, আমার এটাই মনে হয়েছে।
এছাড়া আর কোনো যুক্তি পাচ্ছি না।
- হয়তো তুমি ঠিকই বলেছ। এখন
কী করনীয়? এনি সাজেশন?
- স্যার, এই দশজনের পিছনে লোক
লাগানো কি সম্ভব? ওদের সবার সেলফোন যদি ট্যাপ করা যায় তাহলে হয়তো কোন ইনফরমেশন পাওয়া
গেলেও যেতে পারে। এছাড়া, আজ সারাদিনের সবার ফোন কল ডিটেইলসটা যদি পাওয়া যায় হয়তো
কোন সূত্র পাওয়া যেতে পারে।
—ওদের সবার ফোন ট্যাপ করা!
না- না, এটা অনৈতিক হবে।
- আমার মনে হচ্ছে আপনার ফোন
ট্যাপ করা হয়েছে। এই বিষয়ে যদি সাবধানতা নেন-
- আমার ফোন ট্যাপ করা হয়েছে!
আর ইউ ক্রেজি! তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে।
- সরি স্যার। তাও যদি একবার
চেক করে দেখেন।
- ও-কে। আমি এক্সপার্টদের সঙ্গে
কথা বলব। তোমার সাজেশনটা ভালোই, দেখছি কী করা যায়। আগামীকালকে সকালে তোমাকে না হয়
ফোনে জানিয়ে দেব।
- আপনার ফোন থেকে নয়।
- ঠিক আছে, বুঝেছি। তোমার বৌদির ফোন থেকে ফোন করব। দিল্লী কবে যাচ্ছ?
- আমি তো দিল্লী যাচ্ছি না,
ওদের কথামতো দশ লাখ টাকা নিয়ে ঘুরতে বেরোচ্ছি। পুরো নর্থ ইন্ডিয়া ঘুরে বেড়াবো। মোটামুটি
কুড়ি বাইশ দিনের প্রোগ্রাম। দিল্লি ফ্লাইটে গিয়ে তারপর গাড়ি ভাড়া নিয়ে নেব। এটাই
আমার প্ল্যান।
-ভেরি গুড। গো আহেড। সাহায্যের
দরকার হলে জানাবে।
অনামিকা মুচকি হেসে বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। সোজা নিজের
গাড়িতে উঠে গাড়ি চালিয়ে চলে গেল লেক থানায়। সুধাময়বাবুকে থানাতেই পেয়ে গেল। সুধাময়বাবু
দিলখোলা মানুষ। অত্যন্ত সৎ ও কর্মঠ হলেও অনামিকা জানে ওঁর মুখ ফসকে মাঝে মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ
তথ্য বেরিয়ে আসে। সেটা ওঁর দিলখোলা স্বভাবের জন্যই হয়। তাই, যখন সুধাময়বাবু জিজ্ঞাসা
করলেন ওর পরবর্তী প্ল্যান কী তখন হাসতে হাসতে বলল –
- কাকু, ভীষণ টায়ার্ড হয়ে
পড়েছি। একঘেয়ে জীবন, সকালে উঠে সুইমিং, তারপর কুংফু প্র্যাকটিস, হয় বাড়িতে বই পড়া
বা টিভি দেখা নয়তো অপরাধীদের পিছনে ধাওয়া করা – নাঃ, অসহ্য লাগছে। ঠিক করেছি দিন
কুড়ি বাইশের জন্য নর্থ ইন্ডিয়া ঘুরতে যাব। আগামী পরশু ফ্লাইটে দিল্লী যাচ্ছি। ওখান
থেকে গাড়ি ভাড়া নিয়ে ঘুরতে বেরিয়ে পড়ব।
- বাহ্, খুব ভালো। দিল্লিতে
আমার এক শালা থাকে, ওর একটা ট্রাভেল এজেন্সি আছে। থাকা, গাড়ি যা যা প্রয়োজন ওকে বললেই
ব্যবস্থা করে দেবে। ছেলেটা অত্যন্ত সৎ, ওকে বিশ্বাস করতে পারো। আমার রেফারেন্সে যাচ্ছ
তাই তোমার জন্য সবকিছু করবে। আমায় খুব শ্রদ্ধা করে।
অনামিকা থানা থেকে বেরিয়ে চলে গেল ওর বান্ধবী অনিতার
বাড়ি। অনিতাকে বাড়িতে পেয়ে গেল। দুজনে চুটিয়ে ঘণ্টা তিনেক আড্ডা মারল। তারপর অনিতাকে ঘুরতে বের হচ্ছে জানিয়ে বেরিয়ে এল। সোজা চলে এল বাড়িতে। আগামীকাল কোথাও বেরোবে না। বাড়িতেই থাকবে। এই মুহূর্তে কোন রকম হঠকারী সিদ্ধান্ত
সবকিছু তালগোল পাকিয়ে দিতে পারে।
রাতে দেবাঞ্জনের বাবা ওকে ফোন করে যখন পরদিন সকালে ওর
বাড়িতে আসতে চাইলেন তখন একটু ইতস্তত করে রাজি হয়ে গেল। পরদিন সকাল দশটা নাগাদ দেবাঞ্জনের
বাবা এলেন সঙ্গে একজন অপরিচিত ইয়ং ভদ্রলোক। দেবাঞ্জনের বাবা বললেন –
- ইনি আমার এক বিশেষ পরিচিত
ভদ্রলোকের পাড়ায় থাকেন। আমাকে অনুরোধ করলেন আপনার সঙ্গে কথা বলিয়ে দেওয়ার জন্য
তাই সঙ্গে করে নিয়ে এলাম।
ভদ্রলোক দুহাত জড়ো করে নমস্কার করে বললেন–
- আমি শ্যামল সিনহা, বড়বাজার
এরিয়াতে বাড়ি। আমার ভাইয়ের একটা সমস্যা নিয়ে আপনার কাছে এসেছি।
অনামিকা একটু ইতস্তত করে জিজ্ঞাসা করল –
- কী সমস্যা?
- প্রতিদিন-ই স্কুল থেকে ফেরার
পর দেখছি অল্পবিস্তর নেশা করে ফিরছে। জিজ্ঞাসা করলেও কিছু বলতে চাইছে না। দেবাঞ্জনেরও
নাকি একই রকম সমস্যা নিয়ে আপনি তদন্ত করছেন বলে শুনলাম। আপনার সাহায্য চাই।
- এই মুহূর্তে আমি কোন কেস হাতে
নিছি না। দেবাঞ্জনের কেসটা নিয়ে ফেলেছি তাই ছাড়তেও পারছি না, খুব অসুবিধায় পড়ে
গেছি। আসলে আগামীকাল আমি নর্থ ইন্ডিয়া ঘুরতে বেরিয়ে যাচ্ছি, কুড়ি বাইশ দিনের ট্রিপ
হবে। সেটা বাড়তেও পারে। আগামীকাল সকালে দিল্লির ফ্লাইট। স্যরি। ফিরে আসার পর হাতে
সময় থাকলে ডেফিনেটলি আপনার কেসটা দেখব।
- নর্থ ইন্ডিয়ার কোথায় কোথায়
ঘুরবেন?
- দিল্লি থেকে হরিদ্দার, হৃষীকেশ
হয়ে মুসৌরি, দেরাদুন। ওখান থেকে হিমাচল প্রদেশের লাহুল, স্পিতি, কল্পা-কিন্নর অথবা
জম্মু-কাশ্মীর। এখনও ঠিক করিনি, পরিস্থিতি বুঝে ব্যবস্থা।
- কীসে ঘুরবেন?
- দিল্লি থেকে গাড়ি ভাড়া নিয়ে
নেব। কোয়ালিস বা বলেরো।
- একলা?
- অবশ্যই। আমার একলা ঘুরতেই
ভালো লাগে।
- একজন মহিলা একা একা ঘুরবেন!
আপনার সিকিউরিটি? জায়গাগুলো টুরিস্ট
স্পট তাই খারাপ লোক প্রচুর পাবেন।
- ও নিয়ে ভয় করি না।
শ্যামলবাবু উঠে ড্রয়িংরুমের নানা জিনিস দেখতে দেখতে
নানা রকম প্রশংসা করতে শুরু করলেন। অনামিকার মুখে হাসি, চোখ নজর রাখছিল শ্যামলবাবুকে।
অবশেষে ওঁরা চলে গেলেন। অনামিকা সদর দরজা বন্ধ করে দ্রুত ড্রইংরুমটা সার্চ করা শুরু
করল। যেটা খুঁজছিল সেটা পেল সোফা সেটের বসার গদির নিচে একটা দুদিক আঠালো টেপের সাহায্যে
লাগানো আছে। ছোট্ট কর্ডলেস মাইক্রোফোনটা সাবধানে খুলে ড্রইং রুমের টেবিলের উপর রেখে
দিল। ডেসট্রয় করল না তাতে অসুবিধা হতে পারে। এই মুহূর্তে ও কোন ফালতু ঝামেলায় জড়াতে
চাইছে না। শুধু জানালা দিয়ে বাইরে উঁকি মেরে দেখল উল্টোদিকের বাজারের সামনে চায়ের
দোকানে বসে নিউজ পেপার পড়তে পড়তে যে লোকটি চা খাচ্ছিল সে নেই। তার জায়গায় আরেকজন
সেখানে বসে মন দিয়ে ডিম রুটি খাচ্ছে। অনামিকা হেসে ফেলল। প্ল্যানটা কাজে এসেছে। শ্যামল
সিনহার বাড়ি থেকে শুরু করে সব রকম তথ্য দুই-একদিনের মধ্যেই পেয়ে যাবে। নতুন বদলির
বয়স বেশি এবং অনামিকার চেনা। একসময় একটা কেসে ছোট্ট একটি সাহায্যের জন্য কমিশনার
সাহেব ওকে পাঠিয়েছিলেন। এই দুজনই নাকি অত্যন্ত বিশ্বস্ত, সৎ এবং কৌশলী এফিসিয়েন্ট
পুলিশ অফিসার।
একটি অন্য স্মার্টফোন নিয়ে হরিকাকাকে বলে চলে গেল বাড়ি
অর্থাৎ অ্যাপার্টমেন্টের ছাদে। ছাদে কেউ খুব একটা যায় না। একটা নির্দিষ্ট নাম্বারে
ফোন করল, যেই ফোন নম্বরটা সেভ করা আছে “বকুলদা” হিসাবে। উল্টোদিকে যিনি ফোন ধরলেন তিনি
মহিলা। তিনি ফোনটা অন্য একজনকে দিলেন। অনামিকা হেসে বলল –
- স্যার পাখি ফাঁদে পা দিয়েছে।
ঘরে মাইক্রোফোনও রেখে গেছে। তাই, ফোন আপনি করবেন না, আমি করব। যা হবে জানাব। পাখি সম্বন্ধে সব তথ্য দু-একদিনের মধ্যে এই নম্বরে হোয়াটস অ্যাপ করে পাঠালে
ভাল হয়। আমি কখন কোথায় কী অবস্থায় থাকব জানি না। আপাতত দিল্লি হয়ে হরিদ্দার-হৃষীকেশ
যাচ্ছি। তারপর পিছনে ফেউ থাকলে যদি ঝেড়ে ফেলতে পারি তাহলে দু-তিনদিন তা না হলে দিন
পাঁচ ছয় লেগে যাবে। আপনি দশজনের মধ্যে কাউকে আইডেন্টিফাই করতে পারলেন?
- হ্যাঁ। যা যা ব্যবস্থা করার
করা হয়েছে। ইনফরমেশনের আপডেট পাঠানো হবে। বি কেয়ারফুল। একটা ডেঞ্জারাস মিশনে নেমেছ
বলে আমার এখন মনে হচ্ছে।
অনামিকা কোন কথা না বলে ফোনটা কেটে দিল কারণ সিঁড়িতে
পায়ের আওয়াজ পাচ্ছে! কেউ আসছে ছাদে! স্ট্রেঞ্জ!
চলবে...
ধারাবাহিক রহস্য উপন্যাসটি প্রতি মাসের প্রথম রবিবার অঙ্কুরীশা-র পাতায় প্রকাশিত হবে। আপনারা অঙ্কুরীশা-র পাতাটি ক্লিক করে পড়ুন ও মতামত জানান।
বেশ ভাল
উত্তরমুছুন