ধারাবাহিক প্রেমের উপন্যাস (পর্ব-৯)
.... এবং ইরাবতির প্রেম
গৌতম আচার্য
সত্যেন এর মনে পড়ে যায় বহু বহু বছর আগের সেই ঘটনা।। সেই দিনের তিস্তা তার বাবার কর্মের সুত্রে বসবাস করতো নাগরাকাটা।। কিন্তু তাদের বাড়ি ছিলো জলপাইগুড়ি শহরের- ই কোথাও।। ইরাবতি মানে পিয়া-ও থাকে সেই উত্তর বাংলার জলপাইগুড়ি শহরে- ই।। শৈশবের সেই ভালোলাগাই কৈশোর অন্তে ভালোবাসা হয়ে জেগে উঠেছিলো সত্যেন এর মনের ভিতর।। অথচ এই এ্যতোগুলি বছর ধরে দুজনের কারও সঙ্গে কারো দেখাই হয়নি.... না একবার- ও না।।
সত্যেন জানে না শৈশবের তিস্তা যৌবনে এসে ঠিক কেমন হয়েছে।। আর আজ তো বার্ধক্যের দোরগোড়া ছুয়ে ফেলেছে সত্যেন।। যৌবনে পা দেওয়া থেকেই তিস্তা তার মননে নতুন করে আলোড়ন তুলেছিলো।। যৌবনের সেই দুর্বার আকর্ষণ বারবার সত্যেনকে টেনে নিয়ে গেছে উত্তরবঙ্গের নাগরাকাটা, জলপাইগুড়ি।। একটি সময় সত্যেন বুঝেছে সে অরন্যে সূচ খুঁজে বেড়াচ্ছে, এভাবে সে কখনও খুঁজে পাবেনা তিস্তাকে।। তবুও...
কিগো তুমি আমার নাম জানোনা বুঝি? প্রশ্ন করেই খিলখিল করে একগাল হাসি ফুটে উঠেছিলো তার মুখে।। একটু থেমে সে বলেছিলো, "আমি তিস্তা গো তিস্তা, মা বলে, তিস্তা পাড়ের মেয়ে- তিস্তা"।। সত্যেন আড়ষ্টতা আর লজ্জা জড়ানো বিষ্ময়ের ঘোর থেকে বেড়িয়ে আসবার আগেই সে বলেছিলো "এসো তুমি আর আমি ভাব করি"।। এগিয়ে দিয়েছিলো তার ডান হাতের বুড়ো আঙুলটি।। সত্যেনের ডান হাতের বুড়ো আঙুলের সঙ্গে তা পেঁচিয়ে তার বাম হাতে শক্ত করে ধরেছিলো সত্যেনের ডান হাতের মাঝখানটি।। "এই দ্যাখো, কেমন শক্ত করে ধরেছি তোমায়, আমাকে ছেড়ে আর চলে যেতে পারবে না কোনদিন"।।
শৈশব সারল্যে ভরা সেই কয়েক মূহুর্তের অভিঘাত সত্যেনের মনের ভিতরে ধ্বনি আর প্রতিধ্বনি হয়ে বারবার ফিরে ফিরে এসেছে।। গোটা জীবনের সঙ্গী হয়েছে বারবার।। "আমি তিস্তা গো তিস্তা, মা বলে, তিস্তা পাড়ের মেয়ে- তিস্তা"।। সত্যেন ভুলতে পারেনি মূহুর্তে উন্মাদনা জাগানো সেই কথাগুলি।। জীবনের প্রতিমূহুর্ত সেই কথা বলা মেয়েটি তাড়িয়ে বেড়িয়েছে তাকে।। সেই দেখা.... জীবনে মাত্র একবার-ই, তবুও মনের গভীরতায় তা স্পর্শ করেছে অতল।।
তখন কতোই বা বয়স হবে সত্যেনের? বড়জোর নয় কিম্বা দশ।। শৈশবের সহজ সরল মননে তখনও প্রেম বা ভালোবাসা কি সেই বোধটুকুও জন্মায় নি পর্যন্ত।। বাবা- মার সঙ্গে বেড়াতে গিয়েছিলো ডুয়ার্স।। তিস্তার পাড়ে ঘন সবুজ বনানীর ধারে ছোট্ট একটি বাংলোয় তারা পৌঁছেছিলো "দুটি পাতা একটি কুঁড়ি" থেকে প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে চা তৈরি করার একটি চা এর ফ্যাক্টরী দেখার জন্য।। ফ্যাক্টরীর জি.এম. মিষ্টার বেদ এর সৌজন্যে তাঁর বাড়িতে চায়ের নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে হয়েছিলো সত্যেনের বাবাকে।।
সেখানেই প্রথম দেখা সত্যেন আর তিস্তার।। প্রথম সে দর্শনেই তিস্তা কেমন একটি ভালো লাগার অনুভূতি তৈরি করে দিয়েছিলো সত্যেনের মনের ভিতরে।। নিজের অজান্তেই লালিত পালিত হয়ে সেই চারাগাছ কখন মহীরুহ হয়ে জেগে উঠেছে তা সত্যেন প্রথম অনুভব করলো কৈশোরে পা দেওয়ার মাঝামাঝি সময়ে।।
এ্যতোদিনে সত্যেন বুঝতে শিখেছে, একজন নারী আর একজন পুরুষের মধ্যে যে সম্পর্ক তৈরি হয়, তার নাম ভালোবাসা।। হিন্দীতে তাকে বলে প্যার, আর ইংরাজীতে তার নাম Love. এই ভালোবাসায় প্রয়োজন একজন নারী এবং একজন পুরুষ- যারা পরস্পর পরস্পরের জন্য সমুদ্র মন্থন করতে পারে, আকাশ পথ পাড়ি দিতে পারে কিম্বা নীলকন্ঠের মতো আকন্ঠ বিষপান করতে পারে।। শর্ত শুধু একটিই।। যা হলো বিশ্বাস।।
নীল আকাশে সাদা তুলোর মতো যেমন মেঘ উড়ে বেড়ায়, ঠিক তেমনই কৈশোর- যৌবনের সন্ধিক্ষণে যে ভাবনার মেঘ জমে ছিলো শৈশবের এক মহাক্ষণে ঘটে যাওয়া তুচ্ছ এক ঘটনায় তা সত্যেন এর গোটা জীবনটিকে তোলপাড় করে দিয়েছিলো।। সব কিছু করেও মনের ঈশান কোনে "তিস্তা..... তিস্তা.... তিস্তা" অনাবিষ্কৃত, না পাওয়া, হারিয়ে যাওয়া এক কষ্টের মেঘ ছুটে বেড়িয়েছে সত্যেন এর গোটা জীবন।।
সত্যেন উদভ্রান্ত প্রেমিক হয়ে ছুটে বেড়িয়েছে মনের গভীর থেকে অতলে।। তবু আর কখনও সন্ধান খুঁজে পায়নি তার চাওয়াকে।। অতৃপ্ত মনের গভীর নিঃশব্দ থেকে ভালো বেসে গেছে তিস্তাকে, তিস্তার পাড় কে, নাগরাকাটার ছোট্ট জনপদকে, জলপাইগুড়ি শহর কে।। অজান্তে ভালো বেসে ফেলেছে ডুয়ার্স, তরাই আর গোটা উত্তর বাংলাকে।।
শৈশবের হারিয়ে যাওয়া সেই স্মৃতির সারণীতে একটু একটু করে আজ দখল নিতে শুরু করেছে ইরাবতি।। হারিয়ে যাওয়া তিস্তার প্রতি সত্যেনের ভালোবাসা আবার নতুন করে সে অনুভব করছে ইরাবতির এই উপস্হিতি- তে।। ইরাবতির মধ্যে তিস্তাকে অনুভব করতে শুরু করেছে সত্যেন।।
চলবে....
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন