স্বাধীনতার ৭৫
মুক্ত গদ্য -১৩
জন্মগত অধিকারের স্বাধীনতা
সামসুজ জামান
"স্বরাজ আমার জন্মগত অধিকার"- মহামান্য বালগঙ্গাধর তিলকের এই উক্তি নিঃসন্দেহে প্রতিটা ভারতবাসীর চেতনাবোধকে অনেক বেশি জাগ্রত করেছে। এদিকে আমাদের যন্ত্রণাদগ্ধ কবি নজরুল লিখেছিলেন -"ওই গঙ্গায় ডুবিয়াছে হায় ভারতের দিবাকর / উদিবে সে রবি আমাদেরই খুনে রাঙিয়া পুনর্বার!" এমন সব উদ্দীপনা মূলক প্রেরণা থেকে আমাদের পূর্বপুরুষগন মাতোয়ারা হয়ে উঠেছিলেন স্বাধীনতা প্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষায়। তারপর স্বাধীনতার সৈনিকদের অবিস্মরণীয় আত্মবলিদান পর্বের বিনিময়ে আমরা ফিরে পেয়েছি আমাদের স্বপ্নের সেই স্বাধীনতা। আমাদের দুর্ভাগ্য যে স্বাধীনতার সেই দুর্দমনীয় আন্দোলনের দিনগুলোকে দেখার সৌভাগ্য আমাদের হয়নি। বাবা ছিলেন একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী। তাই আমাদের বাল্যাবস্থায় যখন তাঁর মুখে সেই আন্দোলনের দিনগুলোর কথা শুনতাম আর প্রতিবছর নিয়মিতভাবে বাড়িতে স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলনের ছবি দেখতাম তখন খুব আফসোস হতো যে কেন আমরা বেশ কয়েক বছর আগে এই পৃথিবীতে আসিনি? তাহলে তো অন্তত এই আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার একটা সুযোগ আসতো! তবে সেই দিনগুলোর কথা শুনতে শুনতে মনের মধ্যে অফুরন্ত উৎসাহ আর উদ্দীপনা জেগে উঠতো আর মনে মনে ভাবতাম আমরা আন্দোলনে জড়িত হইনি তবে আমাদের পিতা তো অন্তত জড়িত হয়েছিলেন। কিছুটা আত্মতৃপ্তি অন্তত পেতাম অনেকটা দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর মত অবস্থায়।
কিন্তু পরবর্তীতে যখন আরেকটু বড় হয়েছি এবং একশ্রেণীর মানুষের মুখে শুনতাম "ইয়ে আজাদী ঝুটা হ্যায়", তখন কথাটাকে দুর্বিষহ বলে মনে হতো। আন্দোলনের কক্ষপথে না থেকে অমন ফানুসের মত অনেক কথাই দূর থেকে বলা যায় কিন্তু প্রকৃত সমস্যার সমাধান করতে কোমর বেঁধে নামলে তখন টের পাওয়া যায় কাজটা কতটা দুরুহ। স্বাধীনতাটা কোন মুড়ি-মুড়কি অথবা ছেলের হাতের মোয়ার মত সহজপ্রাপ্য বস্তু নয়, যে তা দিয়ে অগণিত হতদরিদ্র, অশিক্ষিত, বুভুক্ষু, নিরন্ন মানুষদের জীবনকে সোনা দিয়ে মুড়িয়ে দেয়া হবে। ওই কঠিন অবস্থায় দেশবাসীকে নিয়ে ভারসাম্য রক্ষা করে চলাটাই ছিল অনেক কঠিনতম একটা চ্যালেঞ্জ। তাই প্রকৃত অবস্থার পর্যালোচনা না করে,পরিবর্তে ভুয়ো, ফাঁকা বুলি উড়ানোটা কোন কাজের কথা নয়।
কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপট অনেক পরিবর্তিত হয়ে গেছে। দেখতে দেখতে আমরা স্বাধীনতার পঁচাত্তর বর্ষ অতিক্রম করলাম। বর্তমানে আমরা শিক্ষা, দীক্ষা, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান-চেতনা, প্রযুক্তি, কারিগরি-দক্ষতা ইত্যাদি সমস্ত দিক থেকেই বিশ্বের অনেক দেশকেই টেক্কা দিতে পেরেছি। আমাদের অগ্রগতি অনেক দেশের কাছেই বেশ ঈর্ষণীয় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু নির্দ্বিধায় বলা যাবে সেই পরিপ্রেক্ষিতে আমরা নানাভাবেই আমাদের স্বাধীনতার সংকট বেশ মর্মে মর্মে উপলব্ধি করছি। আমাদের স্বাধীনতা যেন বর্তমানে একটা সংক্রমণের শিকার হয়ে দাঁড়িয়েছে। খোলা মনে পথ চলা, কথা বলা এখন আমার নিজস্ব অধিকারের বাইরে।
অবশ্যই এমন কথা নিশ্চয়ই বলতে চাইনি, যে স্বাধীনতা মানে স্বেচ্ছাচারিতা। আমার যথেচ্ছাচার নিশ্চয়ই কোনভাবেই সমাজ সংস্কৃতিকে দূষিত করবে না এটা অবশ্য কাম্য। কিন্তু তা সত্বেও জোর গলায় আজ আমরা বলতে বাধ্য হই যে আমার খাওয়া-পরা, আমার ধর্মাচরণ, আমার নিজস্ব মত প্রকাশের অধিকার সবই আজ সংকুচিত হয়ে গেছে। আজ আমরা কিছুতেই জোর গলায় বলতে পারছি না "স্বরাজ আমার জন্মগত অধিকার"। সেই অধিকার প্রতি মুহূর্তেই খর্ব হয়ে চলেছে। কি খাবো, কি পরবো এ বিষয়ে আমার স্বাধীনতা থেকে অন্যের চাপানো মতামত আজ গুরুত্ব পাচ্ছে অনেক বেশি। পরিচ্ছন্ন রাজনীতি আজ অস্তমিত প্রায়, পরিবর্তে দূষিত, হীন রাজনীতিতে ভরপুর হয়ে একদল রাজনীতিবিদ প্রকাশ্যে সমাজটাকে দূষিত করে বেড়াচ্ছে প্রতিনিয়ত। পরধর্ম সহিষ্ণুতাকে আমরা বিশ্বাস করি না,আচরণে প্রকাশ তো পাইই না। কিছু রাজনীতিবিদের ভিন্ন চক্রান্তে অন্য ধর্মের প্রতি সোজা সাপটা ভাবে আঘাত চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কিছু খাদ্যাখাদ্য খাওয়া না খাওয়ার ব্যাপারে মানুষকে বাধ্য করা হচ্ছে। এমনকি সফরকালীন সময়েও জোর করে সকলকে নিরামিশ খেতে বাধ্য করা হচ্ছে। রাজধর্ম আজ ধুলোয় ভুলুন্ঠিত। তা কিছুতেই সুষ্ঠুভাবে রক্ষিত হচ্ছে না। কোনোভাবেই তা আজ আমাদের সোজা সরল পথে চলার অধিকার কে সহযোগিতা তো করেই না, বরং তার প্রকাশ্য সমর্থন থেকেও আমাদের বঞ্চিত করে।
আমরা কি ভেবে দেখব না যে আমাদের কবি অতুলপ্রসাদ সেন লিখে গেছেন- “নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধান / বিবিধের মাঝে দেখ মিলন মহান”। আর আমরা তা নিয়ে খুব আত্মতৃপ্তও থাকি। আর আজ এই স্বাধীনতার বোধ যদি আমাদের না থাকে, অন্যের চলার, বলার স্বাধীনতার প্রতি যদি বিন্দুমাত্র সহানুভূতি-সহমর্মিতা না থাকে, তাহলে অকারনে স্বাধীনতার বড় বড় বুলি আওড়ে অথবা চাপ প্রয়োগ করে পতাকা উত্তোলন করার আড়ম্বর দেখিয়ে বাস্তবিক পক্ষে কোন লাভ নেই।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন