লেবেল

বুধবার, ৯ ডিসেম্বর, ২০২০

ধারাবাহিক রহস্য উপন্যাস (পর্ব-৬) ।। অষ্টভুজ রহস্য । অলোক চট্টোপাধ্যায়।



ধারাবাহিক রহস্য উপন্যাস (পর্ব-৬)


অষ্টভুজ রহস্য

অলোক চট্টোপাধ্যায়

কথায় কথায় পথ কেটে গেল। ট্যাক্সি এসে পৌঁছোলো সল্ট লেকে দত্তবাড়ির সামনে। তিনতলা বাড়ি। নিচের তলায় বিশাল বসার ঘর। ফোনে খবর পেয়ে ডক্টর বিজয় দত্ত আর তার বন্ধু, সুগত বাগচির মামা, আদিনাথ সান্যাল সেখানেই অপেক্ষা করছিলেন ওদের জন্যে। বিজয়বাবুর দুই ভাইও ওদের আসার খবর পেয়ে নিচে নেমে এলেন।

ঘটনার দুদিন পরেও বিজয়বাবুর বিহ্বল ভাবটা ঠিক মত কাটেনি। ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে কিছুকিছু আগেপরে হয়ে যাচ্ছিল। রজতবাবু চুপচাপ শুনলেন সবকিছু। মাঝে কোনো প্রশ্ন নয়। সব শোনার পর সুজয়বাবুর কাছে জানতে চাইলেন ঐ সন্ধ্যেতে তারা, মানে তিনি আর ড্রাইভার নীলমনি কি ভাবে ওখানে পৌঁছেছিলেন আর কি অবস্থায় তার দাদাকে উদ্ধার করেন।

সুজয়বাবু বললেন -গাড়ি সারিয়ে নীলমনি বাবুবাজারে পৌঁছেছিল ছটা নাগাদ। সেখানে দাদাকে দেখতে না পেয়ে ফোন করার চেষ্টা করে। কিন্তু লাইন পায়নি। তখন ও চলে যায় পুরোনো বাড়িতে। সেখানে নাকি গেটের বাইরে থেকে ডাকাডাকিও করেছিল, দাদার সাড়া না পেয়ে আমাকে ফোন করে। ভেতরে ঢুকতে সাহস পায়নি। দাদা কারো কথা না শুনে বাসে ওঠার পর থেকেই আমার মনটা কেমন যেন কুডাক ডাকছিল। সঙ্গে সঙ্গে অফিস থেকে বেরিয়ে শিয়ালদা থেকে ক্যানিংএর ট্রেন ধরি। নীলমনিকে বলে দিই ক্যানিং স্টেশনে এসে আমার জন্যে অপেক্ষা করতে। আমার পৌঁছোনোর আগেই গাড়ি নিয়ে নীলমনি পৌঁছে গিয়েছিল। আমরা সঙ্গে সঙ্গেই রওনা হয়ে ও বাড়িতে  পৌঁছে সামনের দোকান থেকে কিছু লোকজন যোগাড় করে বাড়ির ভেতর ঢুকি। তারপরের ঘটনা তো আপনি শুনলেন।

-ঠিক কটা নাগাদ আপনাদের দাদাকে ওখানে খুঁজে পান?

-মনে হয় নটা নাগাদ হবে

-ক্যানিং থেকে আপনাদের গ্রামে যেতে কতক্ষন লাগে। রজতবাবুর প্রশ্ন।

-গাড়িতে মোটামুটি একঘন্টার মত।

- শিয়ালদার থেকে কটার ট্রেন ধরেছিলেন সেটা খেয়াল আছে?

-তা ঠিক জানিনা। তবে প্রথম যে ট্রেনটা পেয়েছিলাম তাতেই উঠেছিলাম। প্রচন্ড ভিড় ছিল। সুজয়বাবু জানালেন। - আন্দাজ সাড়ে ছটা নাগাদ হবে।

-ক্যানিং ট্রেনে মোটামুটি সোয়া ঘন্টার মত লাগে। রজতবাবু নিজের মনেই হিসেব করলেন। - তার মানে পৌনে আটটা নাগাদ ক্যানিং আর পৌনে নটা নাগাদ আপনাদের পোড়ো বাড়িতে পৌঁছোনোর কথা। লোকজন যোগাড় করে ভেতরে ঢুকতে আরো কিছুটা সময় লেগেছে নিশ্চয়ই। 

-তা হবে। সুজয়বাবু বললেন।

-বাবুবাজার থেকে আপনাদের বাড়িটা কতদুর? রজতবাবু আবার প্রশ্ন করলেন। - মানে গাড়িতে বা সাইকেল রিকশায় যেতে কতক্ষন সময় লাগে?

- গ্রামের রাস্তায় গাড়ি আর রিকশাতে খুব বেশি সময়ের তফাত হয়না। মোটামুটি মিনিট পনেরোর মত লাগে মনে হয়। আসলে সেভাবে ঠিক খেয়াল করে দেখিনি কখনো।

-আচ্ছা, ঐ বাড়ির থেকে বেরিয়ে বিজয়বাবুকে কোনো ডাক্তার দেখিয়ে ছিলেন? আসলে ওনার শরীর যেরকম খারাপ হয়েছিল, অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন, সেই ভেবেই বলছি।

-ফেরার পথে জয়চন্দ্রপুরে একজন ডাক্তারের চেম্বার খোলা দেখে একবার দেখিয়ে নিয়েছিলাম।এমনি সব ঠিকঠাক ছিল, তবে ব্লাডপ্রেশার বেশ বেশিই ছিল। উনি পরে একটা ইসিজি করতে বলেছিলেন। তা, পরদিন আমাদের বাড়ির ডাক্তারবাবুকে দেখান হয়েছিল। ইসিজিও হয়। বিশেষ কিছু গোলমাল পাওয়া যায়নি।

-কোনো ব্লাড টেস্ট করানো হয়নি। রজতবাবু জানতে চাইলেন। না, সে রকম কোনো নির্দেশ ডাক্তারবাবু দেননি।

-আরো একটা কথা আমার জানার আছে। তার সঙ্গে হয়তো এই ঘটনার তেমন সম্পর্ক নেই। রজতবাবু বললেন। - আপনাদের মা তো একমাত্র সন্তান ছিলেন। সেক্ষেত্রে আপনারা তিন ভাইই তো আপনাদের দাদুর সম্পত্তির উত্তরাধিকারী?

-দাদু উইল করে আমাদের তিন ভাইকে সমানভাবে সম্পত্তি ভাগ করে দিতে চেয়েছিলেন। এবেরে বিজয়বাবু উত্তর দিলেন। - বাবার কাছে এ খবর শুনে আমি টেলিফোনে দাদুকে বোঝাই যে আমাকে সম্পত্তির অংশ দেবার কোনো প্রয়োজন নেই। বরং সুজয় অজয়ের মধ্যে সেটা ভাগ করে দিলে ওরা ঠিকমত দেখাশুনো করতে পারবে। আসলে আমি তখন বিদেশেই সেটল করব ঠিক করে ফেলেছি। তবে সেটা দাদুকে বা বাবাকে বলিনি। বাবা মনে হয় কিছুটা আন্দাজ করে নিয়েছিলেন। কিন্তু দাদু মনেপ্রানে চাইতেন আমি ফিরে আসি, আর আমিও তাকে আঘাত দিতে চাইনি বলেই কখনো সেকথা জানাইনি। ফলে দাদু জেদ করতেন, আমাকেও সমান অংশ লিখে দেবার জন্যে। শেষ পর্যন্ত মাঝামাঝি রফা হয়, বাড়ি আর সংলগ্ন কয়েক বিঘে জমি, বাগান ইত্যাদি নিতে আমি রাজি হই। বাকি জমি, ফলের বাগান,অয়েল মিল, ভেড়ি ইত্যাদি সুজয় আর অজয়ের নামে ভাগ করে দেন। এছাড়া গ্রামের অন্যদিকে কিছু চাষের জমিও ছিল। পরে উইল করার সময় জীবনদাদুর পরিবার, সুবলদা আর   আরো কয়েকজন পুরোনো কর্মচারিদের মধ্যে ভাগ করে দেন।

