শনিবারের
গল্প
রাবণ - বিলাপ
জ্যোতির্ময় দাশ
রাবণ বেশ ক্ষোভের সঙ্গে বলল, “তোমাদের বাল্মীকি সুবিধের লোক নয়, আমার সঙ্গে অন্যায় আচরণ করেছে।”
দশাননের বিপুল মাথার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করি, “কী ভাবে?”
লঙ্কেশ্বর জানাল, “আমাকে রামায়ণে অকারণে ভিলেন হিসেবে সাজিয়েছে!”
আমি বললাম, “অন্যের স্ত্রীর অপহরণকারীকে আর কী করা যেতে পারত?”
রক্ষোরাজ দশমুখে প্রবল গর্জন করে উঠল, “অপহরণের কথায় পরে আসছি। গতজন্মে আমি পরম নারায়ণভক্ত সৎ ব্রাহ্মণ ছিলাম। আমাকে রাক্ষস বানানোর কী ছিল? তবু রাক্ষস হয়তো মেনে নেওয়া যায়, কিন্তু এই কিম্ভূতকিমাকার চেহারা দেবার কী দরকার ছিল? দশটা মাথায় দশটা মুখ, কুড়িটা চোখ আর কুড়িটা হাত! কিন্তু জঠর একটা। আর এর জন্যে কী জটিল সমস্যা হয়েছে সেটা তোমরা ভাবতেও পারবে না। এই বয়সে বেশি খাওয়া সহ্য হয় না। সকালে ব্রেকফাস্টে দুপিস বাটার-টোস্ট নিয়ে বসলে দশটা ক্ষুধার্ত মুখ হা-হা করে আসে। তাদের কাকে ছেড়ে কাকে আমি তৃপ্ত করবো? আর এই সমস্যাটা ৩৬৫ দিন চারবেলা হয়!”
এতদিন রামায়ণের এত ইন্টারপ্রিটেশান শুনেছি কিন্তু এভাবে কেউ ভেবেছে কিনা জানি না।
রাক্ষসেন্দ্র আবার বলল, “সবচেয়ে বেদনার কী জানো? আমি কোনদিন একক কন্ঠে গান পর্যন্ত গাইতে পারি না। সবসময় দশ মুখে কোরাস গাইতে হয়। নটা মুখের কন্ঠরোধ করে একটা মুখকে প্রাধান্য দিলে সংবিধানের গণতান্ত্রিক অধিকারের অবমাননা করা হয়। আর সেটা তো তোমাদের জরুরি অবস্থায় দমননীতির অন্যায় আচরণ হয়ে দাঁড়ায়।“
আমি লজ্জায় মাথা নীচু করি - ইমারজেন্সি আমাদের রাজনৈতিক মনস্কতার এক ঐতিহাসিক অপকর্ম। ভারতের এক কলঙ্কময় অধ্যায়।
দশমুন্ড কুন্ঠিতভাবে এবার বলল, “জনান্তিকে তোমাকে আর একটা কথা বলি! কখনো প্রেমের আবেগে আমার একমাত্র স্ত্রীকে চুম্বন করতে ইচ্ছে হলে, আমার দশটি মুখ তার বিম্বাধর ওষ্ঠের মধু পান করতে উদ্গ্রীব হয়ে ওঠে। দশমুখে একটি রমণীকে, সে নিজের আইনত স্ত্রী হলেও, চুম্বন করলে সেটাকে তো আর প্রেম নিবেদন বলা যাবে না, সেটা শ্লীলতাহানির পর্যায়ে দাঁড়ায়! ফলে আমি একান্তে মন্দোদরীকে একটা প্রেমাসক্ত চুম্বন পর্যন্ত করতে পারলাম না আজীবন। আমি কী ভাবে বেঁচেছিলাম ভাবতে পারো?”
আমি মুখে কিছুই বললাম না, কিন্তু মনে মনে ভাবলাম এ বেদনা আপামর বিশ্বের সকলের – কেউ নিজস্ব বৃত্তে তৃপ্ত নয়! কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়েরও এই দুঃখ ছিল!
লঙ্কাপতি এবার জানালো, “এই প্রচন্ড হতাশা আর অবসাদ থেকে বেরিয়ে আসার জন্যেই আমি সীতাকে হরণ করতে চেয়েছিলাম, শূর্পনখার নাক তো নিমিত্তমাত্র। ডাকাত বাল্মীকি যেখানে আমাকে ভিলেন বানিয়েছে, সেখানে তোমাদের মধুকবি আমাকে নায়কের সম্মান দিয়েছে। তাকে আমি শ্রদ্ধা করি। আমি চললাম তার সঙ্গে দেখা করতে।“
আমাকে হতবাক্ করে রাবণ উদাসীন মুখে নন্দন-চত্বর থেকে বেরিয়ে গেল পার্ক স্ট্রিটের সমাধিক্ষেত্রের দিকে।
Satire dhoroner rommo lekha.besh bhalo laglo
উত্তরমুছুনখুব ভালো লাগল। কনসেপ্ট টা বেশ ইন্টারেস্টিং। উপন্যাসের মশলা আছে
উত্তরমুছুনবেশ ভালোই। লেখক একটু অন্যরকম ভাবে ভেবেছেন। রাবণের মুখে যে কথাগুলো বসানো হয়েছে, তা থেকে লেখকের ভাবনা-চিন্তার পরিসর যে বিস্তৃত তা বেশ বোঝা যায়। সবথেকে ভালো লেগেছে লাইনগুলোর মধ্যে থেকে তাঁর রসবোধ প্রায়ই উঁকিঝুঁকি মেরে গেছে। জ্যোতির্ময়বাবুকে ধন্যবাদ।
উত্তরমুছুন