আজ শুভ জন্মাষ্টমী
রম্যরচনাঃ অরবিন্দ সরকার
নষ্ট চন্দ্র
সেবার অনাবৃষ্টি।মেঘের দেখা নাই। ব্যাঙের বিয়ে দিয়েও বৃষ্টিপাত হলো না। খাটরা গ্রাম বিশাল বিলের ধারে গাছপালা শোভিত। তখনকার দিনে চুরি ডাকাতি খুব হোতো।তাই গ্রামপাহারা দেবার জন্য পালি হিসেবে সপ্তাহে একদিন বাড়ি পিছু একজনের ডাক ছিলো। যে পাহারা দিতে পারবে না সে লোক ভাড়া করে দিত। নখদর্পণে ছিলো সেই লোকগুলো। সাতজন , আটজন নিয়ে দল হোতো।
রবিবার ডিউটি নিয়েছে, ধনঞ্জয় সরখেল, ঝাঁকু মোড়ল,সমীর সরখেল, শিশির সরখেল ও বাবু মোড়ল। রবিবারের ডিউটি চোখে পড়ার মতো। চিৎকার,গান বাজনা ও ফিস্ট হতো এই দিন। দুজনের বদলি পাহারা এরাই দিয়ে টাকা নিতো আর আসর জমজমাট থাকতো।চোরের বাবারও ক্ষমতা নাই হাঁড়ি কুড়ির আওয়াজ ভেদ করে চুরি করা। দুজন রান্নায় ব্যস্ত, বাদবাকীর "জাগো সব " এই চিৎকারে সমস্ত বাড়ি জেগেই থাকতো।তাই চুরি হোতো না ঐদিন।ঐদিনের প্রশংসা সবাই করতো।
অনাবৃষ্টি, বছরে একবার চাষ। মানুষ হা হুতাশ করে আকাশের দিকে চেয়ে আছে।মেঘব্যাটা আসছে তো উড়ে চলে যাচ্ছে দেখা দিয়ে। মানুষের চোখের জলে ভিজে যাচ্ছে,চোখ মুছছে গামছায়।এই কান্না মেঘের কর্নগোচর হয়না।সে একটু কাঁদলেই ফসল ফলবে। কে কার কথা শোনে।চোখ রাঙায়ে মেঘ সাহায্যের হাত গুটিয়ে বসে আছে।ওর যেন দয়া মায়া হয়না। শিবের মাথায় জল ঢালার জল কোথাও নাই।শিববাবাজীর তেষ্টায় বুকের ছাতি ফেটে যাচ্ছে।আষাঢ় শ্রাবণ পার হয়ে ভাদ্রমাস পড়েছে। আবার কবে চাষাবাদ হবে মানুষ দিশেহারা।
সেদিন রবিবার সবাই মনমরা অবস্থায় ডিউটি করতে বেড়িয়ে চুপচাপে বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে আইডিয়া এলো মনে বাবু মোড়লের। নষ্ট চন্দ্র করলে বৃষ্টি হবে এটা একটা মানুষের বদ্ধমূল ধারণা। সেই স্মৃতি মনে পড়ে সবাই সেদিন ফিস্ট ভুলে ঐ কর্মে জড়িয়ে পড়লো। বাবু মোড়ল মৃৎশিল্পী ,সে অলক্ষ্মী নারায়নের যুগল মূর্তি তৈরী করলো।যা দর্শনে সবার অলুক্ষণে হয়। চুপিসারে কারো পায়খানার শৌচকর্মের গারু বদনা, কারো স্নানের গামছা,পরিধান সামগ্রী,গোয়ালের গরু ছাগল ভেড়া খুলে দিয়ে সেই দড়ি দিয়ে চুরির পায়ের চপ্পল,চটিজুতো, শাড়ি,সায়া, ব্লাউজ, ধুতি, লুঙ্গি,সব বাঁশের খুঁটির উপর ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। খরার মধ্যে চালকুমড়া আর পুঁই শাকে বাড়ির চালা ভর্তি। সেগুলো সব নিয়ে এসে প্রত্যেকের বাড়িতে বাড়িতে ফালাফালা করে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। সবার বাড়ীর সদর দরজা হাট খোলা। ডিউটি পার্টির চিৎকার না থাকায় সবাই নাক ডেকে ঘুমিয়েছে। সকাল হয়েছে,কেউ তাদের সকালের প্রয়োজনীয় বালতি, ঝাঁটা, গারু, বদনা পাচ্ছে না। চিৎকার শুরু হয়েছে গ্রাম জুড়ে।সব চুরি হয়ে গেছে বলে কান্নার রোল উঠেছে। যাদের আজ গ্রাম পাহারাদারের কাজ ছিলো তাদের জরিমানা করার পরিকল্পনা শুরু হতেই নজরে পড়লো মণ্ডপের সামনে তাদের সব জিনিসপত্র ঝুলিয়ে রাখা আছে। সবাই আসে আর নষ্টচন্দ্র দর্শনে চক্ষু লজ্জায় পড়েছে। কিন্তু তাদের মালামাল বুঝে নিতে সবাই তৈরি। অনেক কষ্টে কেউ মালামাল বুঝে পেলো আবার কেউ কেউ এবাড়ীর মাল অন্যবাড়ীতে,অন্যবাড়ীর মাল অন্যজনের গোয়ালে বা নোংরা জায়গায় রাখা আছে। এভাবে খুঁজে আর মুখে বিশ্রী গালিগালাজ শুরু হয়। তীব্র গালিগালাজের পর বিকেলে মেঘবাবাজীর দয়ায় এক পশলা বৃষ্টি হলো। তারপর রাত্রি বেলায় তুমুল বৃষ্টি শুরু হলো।
গ্রামের লোক জন পরের রবিবার মণ্ডপে সভা ডাকলো এবং রবিবারের ডিউটি পার্টিকে একহাজার টাকা বকশিস দেবার অনুমতি দিলো সভা। আর ডিউটি পার্টি অনুপস্থিত নজরে লোকলজ্জা। টাকা বড়ো বেহায়া জিনিস।ওর লজ্জা শরমের বালাই নাই।তাই চোখ মুছতে মুছতে একজন রবিবাসরীয় ডিউটি পার্টির টাকা নিতে হাত বাড়িয়ে দিলো।নষ্টচন্দ্রের মহিমা দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়লো। অপয়া দেবদেবীর ভর ক'রে নররূপী নারায়নের দয়ায় এলাকার পোয়াবারো হলো।
আমাদের গ্ৰামেও আমাদের শৈশবে এই নষ্ট চন্দ্রের
উত্তরমুছুনঅনুষ্ঠান বন্ধুরা মিলে করতেন। আমাদের গ্ৰামে নষ্ট
চন্দ্রের পরিবর্তে চোখ চাঁদা শব্দটি বেশি প্রচলিত।
আমাদের প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং সেসময়ের অনেক
ঘটনাই মিলে যাচ্ছে। ভালো লাগলো আপনার রম্যরচনাটি।