-আমরা অবশ্য দাদু মারা যাবার পর কিছুদিনের ভেতর ফলের বাগান ছাড়া বাকি সবকিছু বিক্রি করে দিই। এবারে অজয়বাবু বললেন। - আসলে নিজেদের ব্যবসা সামলে অতকিছু দেখাশোনা সম্ভব হচ্ছিল না।

-ঠিক আছে । রজতবাবু আলোচোনায় ইতি টানার সুরে বললেন। - আমার যা জানার ছিল মোটের ওপর জানা হয়ে গেছে। তবে বাড়িটা একবার দেখতে চাই। কাল রবিবার, ছুটির দিন। সম্ভব হলে বিজয়বাবুও যদি সঙ্গে যান তাহলে খুব ভাল হয়।

সুজয়বাবু তার দাদার যাবার ব্যাপারে একটু আপত্তি করতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু বিজয়বাবু নিজেই দৃঢ় ভাবে বললেন যে তিনি যাবেনই।

-তাহলে সেটাই ঠিক কারা যাক। - অজয়বাবু বললেন। - আমি কাল সকালের দিকেই দাদাদের নিয়ে আপনাকে ভবানীপুর থেকে তুলে নিয়ে বারুইপুর হয়ে ক্যানিং এর রাস্তায় বেরিয়ে যাব।

-আমি বরং আলাদা একটা গাড়ি ভাড়া করে নেব। একটু ইতস্তত করে জানালেন রজতবাবু। - আসলে এই ধরণের তদন্তের সময় আমার দুজন ছাত্র আমার সঙ্গে থাকে। ওদেরও আমি ডেকে নেব। ফলে একটা গাড়িতে এমনিতেই হবেনা। আর সুগতবাবুও আছেন-

সুগত বাগচি বাধা দিয়ে বললেন – আমি যাব না। একে তো এটা পুলিশী তদন্তের বিষয় নয়। তা ছাড়াও জায়গাটা আমার এলাকার বাইরে।

-বেশ, তাহলে আপনাকে ধরছিনা। রজতবাবু বললেন। - আমি আর আমার দুই ছাত্র ভাড়ার গাড়ি নিয়ে সকাল নটার ভেতর সায়েন্স সিটির উলটো দিকে, বাসন্তী হাইওয়ের সামনে পৌঁছে যাব। ওখান থেকে দুটো গাড়ি একসঙ্গে যাবে। এ প্রস্তাবে সকলে একমত। তবে বিজয়বাবু এরই মধ্যে বললেন এ বাবদে যা খরচ হবে তা তিনিই দেবেন। রজতবাবু মৃদু আপত্তি করেছিলেন। -আসলে এধরণের অনুসন্ধানের কাজতো আমি নিজের আগ্রহেই করে থাকি। কিন্তু বিজয়বাবু ও তার ভাইদের অনুরোধে তাকে রাজি হতেই হল।


রজতবাবুকে প্রিপেড অ্যাপ ক্যাবে তুলে দিতে এসে সুগত বাগচি প্রশ্ন করলেন – ব্যাপারটা কিরকম বুঝলেন মিস্টার রায়?

-সময়ের হিসেবটা যেন ঠিক মিলছেনা। অন্যমনস্ক ভাবে বললেন রজত রায়। - তাছাড়াও কয়েকটা বিষয় ঠিক পরিষ্কার হচ্ছেনা। ওখানে গিয়ে দেখি, কোনো ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া যায় কিনা।

সংক্ষিপ্ত কিছু আলোচোনার পর রওনা হলেন রজতবাবু।



চলবে...


----------------------------------------------------------------    

এই ধারাবাহিক রহস্য উপন্যাসটি ধারাবাহিক ভাবে প্রতি বৃহস্পতিবার অঙ্কুরীশা-র পাতায় প্রকাশিত হয়। পড়ুম ও মতামত জানান। 


ankurishapatrika@gmail. com


----------------------------------------------------------------------                 



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন