ধারাবাহিক রহস্য উপন্যাস (পর্ব-৭)
অষ্টভুজ রহস্য
অলোক চট্টোপাধ্যায়
বাসন্তী হাইওয়ে দিয়ে ছুটন্ত গাড়িতে বসে বিজয়বাবুর মুখ থেকে পুরো কাহিনীটা শুনছিল পলাশ আর কুনাল। গতকালই ফোন করে তাদের সকাল বেলাতেই আসতে বলে দিয়েছিলেন তাদের রজত স্যার। তারা দুজনেই প্রথমে ঘটনাচক্রে এবং পরে প্রায় নিয়ম করেই রজতস্যারের অলৌকিক রহস্য সন্ধানের কেসগুলোতে তার সঙ্গে থাকে। এবারেও তারা বাদ পড়েনি।
গাড়ির পেছনের সীটে তাদের দুজনের সঙ্গে বিজয়বাবুও রয়েছেন। সামনের সীটে রজতস্যার। গাড়ি চালাচ্ছে একমুখ দাড়িওয়ালা কমবয়সী এক শিখ ড্রাইভার। নাম রাজিন্দার। অবাঙালী হলে কি হবে, খুব চমৎকার বাংলা বলে।
সামনে সামনে চলেছে সুজয়বাবুদের গাঢ় মেরুণ রঙের সিডান। ওদের ড্রাইভার নীলমনি। সায়েন্স সিটির মোড়ে সুজয়বাবুদের সঙ্গে দেখা হবার পর রজতবাবু বিজয়বাবুকে অনুরোধ করেছিলেন তাদের গাড়িতে আসার জন্যে। যাতে পলাশ আর কুনাল ওনার মুখ থেকেই পুরো ঘটনাটা শুনতে পারে। বিজয়বাবু মনে হয় একটু অখুশি হয়েছিলেন, বারবার এই ঘটনাটা নানা লোকের কাছে বলতে বলতে তিনি নিশ্চয়ই বিরক্ত, তবে রজতবাবুর কথা ফেলতে পারেননি। চলন্ত গাড়িতে যথাসাধ্য গুছিয়ে পুরোটা বলেছেন ওদের।
-তোদের কোনো প্রশ্ন থাকলে জিগ্যেস করতে পারিস। সামনের সীট থেকে ঘাড় ঘুরিয়ে বললেন রজতস্যার। প্রশ্ন তো অনেক, কিন্তু সেসব কথা শুরু করার আগেই সামনের গাড়িটা থেমে গেল। নীলমনি নামল গাড়ি থেকে। রজতবাবুও নামলেন, কি ভেবে ডেকে নিলেন রাজিন্দারকেও। রাস্তার ধারের দোকানের সাইনবোর্ডের লেখা দেখে পলাশ জানাল জায়গাটার নাম বড়গাছা। আগের দিন বিজয়বাবুর গাড়িটা এখানেই খারাপ হয়েছিল। ওরা আন্দাজ করে নিল গাড়ি সারানোর দোকানে গিয়ে স্যার খোঁজ নেবেন সে দিন গাড়িটাতে কি ধরণের গন্ডগোল হয়েছিল। রাজিন্দারকে ডেকে নিয়েছেন সেই জন্যেই।
ঠিক তাই। একটা অটো রিপেয়ারিং এর দোকানে কিছুক্ষন কথাবার্তা বলে ফিরে এলেন দুজনে। গাড়ি চালু করতে করতে রাজিন্দার বলল – ঠিকই বলেছে স্যার। গাড়ি ঠান্ডা করে ফ্যানবেল্ট বদলাতে একদেড় ঘন্টা সময় তো লাগবেই। তবে সেটা ওর শুরুতেই বলে দেওয়া উচিত ছিল। গাড়ি আবার চলল। রজতবাবু একবার হাতঘড়ির ওপর চোখ বুলিয়ে নিলেন। দেখাদেখি পলাশ আর কুনালও। এখান থেকে ওদের গন্তব্যে পৌঁছোতে কত সময় লাগে সেটা জানা দরকার।
এই রাস্তাটা বাসন্তী হাইওয়ে নয়, সেটা অনেকটা ঘুরে ক্যানিং যায়।এটা তার মাঝামাঝি ডানহাতি একটা শর্টকাট রাস্তা। ওই হাইওয়েতেই আবার মিলল আটঘরা বলে একটা জায়গার কাছে। ডানহাতে ক্যানিং এর রাস্তা ছাড়িয়ে একটু বাদেই বাঁ দিকে ঘুরল সামনের গাড়ি। বিজয়বাবু বললেন সামনেই জয়চন্দ্রপুর। অপেক্ষাকৃত সরু পথ, অধিকাংশ জায়গায় পিচ উঠে খোয়া বেরিয়ে গেছে। বলা বাহুল্য দূটো গাড়ির গতিই অর্ধেক হয়ে গেল। জয়চন্দ্রপুর এল বড়গাছা ছাড়াবার ঠিক পঞ্চাশ মিনিট পর। সেখান থেকেই খুব উৎসাহভরে পথের বিবরণ দিতে লাগলেন বিজয়বাবু। ফুলবেড়িয়ায় নিজের স্কুলের গলিটা দেখালেন, আগের দিন যেটা চিনতে পারেননি। বাঁ দিকে একটা সরু মাটির রাস্তা দেখিয়ে বললেন সেটাই সম্ভবত পুরোনো কাঠের পুলের পথ। কোন কোন জায়গায় ওনার দাদুর তেলের মিল ছিল, দোকান ছিল সেসব আন্দাজে বোঝানোর চেষ্টাও করলেন।
ফুলবেড়িয়া পেরিয়ে আরো আধ কিলোমিটার গিয়ে রাস্তা বাঁক নিয়েছে বাঁ দিকে। একটা কংক্রীটের ব্রীজ, বিজয়বাবু বললেন এর নিচে বিদ্যাধরী নদির খাল। আরো কিছুটা এগিয়ে এলো বাবুবাজার। গাড়ি আবার ঘুরল বাঁ দিকে। এবারে গ্রামের পথ। সামনের গাড়ি চলেছে ধুলো উড়িয়ে। সেটা এড়াতে একটু পিছিয়েই চলেছে রাজিন্দারের গাড়ি। দুপাশে চাষের জমি, একটু দূরে দূরে উঁচু মাটির পাড় দেখা যাচ্ছে। বিজয়বাবু বললেন ওগুলো হল মাছের ভেড়ি। সামনেই কদমফুলি গ্রাম।
কদমফুলিতে ঢোকার পর আঁকাবাঁকা মাটির পথ। পরপর কয়েকটা বাঁক নিল সামনের গাড়িটা। রাজিন্দার বলল – বোধহয় কোনো একটা টার্ণ মিস করেছে। গোলগোল ঘুরছে গাড়িটা।
বলতে বলতেই আবার বাঁ দিকে ঘুরল সামনের গাড়ি। এই টার্ণটা ইংরেজি ইউএর মত। ওদের গাড়ি ঘোরাতে ঘোরাতে বিজয়বাবু বলে উঠলেন – আরে পেছনের সোজা পথটাই তো পুরোনো কাঠের পুলের রাস্তা। আগের দিন অন্ধকারে খেয়ালই করতে পারিনি। এইতো ডানদিকেই পড়বে বাড়িটা। পলাশ কুনাল তাকিয়ে দেখল পথের বাঁদিকে বিস্তীর্ণ ধান ক্ষেত আর ডান দিকে বড় বড় গাছপালা, তার নিচে আগাছার জঙ্গল। কয়েকটা খাপরার চাল দেওয়া দোকান ঘর ছাড়া আর কোনো বাড়িঘর দেখা যাচ্ছেনা।
বলতে বলতে সামনের গাড়ি দাঁড়িয়ে গেল। পেছনে দাঁড়িয়ে পড়ল রাজিন্দারের গাড়িও। তারা গন্তব্যে পৌঁছে গেছে। সকলে নেমে পড়ল। ডানহাতে একটা ঝোপঝাড়ে ঢাকা পথ। যথেষ্ট চওড়া, কিন্তু সেখানে গাড়ি ঢুকবে না। বোঝাই যায় অনেক কাল লোকজন চলাফেরা না করায় প্রকৃতি সেটাকে নিজের দখলে নিয়েছেন। রাস্তা থেকেই দেখা যাচ্ছে একটু ভেতরে ঢুকেই ভেঙে পড়া থামের গায়ে ঝুলে আছে লোহার গ্রিলের গেট। রজতস্যারের দৃষ্টি অনুসরণ করে পলাশ আর কুনাল বিজয়বাবুর দিকে দেখল । ভদ্রলোকের চোখেমুখে একটা বিহ্বল ভাব। ওদের সঙ্গে চোখাচোখি হতে অপ্রস্তুত গলায় বললেন – বিশ্বাস করুন মিস্টার রায়, সেদিন আমি কিন্তু এরকম দেখিনি -।
রজতবাবুর ইশারায় সুজয়বাবু আর অজয়বাবু তাদের দাদার পাশে দাঁড়াল। অজয়বাবু বললেন – চল দাদা, ভেতরে যাওয়া যাক। সবাই এগোলো ভেতরের দিকে।
গেট পেরিয়ে ভেতরেও সেই আগাছা সংকুল পথ।তবে বোঝা যায় একসময়ে এখানে নুড়ি বিছোনো রাস্তা ছিল। সামনেই সেই আটকোনা বাইরের ঘর যার নাম এরা রেখেছিলেন অষ্টভুজ। সামনে উঁচু রোয়াক। চারধাপ সিঁড়ি চড়ে ওপরে উঠে অজয়বাবু হাত করে খুলে দিলেন সামনের দরজাটা। পায়ে পায়ে ভেতরে ঢুকলেন সকলে। বিরাট ঘর। লম্বায় তিরিশ ফুট হবে, চওড়াতেও কুড়িফুটের কম নয়। মনেমনে হিসেব করল কুনাল। একটা আয়তাকার ঘরের চারটে কোনকে যেন চারটে দেওয়াল তুলে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। ফলে প্রতিটি কোনের জায়গায় তৈরি হয়েছে দুটো করে কোন। মোট আটটা কোন। দেওয়ালের সংখ্যাও তাই চারের জায়গায় আট। সামনের দরজার ঠিক মুখোমুখি আর একটি দরজা,ভেতরের দিকে যাবার জন্য। ঘরের অবস্থা শোচনীয়। দেওয়ালের প্লাস্টার খসে পড়েছে সর্বত্র। ভেঙে পড়েছে একদিকের ছাতের কিছু অংশ। ধুলো আর ঝুলে ভরে আছে চারদিক। ফুটিফাটা মেঝের ওপর ইতস্তত ছড়িয়ে রয়েছে ভাঙা ফার্ণিচারের অবশেষ। দুটো বড় বড় কাঠের আলমারি পাল্লা খোলা অবস্থায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। ঘরের বাইরের দিকের দেওয়ালে চারটে পুরোনো ধাঁচের শিক লাগানো বড় জানলা। সবকটারই পাল্লা ভাঙা, ঝুলে পড়া। শিকগুলোও সব নেই।বাইরের দরজা দিয়ে ঢুকেই ডানদিকের দেওয়াল ঘেঁষে একটা ইজিচেয়ারের কাঠামো, অজয়বাবু রজতবাবুকে জানালেন ঐখানেই পড়েছিলেন তার দাদা।
ঠিক উল্টোদিকের দেওয়ালে ব্যাঁকাভাবে ঝুলে আছে মোটা ফ্রেমে বাঁধানো গণেশজননীর মস্ত প্রিন্ট। ধুলিধুসর অবস্থা। সেটার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে দেখছিলেন রজতবাবু। কুণাল আর পলাশকে ডেকে বললেন – ছবিটা ভাল করে দ্যাখ। খুব নাম করা পেন্টিং।
ওরা দাঁড়িয়ে পড়ল ছবিটার সামনে। রজতবাবু বললেন – বাড়ির ভেতরটাও একবার দেখব। সুজয়বাবু জানালেন সেটা বাইরে গিয়েই দেখতে হবে। এদিকে একটা দেওয়াল পড়ে গিয়ে ভেতরের প্যাসেজটা পুরোটাই বন্ধ হয়ে গেছে।
ঘরের ভেতরে কেমন যেন একটা অস্বস্তিকর আবহাওয়া। বিজয়বাবু একেবারে নিশ্চুপ। অজয়বাবু বললেন - চলুন আমরা বাইরে দিয়ে বাড়িটার পেছন দিকে যাই। সকলে বাইরে বেরিয়ে এসে খোলা হাওয়ায় যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। ডানদিকের আগাছার জঙ্গল ভেদ করে পুরো দলটা রওনা হল বাড়ির পেছনের দিকে। সবচেয়ে আগে নীলমনি একটা ভাঙা গাছের ডাল ঠুকতে ঠুকতে এগোলো। এখনো ঠান্ডা পড়েনি, সাপখোপ থাকতেই পারে। লাঠির শব্দে সরে যাবে। রজতবাবুও একটা ডাল কুড়িয়ে জিগ্যেস করলেন – সাপ তাড়াবার জন্য কোনো কেমিক্যাল দেওয়া হয়না? উত্তরে হেসে ফেললেন অজয়বাবু। -এখানে কেউ থাকেও না আর ঘুরতেও আসেনা। সাপ তাড়াবার দরকারটা কি?
-ঘরের ভেতর একটা অদ্ভুত গন্ধ পেয়েছিস? পলাশের একদম কাছে এসে রজতবাবু বললেন। - পেয়েছি স্যার। খুব হালকা, অনেকটা মিষ্টি আচারের মত। কিসের গন্ধ স্যার? সুজয়বাবু ওদের দিকে এগিয়ে আসছিলেন। - পরে বলছি। স্যার সরে গেলেন।
ওরা ততক্ষনে বাড়ির পাশের দিকটায় পৌঁছে গেছে। ভেতরের অংশটা বেশ বড়। দোতলা, তবে একটা দিক পুরোই ভেঙে গেছে। দরজা জানলা কিছুই আস্ত নেই দেওয়াল ফাটিয়ে গজিয়ে উঠেছে বড় বড় গাছ। - ঠিক সিনেমায় দেখানো ভুতের বাড়ি। কুণাল বলল পলাশকে। দুজনে সেই ধ্বংসস্তুপের ভেতর ঢোকার জন্যে এগোচ্ছিল, নীলমনি বারণ করল। - ওদিকে যেওনা দাদাবাবুরা। সাপ বিছে কত কি আছে।
(চলবে...)
-
----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
এই ধারাবাহিক রহস্য উপন্যাসটি প্রতি বৃহস্পতিবার পড়ুন ও পড়ান। মতামত জানান।
ankurishapatrika@gmal.com
---------------------------------------------------------------------------------

কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন