লেবেল

শুক্রবার, ২৩ অক্টোবর, ২০২০

সার্বজনীন শারদ উৎসবের বিচিত্র ইতিহাস। শঙ্কর তালুকদার



সার্বজনীন শারদ উৎসবের বিচিত্র ইতিহাস 

 —শঙ্কর তালুকদার

 

দুর্গাপূজা বা দুর্গোৎসব প্রকৃতপক্ষে হিন্দু দেবী দুর্গা পূজাকে কেন্দ্র করে প্রচলিত একটি সামাজিক  উৎসব। এই পূজা সমগ্র হিন্দুসমাজেই প্রচলিত। তবে বাঙালি হিন্দু সমাজে এটি অন্যতম বিশেষ ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসব হিসেবে পালন করা হয়। আশ্বিন এবং চৈত্র মাসের শুক্লপক্ষে আলাদা দুটি উৎসবে দুর্গাপূজা হয়ে থাকে। আশ্বিন মাসের দুর্গাপূজা শারদীয়া দুর্গাপূজা এবং চৈত্র মাসের দুর্গাপূজা বাসন্তী দুর্গাপূজা বা বাসন্তী পূজা নামে পরিচিত। এর মধ‍্যে শারদীয়া দুর্গাপূজার জনপ্রিয়তাই বেশি। বাসন্তী দুর্গাপূজা মূলত কয়েকটি পরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ এছাড়া প্রাচীন সমাজিক জনপদেই কেবল এই পূজা এখনো হতে দেখা যায় !



দুই বাংলাতেই তথা সাড়া বিশ্বেই বাঙালীরা যেখানেই এই শারদীয়া দুর্গাপূজা করেন সেখানেই দেবী দুর্গার যে অতিপ্রচলিত এক চালার মূর্তিটি সচরাচর দেখা যায় সেটি  সপরিবার মা দুর্গার মূর্তি বা পরিবারসসম্বিতা ও বলা যায়। এই মূর্তির মাঝে  সিংহবাহিনী দেবী মা দুর্গা থাকেন যিনিই মহিষাসুরমর্দিনী; তার মুকুটের উপরের দিকে একচালার চাঁদোয়াতে শিবের ছোট মুখ ও দেখা যায়; দেবীর ডানদিকে দেবীমূর্তির গা ঘেষে উপরে দেবী লক্ষ্মী ও নিচে গণেশ; আর বামপাশে উপরে দেবীর গা ঘেঁষে দেবী সরস্বতী  ও নিচে কার্তিকেয়কে দেখা যায়। কলকাতায় ১৬১০  সালে  সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের দুর্গাপূজাতেই প্রথম এই সপরিবার দুর্গামূর্তির প্রচলন হয়েছিল বলে মনে করা হয় । তাঁরা কার্তিকেয়কে জমিদারপুত্রের রূপ দিয়েছিলেন , যা এর আগে সম্রাট সমুদ্রগুপ্তের আদলে যুদ্ধের দেবতা রূপে বর্ণনা করেই সৃষ্টি করা হত এবং সেইমতই নির্মান বা কল্পনা করা হত। এছাড়াও বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুর-সংলগ্ন অঞ্চলে দেবী দুর্গার এক বিশেষ মূর্তি দেখা যায়। সেখানে দেবীর ডানপাশে উপরে গণেশ ও নিচে লক্ষ্মী, বামে উপরে কার্তিকেয় ও নিচে সরস্বতী এবং কাঠামোর উপরে নন্দী-ভৃঙ্গীসহ বৃষপৃষ্ঠে শিব ও দুইপাশে দেবীর দুই সখী জয়া ও বিজয়া অবস্থান করেন। কলকাতার কোনও কোনও বাড়িতে আবার দুর্গোৎসবে লক্ষ্মী ও গণেশকে সরস্বতী ও কার্তিকেয়ের সঙ্গে স্থান বিনিময় করতেও দেখা যায়। আবার খুব কম যায়গায় হলেও কোন কোন অঞ্চলে দুর্গাকে শিবের কোলে বসে থাকতেও দেখা যায়। এগুলি ছাড়াও বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে দেবী দুর্গার বিভিন্ন রকমের স্বতন্ত্র মূর্তিও চোখে পড়ে।

এছাড়া আধুনিক সমাজে বাড়োয়ারী দুর্গা প্রতিমা বিভিন্ন সামাজিক ও সমসাময়ীক ঘটনার নেপথ‍্যের কাহিনি সম্বলিত বিষয়ের উপর নির্ভর করে থিম পূজোয় বিভিন্ন প্রকারের দুর্গা প্রতিমার শিল্প ফুটিয়ে তুলে উৎসবকে বিশেষ ভাবে আলোকিত করে; যেমনটি এবারে এই করোনা বিদ্ধ পৃথিবীর কথা মনে রেখে অনেক দুর্গা প্রতিমার মুখেই মাস্ক এবং হাতে দস্তানা লাগানো দেখা গেছে। তবে দুর্গার রূপকল্পনা বা কাঠামো বিন্যাসে যতই বৈচিত্র থাকুক, বাংলায় দুর্গোৎসবে প্রায় সর্বত্রই দেবী দুর্গা সপরিবারে পূজিতা  হন।





ইতিহাসের পাতার স্বাভাবিক ভাবে অব্যবহৃত  পাতার অন্বেষণের তথ‍্য অনুযায়ী শোনা যায়, যে, প্রকৃতপক্ষে সেদিনের পলাশীর যুদ্ধের স্মারক  উৎসবই আজ বাঙালীর জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে।১৭৫৭ সালের ২৩ জুন তারিখে পলাশীর রণাঙ্গনে ক্লাইভের হাতে নবাব সিরাজদ্দৌলার পরাজয় ঘটলে সবচেয়ে বেশী  যারা উল্লসিত হয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন নদীয়ার রাজা এবং কৃষ্ণনগর রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ভবানন্দ মজুমদারের বংশধর  রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় আর কলকাতার শোভাবাজার রাজ পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা রাজা নবকৃষ্ণ দেব। কোম্পানীর জয়কে সেদিন ভ্রম বশে তাঁরা হিন্দুর জয় বলে মনে করলেন ! ওদিকে ইংরাজ সেনাপতি ধূর্ত ক্লাইভও তাঁদের সেইরকমই বোঝালেন। ক্লাইভের পরামর্শে তাঁরা পলাশীর যুদ্ধের বিজয়-উৎসব করার আয়োজন করলেন।

সেই অবসরে, বসন্তকালিন দুর্গাপূজাকে তাঁরা পিছিয়ে আনলেন শরৎকালে। তথ‍্য অনুযায়ী ১৭৫৭ সালেই কৃষ্ণচন্দ্র এবং নবকৃষ্ণ দুজনেই সেই সময়ে লক্ষাধিক টাকা খরচ করেছিলেন। রাজা নবকৃষ্ণ টাকা পেয়েছিলেন সিরাজদ্দৌল্লার গুপ্ত কোষাগার লুঠ করে।আর কৃষ্ণচন্দ্র টাকা পেয়েছিলেন ক্লাইভের প্রত্যক্ষ কৃপায়। ক্লাইভের সুপারিশে কৃষ্ণচন্দ্রের বার্ষিক খাজনা বরাবরের জন্যে পাঁচ লক্ষ করে কমে গিয়েছিল।আগে এদেশে বসন্তকালে চালু ছিল দুর্গাপূজা আর শরৎ কালে চালু ছিল নবপত্রিকা পুজো, আজ ও বর্ধমান জেলার বিভিন্ন জনপদে, কাটোয়া মহাকুমা প্রভৃতি অঞ্চলে দুর্গাপূজার সময় প্রধান অংশ হিসেবে কলাবউ বা নবপত্রিকার ই পূজাই হয় ! এছাড়া প্রায় সমস্ত শারদীয়া পূজা মন্ডপেও দুর্গা প্রতিমার সাথে কলাবউ পুজো হয়ে থাকে !




বাংলায় দুর্গাপুজো প্রবর্তনের কৃতিত্ব যাঁরই হোক না কেন, কলকাতার ইতিহাসকারদের মতে এই শহরের চৌহদ্দির মধ্যে দুর্গার পুজো(বসন্তকালিন) প্রথম অনুষ্ঠিত হয় ১৬১০ খ্রিস্টাব্দেই, বরিষার (বেহালা সখের বাজার অঞ্চল) সাবর্ণ গোত্রীয় রায়চৌধুরী পরিবারের আটচালা মণ্ডপে। তখন ও অবশ্য কলকাতা শহরে রূপান্তরিত হয়নি, তবে রায়চৌধুরীদের সেই মণ্ডপটি আরও একটি কারণে ঐতিহাসিক। সেই আটচালা মণ্ডপে বসেই ১৬৯৮ খ্রিস্টাব্দের ১০ই জুন তারিখে জোব চার্নকের জামাই চার্লস আয়ারের সঙ্গে ‘সুতানুটি’, ‘গোবিন্দপুর’ ও ‘কলকাতা’ গ্রাম তিনটির হস্তান্তরের বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছিল রায়চৌধুরী বাড়ির তৎকালীন কর্তাদের।এ বিষয়ে উল্লেখযোগ‍্য যে, দুর্গাপুজোর সঙ্গে জড়িয়ে ছিল মূর্তির ব্যাপার, আর নবপত্রিকা পুজোর সাথে জড়িয়ে ছিল ন'টি ওষধিগুণ  সম্পন্ন উদ্ভিদের ব্যাপার ও তাদের সংরক্ষণের সামাজিক পদ্ধতি। 

নবপত্রিকাপুজোর  মধ‍্যে 'নবপত্রিকা' শব্দটির আক্ষরিক অর্থ নয়টি গাছের পাতা। তবে বাস্তবে নবপত্রিকা নয়টি পাতা নয়, নয়টি উদ্ভিদ। রম্ভা, কচ্চী, হরিদ্রাচ, জয়ন্তী, বিল্ব, দাড়িমৌ,অশোক মানকশ্চৈব ধান্যঞ্চ নবপত্রিকা। অর্থাৎ: কদলী বা রম্ভা (কলা), কচু, হরিদ্রা (হলুদ), জয়ন্তী, বিল্ব (বেল), দাড়িম্ব (ডালিম), অশোক, মানকচু ও ধান।




একটি পাতা সহ কলাগাছের সঙ্গে অপর আটটি সমূল সপত্র উদ্ভিদ একত্র করে একজোড়া বেল সহ শ্বেত অপরাজিতা লতা দিয়ে বেঁধে লালপাড় সাদা শাড়ি জড়িয়ে ঘোমটা দেওয়া বধূর আকার দেওয়া হয়; স্ত্রীরূপের জন্য দু’টি বেল দিয়ে করা হয় স্তনযুগল। তারপর সিঁদুর দিয়ে সপরিবার দেবীপ্রতিমার ডান দিকে দাঁড় করিয়ে পূজা করা হয়। প্রচলিত ভাষায় নবপত্রিকার নাম কলাবউ। সম্ভবত, নবপত্রিকার নয়টি উদ্ভিদ আসলে দেবী দুর্গার নয়টি বিশেষ রূপের প্রতীকরূপে কল্পিত হয়!

কদলী বা রম্ভা (কলা গাছ): কদলি গাছ এর অধিষ্টাত্রী দেবী ব্রহ্মাণী; কচু (সাধারন): কচু গাছের অধিষ্টাত্রী দেবী কালিকা; হরিদ্রা (হলুদ গাছ): হরিদ্রা গাছের অধিষ্টাত্রী দেবী উমা; জয়ন্তী: জয়ন্তী গাছের অধিষ্টাত্রী দেবী কার্তিকী; বিল্ব (বেল গাছ): বিল্ব গাছের অধিষ্টাত্রী দেবী শিবা; দাড়িম্ব (ডালিম/বেদানা গাছ): দাড়িম্ব গাছের অধিষ্টাত্রী দেবী রক্তদন্তিকা; অশোক: অশোক গাছের অধিষ্টাত্রী দেবী শোকরহিতা; মানকচু: মানকচু গাছের অধিষ্টাত্রী দেবী চামুণ্ডা; ধান: ধান গাছের অধিষ্টাত্রী দেবী লক্ষ্মী।এই নয় দেবী একত্রে "নবপত্রিকাবাসিনী নবদুর্গা" নামে "নবপত্রিকাবাসিন্যৈ নবদুর্গায়ৈ নমঃ" মন্ত্রে পূজিতা হন।




মহাসপ্তমীর দিন সকালে নিকটস্থ নদী বা কোনো জলাশয়ে (নদী বা জলাশয়ে না থাকলে কোনো মন্দিরে) নিয়ে যাওয়া হয়। পুরোহিত নিজেই কাঁধে করে নবপত্রিকা নিয়ে যান। তার পিছন পিছন ঢাকীরা ঢাক বাজাতে বাজাতে এবং মহিলারা শঙ্খ ও উলুধ্বনি করতে করতে চলেন। শাস্ত্রবিধি অনুযায়ী স্নান করানোর পর নবপত্রিকাকে নতুন শাড়ি পরানো হয়। তারপর পূজামণ্ডপে নিয়ে এসে নবপত্রিকাকে দেবীর ডান দিকে একটি কাষ্ঠসিংহাসনে বসানো হয়। পূজামণ্ডপে নবপত্রিকা প্রবেশের মাধ্যমে দুর্গাপূজার মূল অনুষ্ঠানটির প্রথাগত সূচনা হয়। নবপত্রিকা প্রবেশের পর দর্পণে দেবীকে মহাস্নান করানো হয়। এরপর বাকি দিনগুলিতে নবপত্রিকা প্রতিমাস্থ দেবদেবীদের সঙ্গেই পূজা পেতে থাকে। বিশেষভাবে লক্ষণীয় হল, নবপত্রিকা প্রবেশের আগে পত্রিকার সম্মুখে দেবী চামুণ্ডার আবাহন ও পূজা করা হয়। পত্রিকাস্থ অপর কোনো দেবীকে পৃথকভাবে পূজা করা হয় না। 

বলাবাহুল্য এই সবই হল পৌরাণিক দেবী মা দুর্গার সঙ্গে এই শস্যদেবীকে সর্বাংশে মিলিয়ে নেবার এক সচেতন চেষ্টা। এই শস্য-দেবীকে মাতা পৃথিবীরই রূপভেদ মনে করা হয়, সুতরাং আমাদের জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে আমাদের শারদীয়া দুর্গাপূজার ভিতরে এখনও সেই আদিমাতা পৃথিবীর পূজা অনেকটাই মিশে রয়েছে।

তবে  দুর্গাপূজার সঙ্গে শস্যদেবীর পূজার অনুষঙ্গটি অনেক পৌরানিক গবেষণায় স্বীকার করা হলেও, দেবীর শাকম্ভরী রূপ কল্পনা বা সেই মত দেবী আরাধনার তত্ত্বটিকে নবপত্রিকার উৎসরূপে অনেকেই মানতে চায়নি। দেবীপুরাণে নবদুর্গার উল্লেখ থাকলেও কিন্তু নবপত্রিকা সম্পর্কে কিছু বলা নাই। সেই অর্থে নবপত্রিকা দুর্গাপূজার একটি আগন্তুক অঙ্গ হিসেবেই রয়ে গেছে। বোধ হয় কোনও প্রদেশে শবরাদি জাতির লোকেরা ৯টি গাছের পাতা সামনে রেখে নবরাত্রি উৎসব পালন করত। তারা নবপত্রীকে অবস‍্য দুর্গা-প্রতিমার পাশে স্থাপন করেছে। এছাড়া মার্কণ্ডেয় পুরাণেও নবপত্রিকার কোন উল্লেখ নেই। কালিকাপুরাণে ও নবপত্রিকার উল্লেখ না থাকলেও কিন্তু সেখানে সপ্তমী তিথিতে পত্রিকাপূজার নির্দেশ আছে। কৃত্তিবাস ওঝা রচিত রামায়ণেও রামচন্দ্র কর্তৃক নবপত্রিকা পূজার উল্লেখ রয়েছে –যাতে লেখা হয়েছে- “বাঁধিলা পত্রিকা নব বৃক্ষের বিলাস।"

 

১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধের বিজয়োৎসব পালন করার জন্যে বসন্তকালের দুর্গাপুজোকে শরৎ কালে নিয়ে এসে নবপত্রিকাপুজোর সঙ্গে জুড়ে দিয়ে শাদদোৎসবের সামাজিক ও সামগ্রিক চেহারা বদলে দিয়ে কেবল প্রাচুর্য অন্বেষণের উৎসবে বদলে দেওয়া হয়েছিল। তাই পরবর্তীতে সমাজের অবস্থাপন্নদের ঘরেই ক্রমশঃ এই পূজা হতে শুরু করেছিল, যারমধ‍্যে অনেকগুলো পুজোই এখন কলকাতার মত বিভিন্ন পুরাতন জনপদে দেখতে পাওয়া যায় !

এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ‍্য যে, ক্লাইভ নবকৃষ্ণের বাড়িতে সপারিষদ উপস্থিত হয়ে একশো টাকা দক্ষিণা ও ঝুড়ি ঝুড়ি ফলমূল দিয়েছিলেন বলে অনেক সমকালীন সাহিত‍্য সমষ্টির  মধ‍্যে তার উল্লেখ পাওয়া যায়।কলকাতার হিন্দু মাতব্বররা, যারা সাহেবদের নিমন্ত্রণ করে নিজের বাড়িতে নিয়ে আসতেন তারাও জানতেন, কেবল মাটির পুতুল দেখে সাহেবরা খুশি হবেন না। তাই এই উৎসবের অবসরে সাহেবদের মনোরঞ্জনের জন্য জ্যান্ত পুতুল আনা হতো লখনৌ, ব্রহ্মদেশ কখনও বিলেত থেকেও। এদের বলা হত বাইজী।




পরবর্তীতে অন‍্যান‍্য সামাজিক উৎসবে ও পুরনো কলকাতায় বাই নাচিয়ে বিখ্যাত হয়ে পড়েছিলেন নবকৃষ্ণ দেব, গোপিমোহন দেব, রাধাকান্ত দেব, রাজকৃষ্ণ দেব, প্রাণকৃষ্ণ সিংহ, কেষ্টচন্দ্র মিত্র, রামহরি ঠাকুর, বারাণসী  ঘোষ, দর্পনারায়ণ ঠাকুর, সুখময় রায়, কিষণচন্দ্র রায়, রামচন্দ্র রায়, রূপচাঁদ রায়, মদনমোহন দত্ত, বৈষ্ণবচরণ শেঠ, রূপলাল মল্লিক, দ্বারকানাথ ঠাকুর, রামদুলাল সরকার, প্রাণকৃষ্ণ হালদার এবং মতিলাল শীল প্রভৃতিরা।সেকালের কলকাতার বাবুদের বাড়িতে দুর্গা ঠাকুর দেখার অধিকার আর সুযোগ সবার অবশ্য  ছিল না। কেবল অতিথিরা সেখানে প্রবেশ করতে পারতেন।

দারোয়ান দাঁড়িয়ে থাকতো বাড়ির গেটে , হাতে চাবুক নিয়ে। অতিথি ছাড়া আর কেউ ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করলেই দারোয়ান তাকে চাবুক মারতো। ফলে ঠাকুর দেখতে গিয়ে চাবুক খেয়ে ফিরে আসতে হোত গরিব-দুখীদের।প্রথমে বাড়ির পুজো, তারপর বারোয়ারি পুজো আর সবশেষে এসেছে সার্বজনীন পুজো।বারো ইয়ার বা বারোজন বন্ধুর চাঁদার টাকায় প্রথম বারোয়ারি দুর্গাপুজো হয় ১৭৯০ সালে, হুগলি জেলার গুপ্তিপাড়ায়।

আর সার্বজনীন দুর্গাপুজোর পত্তন হয় এই কলকাতায়, ১৯২৬ সালে। এছাড়া সিমলা আর বাগবাজারে দু জায়গায় ঐ বছর সার্বজনীন দুর্গাপুজো হয়। সিমলা ব্যায়াম সমিতির অতীন্দ্রনাথ বোস ছিলেন প্রথমটির উদ্যোক্তা। বাগবাজারের বারোয়ারি পুজো শুরু হয় ১৯১৮ সালে। স্থানীয় কিছু যুবক এক ধনীলোকের বাড়িতে দুর্গা ঠাকুর দেখতে গিয়ে অপমানিত হন। পরের বছর তাঁরা  বারোয়ারি পুজো চালু করেন। সবার জন্যে তাঁরা উন্মুক্ত করে দেন  পুজোমন্ডপের দ্বার। পুজোর উদ্যোক্তা ছিলেন রামকালী মুখার্জি, দীনেন চ্যাটার্জী, নীলমনি ঘোষ, বটুক বিহারী চ্যাটার্জী প্রমুখ। সঠিক অর্থে এই পুজোই কলকাতার প্রথম সার্বজনীন দুর্গাপুজো।





প্রথম সার্বজনীন পুজোয় বাধা সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন অনেক রক্ষণশীল পন্ডিত।শেষ পর্যন্ত তাঁরা সরে দাঁড়াতে বাধ্য হন পণ্ডিত দীননাথ ভট্টাচার্য্যের হস্তক্ষেপে।ক্রমে এই সার্বজনীন পূজাই সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পটভূমিকা ধরে শারোদৎসবে রূপান্তরিত হয়ে আজ সারা বিশ্বের মানুষের কাছে বৃহত্তর সামাজিক উৎসবে পরিনত হয়েছে ! 

দুর্গাপূজা ভারত, বাংলাদেশ ও নেপাল সহ ভারতীয় উপমহাদেশ ও বিশ্বের একাধিক রাষ্ট্রে পালিত হয়ে থাকে। তবে বাঙালি হিন্দু সমাজের প্রধান ধর্মীয় উৎসব হওয়ার দরুন ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও ঝাড়খণ্ড রাজ্যে ও বাংলাদেশে দুর্গাপূজা বিশেষ জাঁকজমকের সঙ্গে পালিত হয়। এমনকি ভারতের অসম, বিহার, ঝাড়খণ্ড,মণিপুর এবং ওড়িশা রাজ্যেও দুর্গাপূজা মহাসমারোহে পালিত হয়ে থাকে। ভারতের অন্যান্য রাজ্যে প্রবাসী বাঙালি ও স্থানীয় জনসাধারণ নিজ নিজ প্রথামাফিক শারদীয়া দুর্গাপূজা ও নবরাত্রি উৎসব পালন করে। এমনকি পাশ্চাত্য দেশগুলিতে কর্মসূত্রে বসবাসরত বাঙালিরাও দুর্গাপূজা পালন করে থাকেন। ২০০৬ সালে গ্রেট ব্রিটেনের রাজধানী লন্ডনের ব্রিটিশ মিউজিয়ামের গ্রেট হলে "ভয়েসেস অফ বেঙ্গল" মরসুম নামে একটি সাংস্কৃতিক প্রদর্শনীর অঙ্গ হিসেবে স্থানীয় বাঙালি অভিবাসীরা ও জাদুঘর কর্তৃপক্ষ এক বিরাট দুর্গাপূজার আয়োজন করেছিলেন।


সামাজিক ও অর্থনৈতিক সামগ্রিকতায় ভরা এই মহোৎসবের গভীরে ধর্মীয় ভাবনাটি যেমনই থাক কিংবা ইতিহাসের সেই সময়ে পৌঁছলে  যতই দ্বিধাগ্রস্থতা সামনে আসুক না কেন, আমাদের আধুনিক যান্ত্রিক জীবনে এই অনুষ্ঠানের উপর ভরসা করে সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষের মনে যে উৎসবময় ভাবনার উদয় হয় সেই আর্থ-সামাজিক ভাবধারাকে সমৃদ্ধ করার মধ্যেই আমার এই আলেখ‍্যটির স্বার্থকতাটি রয়ে গেছে, তাই এই রচনা পড়ে পাঠকের মনে সময় ও কালের   বৈচিত্র‍্যে মেশা এই প্রকৃতি ও সাংস্কৃতির সমন্বয়ে বৃহৎ ধর্মীয় তথা সামাজিক অনুষ্ঠানটি যদি পর্যালোচিত হয়, তাহলেই আমার এ লেখা স্বার্থক হবে!




সূত্র:

এই আলেখ‍্যটির অনেক তথ‍্য ই রাধারমণ রায়ের 'কলকাতা বিচিত্রা' বইয়ে সার্বজনীন দুর্গাপুজো নিয়ে লেখা থেকে সংগ্রহ করা ।


----------------------------------------------------------------


মতামত জানান 

ankurishapatrika@gmail.com   


 ----------------------------------------------------------------    



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন