অমর একুশে অঙ্কুরীশা-র কবিতায় শ্রদ্ধাঞ্জলি
সম্পাদকীয়—
"আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারি’'—আজ সেই মহান একুশে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। বাঙালি জীবনে একুশে ফিরে ফিরে আসে নবজীবনের ডাক নিয়ে। মহান একুশে আজ শুধু শহীদ দিবসই নয়। জাতিসংঘের ইউনেস্কোর স্বীকৃতির মাধ্যমে দিনটি এখন বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবেও পালন করা হয়। ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারিতেই দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের পথ ধরে সালাম, বরকত, রফিক,সফিক জব্বার তাদের বুকের তাজা রক্ত দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার।আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের চেতনাই হচ্ছে কোনো জনগোষ্ঠীর ভাষাই হারিয়ে যেতে দেওয়া যাবে না। আর এ দায়িত্ব শুধু বাঙালির নয়, পৃথিবীর সকল মানুষের। আমরা যেন শুধু আবেগতাড়িত হয়ে অমর একুশের কথা না বলি। ভাষা আন্দোলনের চেতনা তখনই সার্থক হবে যখন প্রত্যেক জনগোষ্ঠী তার নিজের মাতৃভাষায় কথা বলতে পারবে।শিক্ষা লাভ করতে পারবে। শিল্প-সাহিত্য সৃষ্টি করতে পারবে। তবেই সার্থক হবে একুশ। এবারের একুশ এই বোধ জেগে উঠুক সকলের মধ্যে-এটাই প্রত্যাশা রেখে অঙ্কুরীশা-র কবিতা সংকলনের এই বিশেষ সংখ্যায় যাঁরা কলম ধরেছেন তাঁদের সবাইকে হার্দিক অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জানাই।
মাতৃভাষা
রবিন বণিক
ফেলে দিয়ে গেছে–
যেভাবে ফেলে দিয়ে যায় অবৈধ
মস্তিষ্কের ভেতর আপাতত কোনো
কোনো ডাকনাম নেই, শরীর ঘেঁ
ছুঁড়ে দেওয়া সম্পর্কের মত খুঁ
বিবর্তিত পিতার মত হাতে পা
ফুটপাত তাদের ভাষা,
যেভাবে তাকিয়ে থাকে শরীর অন্য কোনো ভাষায়
সেভাবে তাকিয়ে আছে পথিকের ঠোঁ
ভাষা পাখি
মঙ্গলপ্রসাদ মাইতি
রাত পোহালো-একুশ এল
ভাষার পাখি গাইল গান
শিশির মেখে বাংলাভাষা
করছে যেন মুক্তিস্নান।
প্রাণের ভাষা বুকের ভাষা
প্রিয় আমার বাংলাভাষা
আকাশ ছুঁয়ে যায় এগিয়ে
ছড়িয়ে দিতে ভালোবাসা।
যন্ত্রণা সে সয়েছে কত
তবুও মাথা করেনি নত
ডানায় লেগে রক্ত আবির
শুকোয়নি তার সেই ক্ষত।
মায়ের ভাষার মান বাঁচাতে
সফি জব্বার দিল প্রাণ
রফিক সালাম শহিদ হল
বাংলাভাষার এমন টান।
হার না মানা লড়াই তাদের
নিয়ে এল জয়ের ভোর
হৃদয়মাঝে আসবে তারা
তাইতো খুলে রেখেছি দোর।
জননীচরিত
তাজিমুর রহমান
বর্ণমালার ভেদশক্তি কতটা বিনীত হলে
তুমি ভাঙতে পারো লালার প্রাচীর!
শুধু জেনো,শিয়রে বসে থাকা চাঁদ একান্তে ডাক দিলে
মায়ের হাতের চুড়ির শব্দ ব্রহ্ম হয়ে যায়
আর ভোরের আজানে বেজে ওঠা ধ্বনি
দ্বার্থক ভাষায় উঠোন জাগালে
ভূখন্ড জুড়ে অনন্তের গান, তখন মিঠে আলোয়
খেলা করে বর্ণপরিচয়, আর সবুজ ঘাসের ডগায়
দোল খায় মায়ের কণ্ঠলালিত ফসল
বাহান্ন,মে মাস তখন আমাদের জননীচরিত ছেড়ে আন্তর্জাতিকতার সংলাপ বুনে দেয়…
ভাষা মানে রক্তের উচ্চারণে শহীদের ঋণ ভাষা মানে বীরদর্পে পাএকুশের সকাল
ভাষা মানে ছিন্ন শিকড়ের নির্বাক কান্না
ভাষা মানে স্বজন হারানো অবুঝ দিন। ভাষা মানে প্রথম অক্ষর প্রথম পাঠক
ভাষা মানে স্কুল দুপুরে এক মুঠো ভাত
ভাষা মানে শিশুর মুখে প্রথম শব্দ কথা ভাষা মানে দেশমাতা ভালবাসার স্মারক।
তস্য ভাষা সর্বমিদং বিভাতি
সুবীর ঘোষ
যাবতীয় প্রাণী তার স্বজাতির ভাষা বোঝে---
ভাষা যেথা ধ্বনিরই অন্য নাম।
মানুষ বোঝে না শুধু স্বজনের ভাষা;
প্রিয় ধ্বনির জন্য তার কান্না বিরল।
মানুষ বোঝে না শুধু শৃঙ্খলিত থাকা কত প্রয়োজন,
শৃঙ্খল মানে তো শুধু কারাবেড়ি নয়।
শৃঙ্খল শৃঙ্খলা আনে, তাকে তার গোষ্ঠীর উপযোগী করে।
ভাষা দেয় সেই শৃঙ্খলা যাতে তার অধিকার ফোটে;
মাতৃভাষাটি তার দাবি বটে, অপরিহার্য প্রাপ্যও নিশ্চয়।
ভাষা তার চেতনা জাগ্রত করে, ভাষা তাকে নিশানদিহিতে গাঁথে।
ভাষার ওপরে নামে শাসকের তীব্র চাবুক বারবার,
যেমন আমরা দেখি একুশে ফেব্রুয়ারি বা মে মাসের উনিশে ---
একদা কী শ্বাসরোধী আক্রমণ শানিয়েছিল শাসকের পাল!
উদ্ধত নিপীড়ক জানে না ভাষা অবধ্য, ভাষা যেন দধীচির হাড়।
পাখির কুজনে আর নদীর প্রবাহে থাকে মানুষের ভাষা ---
মানুষ আদর করে ভাষাকে সংগীত করে কণ্ঠে ধরে রাখে।
একুশের ঘরবাড়ী
বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়
যে ভাষায় মা বলে ডেকেছি প্রথম
সেই ভাষা আমার ঘরবাড়ি
কান্না পেলে কীভাবে জানাবো বলো?
বেদনাপর্বের নীচে শুয়ে থাকে অশ্রুর অক্ষর,
সঞ্চিত কষ্টের গায়ে অনুতাপ লেখা
মনখারাপ এবং বিষাদ লিপি হাহাকার যা শুধু আমারই।
যে ভাষায় বাল্যকাল লিখি
নৌকা ভাসিয়ে দিই নদীজলে যে ভাষায় দুরন্ত আবেগ
ভেসে ভেসে স্মৃতিগুলি চলে যায় কিনারার দিকে
বৃষ্টি জমে আমার আকাশে জমে ওঠে কত কথামেঘ
প্রেমপত্র লিখে ফেলা আপন শব্দেরা
জানে এই ঘরবাড়ি আমার একুশ
নিজস্ব মুক্তির জন্য আমরা শহীদ হই
প্রতিদিন শব্দে শব্দে চিন্তার বিপ্লব ।
নিজস্ব মাটির জন্য নিজস্ব ভাষার জন্য
গড়ে তুলি বাসগৃহ এবং নতুন কলরব।
একুশের শপথ
জগদীশ মন্ডল
ফাগুন এলে একুশ আসে
আর আসে জব্বার,
রফিক,সালাম,বরকত ভাই
ডেকে যায় বারবার।
স্মরণ করে লক্ষ মানুষ
শহীদ বেদির পাশে,
চোখের মাঝে বীরের ছবি
ঘুরে ফিরে আসে।
একুশ এলে সাদা ফুলে
গাঁথা হাজার মালা,
মাতৃভাষা মায়ের কোলে
মুক্ত মশাল জ্বালা।
একুশ আমার প্রানের কথা
সহজ সরল মুখ,
ভাষা দিবস আমার কাছে
গর্বে ভরা বুক।
একুশ আসে চোখে ভাসে
রক্তে ভেজা ঋণ,
মাতৃভাষা রক্ষা করার
শপথ নেওয়ার দিন।
বাংলার বোধোদয়
সৈকত নায়েক
বাংলার পরাণজুড়ে লালন
সহজিয়া লালন
মাধুকরী প্রব্রজ্যায়
ধরে রেখেছে রমলার ময়দান
কুষ্টিয়ার মাটি ছুঁয়ে যে দাগ লেগেছে
ঢাকার পল্টন শহরে
অক্ষরে শব্দে আজ
ফুলমালা ধূপের শয্যায়
ঈশ্বর হয়ে ওঠেন বোধদয়ের গতিলিপি।
মাতৃভাষা
অশোক রায়
শত জন্মে তোমায় পেয়েছি সুতমা
বাঙ্ময়-রূপ নদীর আকর
মাতৃজঠরেই হয়েছিল পরিচয়
শিশু হতে কিশোরী ছন্দঝর্ণা
মস্তিষ্ক বেয়ে কলম পুর্ণযৌবনা
পুণ্যসলিলা ধায় সাগর-সঙ্গমে
গভীর উপলব্ধির সোনালি চর
তোমার আগ্রহে ভেসে চলি
সীমাহীন দুঃখহীন অন্তরঙ্গতায়
প্রিয়তম শহীদের রক্তে রাঙা
শ্রেষ্ঠ ভাষার শিরোপা তব অলঙ্কার
লেখা-পড়ার অবসর তোমাতেই সাকার ।।
বাংলা ভাষা
রঞ্জন ভট্টাচার্য
বাংলা আমার প্রাণের ভাষা
হৃদয়ের বন্ধন
বাংলা আমার চোখের মনি
হৃদয়ের কাঞ্চন ।
বাংলা আমার জীবন আলো
ঘুচায় অন্ধকার
নিত্য দিনের চলার পথে
শুধুই যে দরকার ।
বাংলা জানি বাংলা মানি
বাংলা আমার ধন
বাঙালি আর বাংলা ভাষা
আমার আপনজন।
ভাষা
তপনজ্যোতি মাজি
নদীর স্রোতের মতো সাবলীল মাতৃভাষা।
হৃদয় বিলক্ষণ বোঝে প্রতিটি বুদবুদে
চির প্রনম্য অক্ষরের স্পন্দন।
ভাষা-পথ ইতিহাস বুকে নিয়ে প্রসারিত
দুই বাংলার শ্যাম প্রান্তরে।
সহস্র বৃক্ষের মাঝে বনস্পতি দাঁড়িয়ে আছেন
রবীন্দ্রনাথ , নজরুল ও জীবনানন্দ দাশ।
ভালবাসা ও প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত মাতৃভাষার
অধিকার স্বাধীনতার পূর্বআখ্যান।
দ্যাখো, রক্তের দাগ স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণমালায়।
ভাষা শহীদদের হাড়ের পাঁজরে গড়া ভাষা-স্মারকের
সামনে দাঁড়িয়ে উদাত্ত সংগীতে আকাশ আলোড়িত
করার অন্যনাম একুশে ফেব্রুয়ারী।
ভুলিনি তোমাদের। আবুল বরকত, আব্দুল জব্বার,
রফিক উদ্দিন, আব্দুস সালাম,শফিউর রহমান,
অহিউল্লাহ, আব্দুল আউয়াল । তোমারা নক্ষত্র
হয়ে আছো দুই বাংলার আকাশে।
হে প্রিয়
বিশ্বজিৎ রায়
শিশুস্বর’ ডাকে ‘মা , পাখিস্বর ডাকে ‘ কুহু ‘
ধানের শিষে হাসে ‘ধা’ , উতসবে বাজে বিহু
নদ-নদী ভেসে চলে ছন্দে ছন্দে ফেলে ‘পা’
ঝর্ণা-ঝোরা কথা বলে ছুটতে ছুটতে ‘গা’
এসব তোমারই দান, হে প্রিয় বাংলাভাষা
আমৃত্যু তোমার সঙ্গে থাকবে ভালোবাসা
অনেক দিয়েছো পদ্য অনেক দিয়ে
অনেক দেখেছো রক্ত অনেক গুনেছো প্রাণ
দিয়েছো ভাষার দেশ, করেছো ভাষার জয়
সারা পৃথিবীতে তুমি আশ্চর্য ভাষাময়
থাকবে শহিদের নাম, থাকবে শিলচর-ঢাকা --
সেদিনের রক্তচিহ্ন ইতিহাসে আছে আঁকা …
বাংলা হরফে সাজাবো আকাশ
বাংলা হরফে সাজাবো আকাশ,
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন