ধারাবাহিক রহস্য উপন্যাস (প্রথম পর্ব)
আংটী রহস্যের নেপথ্যে
অনন্যা দাশ
অখিলবাবু ঘরে ঢুকেই বলতে শুরু করলেন—
"আহা বসন্তের কী যে বাহার!
ম্যাগনোলিয়া চেরি ফুলের সম্ভার
টিউলিপ ড্যাফোডিল
আকাশটা নীল নীল
মন যেন ডুব দিতে চায় বার বার!"
মামা কী একটা পড়ছিলেন, চোখ না তুলেই বললেন, “এটা আপনার নতুন লিমেরিক বুঝি?”
“হ্যাঁ, চারিদিকে ফুলের এত শোভা দেখে মনের ভিতর থেকে আপনাআপনিই বেরিয়ে এল! এখানে বসন্তটা বড়ই মনোরম। গাছে একটাও পাতা নেই শুধু থোকা থোকা ফুল, তাই দেখে আমার কবি মন মোহিত হয়ে পড়ে! ভাবছিলাম ওয়াশিংটন ডিসিতে চেরি ফেস্টিভাল দেখতে যাব। নিখিলকে বলেওছিলাম কিন্তু ও যেতে চাইল না। বলল এত ভিড় হয় যে মাইল খানেক দূরে গাড়ি পার্ক করে হাঁটতে হয়। সারা সপ্তাহ খেটে খুটে কয়েকটা ফুল দেখার জন্যে ওর নাকি অত কাঠখড় পোড়াতে ইচ্ছে করছে না!”
মামা বললেন, “ঠিকই তো বলেছে, অত দূর যাওয়ার তো দরকার নেই। এখানে ব্রুকলিন বা ব্রঙ্কস বোটানিকাল গার্ডেনে গেলেই তো চেরি, ম্যাগনোলিয়া আর আপনার কবিতার বাকি সব ফুল দেখতে পেয়ে যাবেন!”
“তা পাবো তবে জাপানিদের দেওয়া শত শত গাছ এখনও রয়েছে ওয়াশিংটনে এবং তাতে ফুল ফুটছে শুনতেও ভাল লাগে। গাছগুলোর সঙ্গে একটা সেলফি নিতে পারলে...আহা!” ইদানীং অখিলবাবুকে সেলফিতে পেয়েছে। নতুন মোবাইলটা পাওয়ার পর থেকেই পটাপট নিউ ইয়র্কের আনাচে কানাচে এটা সেটার সঙ্গে ছুবি তুলছেন নিজের আর পোস্ট করছেন ফেসবুক, হোয়াটস্যাপে। ওনার ওই পোস্টের প্রভাব সকলেই টের পাচ্ছে।যেমন জিকো-কেকার বাবা একদিন কোন এক বন্ধুর সঙ্গে কথা বলছিলেন এমন সময় সে হঠাৎ বলল, “কী? খুব বিরিয়ানি খাওয়া হচ্ছে না আজকাল?” বাবা একটু ঘাবড়ে গিয়ে বলেছিলেন, “মানে? ঠিক বুঝলাম না!” বন্ধু রীতিমত রেগে গিয়ে বলেছিল, “কেন কাল রাতে বিরিয়ানি খাসনি?” মা আগের দিন রাতে বিরিয়ানি করেছিলেন তাই বাবা বললেন, “হ্যাঁ, তা খেয়েছি কিন্তু তুই জানলি কী করে?” বন্ধু হেঁয়ালি করে বলল, “হুঁ, হুঁ, বাবা! আমার চর সর্বত্র! কিছুই আমার দৃষ্টি এড়ায় না!” পরে জানা গেল অখিলবাবু নাকি বিরিয়ানি ভর্তি পাত্রর সঙ্গে নিজের সেলফি তুলে ফেসবুকে দিয়ে দিয়েছিলেন!
অখিলবাবু জিকো-কেকার সঙ্গে সেলফি নিতে চাইতে ওরা রাজি হল না। অগত্যা উনি নিমো আর ব্রুসের সঙ্গে নিজের কুড়ি নম্বর সেলফিটাই তুললেন। নিমো ওদের লাল মাছ, আর কিছুদিন হল তার এক বন্ধু জুটেছে, যার নাম ব্রুস লি! দুজনে মিলে সারাদিন গোলগোল করে ঘুরে ঘুরে সময় কাটায়। মামা বললেন, “যাক আপনি ঠিক সময় এসেছেন। এখুনি মনে হয় ওরা এসে পড়বে।”
“কারা?”
“নিখিল আবার কে, নিখিল আর ওর বন্ধু।”
“সেকি নিখিল এখানে আসবে অথচ আমাকে কিছুই বলেনি!” ভদ্রলোক যেন আকাশ থেকে পড়লেন। ওনার ভাই আসবে অথচ উনি কিছু জানেন না শুনে ওনার মুখটা পরনের টুকটুকে লাল হাওয়াইয়ান শার্টের মতনই লাল হয়ে গেল। শার্টে অবশ্য লালের ওপর বড় বড় সাদা জবা ফুল। ওটাই নাকি ওনার প্রিয় শার্ট।
“আপনি অযথা মন খারাপ করছেন। নিখিল নিজের জন্যে আসছে না। ওর এক বন্ধুর কী দরকার তাই আসছে। আর বন্ধু মনে হয় সবাইকে ব্যাপারটা জানতে দিতে চায় না। তাই আপনাকে আগে থেকে কিছু বলেনি। এখানে যদি আপনি শোনেন তো ঠিক আছে। আর সবচেয়ে বড় কথা হল আজ সকালেই ও ফোন করেছিল।”
তাও অখিলবাবুর গজগজ করা কমল না।
একটু পরেই নিখিল একজন মাথায় পাগড়ি বাঁধা সিখ যুবককে সঙ্গে করে নিয়ে ঢুকল। ছেলেটির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে দিতে বলল, “এই হল আমার বন্ধু হরপাল সিংহ, হ্যারি। ওও ট্যাক্সি চালায়। কয়েকদিন আগে ওর একটা বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়েছে। সেটা নিয়েই তোমার সঙ্গে কথা বলতে চায়।”মা সকলের জন্যে চা আর শিঙ্গাড়া বানিয়েছিলেন। কেকা গিয়ে সেগুলো নিয়ে এল। হরপাল সিং অরফে হ্যারি সোফায় বসে গরম শিঙ্গাড়ায় এক কামড় দিয়ে বলতে শুরু করল, “আমি একটা ক্যাব সার্ভিসের হয়ে কাজ করি। আমাদের একটা ফোন নম্বর আছে আর ক্লায়েন্টরা সেই নম্বরে ফোন করলে আমরা তাদের গিয়ে তুলে নিয়ে যেখানে যাওয়ার নিয়ে যাই। বিশেষ করে শহরের বাইরের এলাকা টেলাকার জন্যে আমাদের সার্ভিস খুব চালু। গত বুধবার দিন রাত দশটা নাগাদ একটা ফোন আসে যে ৩৫০ লরেল ড্রাইভ থেকে একজনকে তুলতে হবে এবং কাছের ট্রেন স্টেশানে ছেড়ে দিতে হবে। আমি যেখানে ছিলাম সেখান থেকে জায়গাটা মিনিট পঁচিশেকের পথ তাই আমাকে কাজটা করতে বলল অপারেশান্স ম্যানেজার। আমি রওনা দিলাম। মিনিট তিরিশের মধ্যেই ওখানে পৌঁছে গেলাম। আমি ভেবেছিলাম ৩৫০ লরেল ড্রাইভ কোন একটা বাড়িটাড়ি হবে কিন্তু ওখানে পৌঁছে দেখলাম জায়গাটা ঘুটঘুটে অন্ধকার, সেদিন আবার অমাবস্যা, তাই একটু যেন বেশিই অন্ধকার। ফাঁকা এলাকা, কোন বাড়ি ঘর তো নেইই, উলটে কাছেই একটা গোরস্থান। আমার তো আক্কেল গুড়ুম, বেশ ভয় লাগছিল। মনে হচ্ছিল যেন কোন হরর সিনেমার প্লটে ঢুকে পড়েছি! তবে ফোনটা চলছিল। আমি ম্যানেজারকে ফোন করে চেঁচামেচি শুরু করতে যাচ্ছিলাম, কী রকম জায়গায় পাঠিয়ে দিয়েছে বলে এমন সময় হঠাৎ হেডলাইটের আলোতে দেখলাম একটা লোক এগিয়ে আসছে গাড়িটার দিকে। তার মাথার টুপিটা নিচু করে নামানো, কালো পোশাক অন্ধকারে মিশে আছে। আমাকে সে জিজ্ঞেস করল আমি ট্রিনিটি ক্যাব সার্ভিস থেকে এসেছি কিনা। আমি হ্যাঁ বলতে সে আমার গাড়িতে উঠে বসল। লোকটার আর কিছু দেখিনি, শুধু দেখেছিলাম ওর হাতে একটা চওড়া আংটি, তাতে একটা সিংহের মাথা খোদাই করা। লোকটার আরেকটা বিশিষ্ট ব্যাপার ছিল তার গলার স্বর। গলাটা শুনে আমার আমিতাভ বচ্চনের গলার স্বরের কথা মনে পড়ে গিয়েছিল!” বলে নিজের উপমাতে নিজের হেসে ফেলল হ্যারি।
শিঙ্গাড়ার পর মিষ্টি আর জল খেয়ে আবার শুরু করল সে, “স্টেশানে যাওয়ার পথে আমি ওনার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু উনি হুঁ, হাঁ, ছাড়া কোন কথা বলেননি তাই আমি চুপ করে যাই। ওনাকে স্টেশানে নামিয়ে দিয়ে আমি বাড়ি ফিরে গেলাম। ভাড়াটা আমাকে ক্যাশেই দিলেন। রোজ সকালে বেরবার সময় আমি গাড়ির ভিতরটা একটু পরিষ্কার করে নিই। সেটাই রোজকার রুটিন হয়ে গেছে। পরদিন গাড়ি পরিষ্কার করতে গিয়ে দেখি ওমা আমার সিটের তলায় সেই সিংহের মাথা খোদাই করা আংটিটা! আমি অফিসে ফোন করে ওনার নাম জিগ্যেস করতে ওরা বলল নাম জন স্মিথ আর ঠিকানা ওই ৩৫০ লরেল ড্রাইভ! আগের দিন সময় ছিল না কিন্তু পরদিন আমি গুগল ম্যাপসে চেক করে দেখলাম। ওখানে ওই গোরস্থান ছাড়া আর কিছুই তেমন নেই আশপাশে। ৩৫০ লরেল ড্রাইভ ওই গোরস্থানেরই ঠিকানা। তাও আমি আংটিটা ওনাকে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্যে ওখানে দিনের বেলা গিয়ে দেখলাম। একেবারে ফাঁকা ধুধু মাঠ, কিছুই নেই ওই গোরস্থান ছাড়া। বুঝলাম যে নাম আর ঠিকানা ভুয়ো, দামও ক্যাশে মিটিয়েছে তাই লোকটা যে কে সেটাই বোঝা যাচ্ছে না। ওটা সোনার আংটি তাই দাম আছে, তাছাড়া ওই ধরনের আংটি অনেক সময় অ্যান্টিক হয়। আমি ওনাকে আংটিটা ফিরিয়ে দিতে চাই, কিন্তু উনি কে তাই তো বোঝা যাচ্ছে না। এর পর যেটা ঘটল সেটা বেশ অভাবনীয়। আমার এক খুড়তুতো দাদাও নিউ ইয়র্কে থাকে। বৌদি খুব একটা ইংরেজি বলতে পারে না। ওদের একটা বাচ্চা ছেলে আছে। তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে বললেন একদিন দাদা আমাকে। ওনার কী কাজ পড়ে গেছে তাই যেতে পারবেন না আর বৌদি একা যেতে সাহস পাচ্ছেন না। আমি গেলাম। ক্লিনিকে অনেক ডাক্তার। আমরা বসে আছি এমন সময় এক ডাক্তার বেরিয়ে এসে রিসেপশানিস্টকে কী একটা বললেন। অবিকল সেই গলার স্বর! উনে নিজের চেম্বারে ঢুকে যেতে আমি রিসেপশানিস্টকে জিগ্যেস করলাম। সে বলল উনি শিশুদের নামকরা হৃদরোগ চিকিৎসক ডক্টর স্যানফোর্ড বোম্যান, বেশ নামকরা লোক। এমন সব কঠিন রোগ সারিয়ে তুলেছেন যে লোকে ওনাকে ‘দা ম্যাজিশিয়ান’ বলে। সার্জারির হাতও নাকি খুব ভাল। একদম সদ্যজাত বাচ্চাদের ওপর অপারেশান করে তাদের বাঁচিয়ে তুলেছেন অনেক ক্ষেত্রেই। ওনার গলা শুনে আমি নিশ্চিত ছিলাম যে উনিই আমার সেদিন রাতের প্যাসেঞ্জার। বৌদি আর পুঁচকেকে বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে আবার ফিরে গেলাম ক্লিনিকে। ঝুলোঝুলি করে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে ওনার ঘরে ঢুকলাম।
উনি আমাকে চিনতে পারেননি তাই হেসে অভিবাদন করে বললেন, “আপনার বাচ্চাকে আনেননি?”
আমি বললাম, “আমি আসলে অন্য একটা ব্যাপারে আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। ১৩ই এপ্রিল আমি একজন প্যাসেঞ্জারকে ৩০৫ লরেল ড্রাইভ থেকে তুলে ট্রেন স্টেশানে পৌঁছে দিয়ে আসি। আমার বিশ্বাস আপনিই ছিলেন সেই লোক!” আংটির কথাটা বলিনি তখন অবশ্য।
ভদ্রলোক খুব আশ্চর্য হওয়ার ভান করে বললেন, “নাহ, তা তো হতে পারে না! ১৩ই এপ্রিল তো আমি সেন্ট থমাস কলেজের একটা অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। সেখানে দুশো জনের ওপর লোক আমাকে দেখেছে। তাই আপনি যে জায়গাটার কথা বলছেন সেখানে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভবই নয়!,” বলে উনি হাসলেন।
তবে ওনার সঙ্গে কথা বলে, ওনার গলার স্বর শুনে আমি একেবারে ৯৯ প্রতিশত শিওর যে সেদিন রাতে উনিই আমার গাড়িতে উঠেছিলেন কিন্তু উনি যখন বললেন উনি অন্য জায়গায় ছিলেন তখন তো আর ওনাকে জোর করে বলা যায় না যে না আপনিই ছিলেন। উনি মিথ্যে কথা কেন বলছেন সেটাই বুঝতে পারছি না। ও আচ্ছা আংটিটা ওনারই সেটা কিন্তু জেনে ফেলেছি। মানে ওনাকে জিগ্যেস করিনি কিন্তু ওনার ক্লিনিকের রিসেপশানে যে দুজন মহিলা বসেন তাদের জিগ্যেস করতে একজন খেয়াল করতে পারেনি কিন্তু অন্যজন বললেন, “হ্যাঁ, ওই রকম আংটি ডক্টর বোম্যান পরেন।” তাহলে ডক্টর বোম্যান মিথ্যে কথা বললেন কেন? কী করছিলেন উনি ওখানে সেদিন? একবার ভাবলাম এমনও তো হতে পারে যে ওনার কোন আত্মীয়র কবর আছে ওই গোরস্থানে উনি সেখানেই গিয়েছিলেন তাহলেই তো সোজা সাপটা উত্তর। পরক্ষণেই মনে হল তাহলে তো ওনার নিজের গাড়ি নিয়ে যাওয়া উচিত, সেই গাড়ি করেই ফিরে আসবেন। শুধু ফেরার জন্যে ট্যাক্সি ডাকবেন কেন? গাড়ি খারাপ হলে টো ট্রাক ডাকবেন, ওরাই ওনাকে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করে দেবে। জিগস পাজেলের টুকরোগুলো ঠিক মিলছে না যেন। আমার পক্ষে কিছু বার করা সম্ভব নয় তাই আপনার কাছে এলাম। পুলিশের কাছে ঠিক যেতে চাই না কারণ আসলে তো ব্যাপারটা আমার বেশি কৌতূহল ছাড়া কিছুই নয়, পর্বতের মুষিক প্রসবের মতন ব্যাপার হলে ওরা আমাকে সরকারি সময় নষ্ট করার জন্যে জরিমানা করে দেবে। আপনাকে শুধু এটাই খুঁজে বার করতে হবে যে সেদিনের ওই অ্যাওয়ার্ড সেরেমনিতে উনি কী সত্যিই উপস্থিত ছিলেন? তাহলে ওনার আংটি আর অবিকল ওনার গলার স্বর নিয়ে গোরস্থানে কে গিয়েছিল?”মামা নিজের পেটেন্ট ‘আমি কিন্তু গোয়েন্দা নই, উকিল মাত্র, তবে চেষ্টা করব’ ডায়ালগটা দিয়ে দিলেন তবে হ্যারি সে সব শুনল না। আর কিছুক্ষণ কথা বলে দুপুরের লাঞ্চ খেয়ে অখিলবাবু, নিখিল আর হ্যারি চলে গেল।জিকো বলল, “মামা এ যে গোরস্থানে সাবধান! আমরা গোরস্থানে যাবো?”মামা বললেন, “না, না ওখানে গিয়ে কী হবে? হ্যারি তো গিয়েছিল, ওখানে তো কিছুই নেই! আমি দেখি সেন্ট থমাস থেকে সেদিন উপস্থিত লোকেদের লিস্ট বার করতে পারি কিনা। বেশ অদ্ভুত ব্যাপারটা!”
মা দুপুরের খাবার পর একটু গড়িয়ে নিতে গিয়েছিলেন হঠাৎ নেমে এসে বলেলন, “আমি বলতে ভুলে গিয়েছিলাম। সকালে মিসেস পার্কারের সঙ্গে দেখা হয়েছিল সাগর। উনি তোকে তিনটে নাগাদ যেতে বলেছেন, কী নাকি দরকারি কথা আছে!”মামা বললেন, “উফ! আবার ওনার কলিং বেল কে বাজিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে সেই ধরনের কিছু নয় আশাকরি, তাদের তো ধরেছিলাম!” মা বললেন, “তা জানি না, কি ব্যাপার নিয়ে সে সব কিছু বলেননি।” মিসেস পার্কার ওদের কয়েকটা বাড়ি পরে থাকেন। খুনখুনে বুড়ি বললেই চলে! বয়স ৮৫ মতন হবে, তবে দিব্যি আছেন। একাই থাকেন। পাড়ার কয়েকটা ছেলে বেসবলের টিমের ইউনিফর্মের জন্যে চাঁদা তুলছিল। মিসেস পার্কার কিছু দেননি বলে ওরা রেগে গিয়ে মাঝে মাঝে ওনার কলিং বেল টিপে দিয়ে পালিয়ে গিয়ে ওনাকে বিরক্ত করত। কে বেল টিপছে বুঝতে না পেরে উনি বেশ বিব্রত ছিলেন। মামা তাদের ধরে দিতে তিনি মহা খুশি। কিছু হলেই মামাকে ডেকে পাঠান!তিনটে নাগাদ মামা গিয়ে হাজির হলেন মিসেস পার্কারের বাড়ি, সঙ্গে জিকো-কেকা।
ওদের দেখে মিসেস পার্কার খুব খুশি। পিনাট বাটার কুকিজ খেতে দিয়ে বললেন, “টেসা লরেন্স এখুনি এসে পড়বে।”
“টেসা লরেন্স আবার কে?”
“আমার ম্যাসাজ থেরাপিস্ট। বয়স তো হল। বুড়ো হাড়মাংসগুলোকে ঠিকঠাক রাখার জন্যে ম্যাসাজ নিচ্ছি। খুব আরাম হয়। টেসা ট্রেনিং নেওয়া ম্যাসাজ থেরাপিস্ট, তবে আমাকে খুব সস্তায় করে দেয়। ওর একটা সমস্যা হয়েছে তাই আমি বলেছি তোমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেবো!”
একটু আগেই দুপুরের খাবার সেরে আসা সত্ত্বেও জিকো তিনখানা পেল্লাই সাইজের পিনাট বাটার কুকি খেয়ে ফেলার পর টেসা এসে হাজির হল। বয়স চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ হবে। মাথায় ঝাঁকড়া কালো চুল আর মুখটা বেশ গম্ভীর। ওকে দেখেই মিসেস পার্কার জিগ্যেস করলেন, “কোন খবর পাওয়া গেল তোমার ভাইয়ের ব্যাপারে?”
শুকনো মুখ করে টেসা বললেন, “না!”
“সেকি, পুলিশ কিছু করছে না?”
“ওরা বলছে ডেনি প্রাপ্ত বয়স্ক। নিজের ইচ্ছেতে সে কোথাও গেলে ওদের কিছু করার নেই।”
মিসেস পার্কার বললেন, “হুঁ! আচ্ছা এই হল সাগর, আর এরা জিকো আর কেকা। এদের কথাই তোমাকে বলেছিলাম। সাগর, টেসার ভাই নিখোঁজ কয়েকদিন ধরে। ওকে পাওয়া যাচ্ছে না।”
“ও, তা পুলিশ যখন কিছু করতে পারেনি তখন আমি কী করব? মানে...”
মিসেস পার্কার মামাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বললেন, “পুলিশ তো হাজার হাজার হারিয়ে যাওয়া লোকদের নিয়ে কারবার করছে। একজন বছর চল্লিশেকের লোক কোথায় গেল তাই নিয়ে ওদের এখুনি তেমন মাথাব্যথা নেই কিন্তু লোকটার পরিবারের লোকজনের তো আছে! তুমি একটু চেষ্টা করে দেখলেই জানতে পারবে। টেসা, সাগর কিন্তু বেশ কয়েকটা রহস্যের সমাধান করে ফেলেছে তাই নামটাম হয়ে গিয়ে আমাদের মতন চুনো পুঁটিদের কেস আর নিতে চাইছে না!” মামা এবার লজ্জায় পড়ে গিয়ে বললেন, “না, না, সেরকম কিছুই নয়! আমি একে এখানে থাকি না। জামাইবাবু থাকেন বলে জিকো-কেকাদের সঙ্গে মাঝে মাঝে আসি। তার ওপর আমি তো গোয়েন্দা নই, ভারতে একটা ল ফার্মে কাজ করি।”টেসা বললেন, “যে কোন সাহায্য হলেই চলবে। আমরা একেবারে অসহায় বোধ করছি।” অগত্যা মামা বললেন, “ঠিক আছে, কী হয়েছে আগে শুনি তারপর না হয় অফিসার জুলিয়ানোর সঙ্গে কথা বলে দেখব। ওনাকে আমি চিনি।”
“আমার ভাই ডেনি প্লেস্যান্ট মেডোজ নামের একটা বৃদ্ধাশ্রমে কাজ করে। একাই থাকে একটা অ্যাপার্টমেন্ট নিয়ে। মাঝে মাঝে ওর সঙ্গে ফোনে কথা হয় আর রবিবার দুপুরে আমাদের একটা ফ্যামিলি লাঞ্চ হয় সেগুলোতে আসে। গত রবিবার ও এসেছিল আর নিজের ল্যাপটপটা আমার স্বামী বিলকে দিয়েছিল। বিল ওগুলো ঠিক ঠাক করে দিতে পারে, আগেও করেছে। যাই হোক ল্যাপটপ ঠিক হওয়ার পর আমি ডেনিকে ফোন করলাম কিন্তু ও তুলল না। ডেনি তো ওই রকম কখনও করে না। কাজে ব্যস্ত থাকলে পরে ঠিক ফোন করে। ওর কাজের জায়গায় ফোন করে জানলাম ও দুদিন কাজে যায়নি, কেন ওরা জানে না। সেটাও খুব আশ্চর্যের। তখন আমি আর বিল অ্যাস্টরিয়ায় ডেনির বাড়িতে গেলাম ও অসুস্থ হয়ে পড়েছে কিনা দেখতে। ওর ফ্ল্যাটের একটা চাবি আমার কাছে দিয়ে রেখেছিল ও। ওমা সেখানে গিয়ে দেখি কেউ নেই। পুলিশে খবর দিলাম। ওরা এসে বলল ওর সেল ফোন, মানিব্যাগ, গাড়ি কিছুই নেই যখন তার মানে ও স্বেচ্ছায় কোথাও গেছে। আমি ওদের কী করে বোঝাবো যে ডেনি ওই রকম মানুষই নয়! সব কিছু পরিকল্পনা করে করতে ভালবাসে ও। ওই রকম হুট করে পালিয়ে যাওয়ার মতন লোক নয় ও!”
মামা বললেন, “ঠিক আছে। আমি অফিসার জুলিয়ানোর সঙ্গে কথা বলব। পুলিশ নিশ্চয়ই প্লেস্যান্ট মেডোজেতে কথা বলেছে।”
“হ্যাঁ, গত বুধবারের পর ও আর কাজে যায়নি। আমার মা-বাবাও জীবিত। ওনারাও খুব চিন্তা করছেন। ডেনির কোন বদ অভ্যাস ছিল না। ওর বুদ্ধিটা একটু কম ছিল হয়তো কিন্তু যে কাজটা করত খুব মন দিয়ে করত। ওর কাজের জায়গায় সবাই ওকে খুব ভালবাসত।”
“ওর জামা কাপড় কী কিছু গেছে? মানে সুটকেস ইত্যাদি?”
“সেটা পুলিশও জিগ্যেস করছিল। আমি সেটা বলতে পারব না। ও তো অনেকদিন ধরেই একা একা থাকে তাই ওর জামাকাপড় জিনিসপত্র তেমন চিনি না আমি।”
“ঠিক আছে আমি খোঁজ খবর নিয়ে দেখছি। কিছু জানতে পারলে আপনাকে অবশ্যই জানাবো। আর আপনার ভাই যদি ইতিমধ্যে ফিরে আসে তাহলে আপনি আমাদের জানিয়ে দেবেন প্লিজ।”
ফেরার পথে মামা বললেন, “আজ সকালে কার মুখ দেখে উঠেছিলাম কে জানে, এক দিনে দুটো রহস্য ঘাড়ে এসে পড়েছে! কাউকেই না বলতে পারছি না অথচ দুটো ক্ষেত্রেই কিছু করাটা আমার আয়ত্তের বাইরে! কী যে মুশকিলে পড়া গেল!”
মামা বাড়ি ফিরে ওফিসার জিলিয়ানোর কাছ থেকে অ্যাস্টোরিয়ার পুলিশের নম্বর নিয়ে সেখানে ফোন করে কথা বললেন। কিছুক্ষণ কথা বলে ফোন ছেড়ে বললেন, “ডেনির কেসটা সোজা সাপটা বলেই তো মনে হচ্ছে। বুধবার রাতে প্লেজ্যান্ট মেডোজের এক পুরনো বাসিন্দা মিস্টার টাইক্স মারা যার। ডেনি ওনাকে খুব ভালবাসত। ওনার মৃত্যুতে ও বেশ ভেঙ্গে পড়ে, ওখানকার নার্সরা তাই বলেছে। সেই থেকেই ও মনে হয় মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে কোথাও চলে গেছে। পুলিশের ধারণা কয়েকদিন পরই ফিরে আসবে সে। ডেনির কোন শত্রু ছিল না, সবাই ওকে ভালবাসত আর অন্য কোন দুর্ঘটনার খবর পায়নি ওরা তাই খুব একটা চিন্তিত নয় ওরা কেসটা নিয়ে। আর মোবাইল, মানি ব্যাগ, গাড়ি ইত্যাদি কিছুই যখন নেই তখন ওরা মনে করছে যে মন ভাল করতে কয়েক দিনের জন্যে কোথাও গেছে।”
আরো কয়েকটা ফোন টোন করে এসে মামা বললেন, “সেন্ট থমাস কলেজের অনুষ্ঠানে ওরা সবাইকে টেবিল দিয়ে দিয়েছিল। ৯ নম্বর টেবিলে ডক্টর বোম্যান ছাড়া আরও সাতজন বসেছিলেন। উপস্থিত সবাইকে ঢোকার মুখেই সাইন করে ব্যাজ নিয়ে ঢুকতে হচ্ছিল। ডক্টর বোম্যানও সাইন করে ব্যাজ নিয়েছিলেন। তাও আমি ওনার সঙ্গে বসা বাকি কয়েকটা দম্পতির নম্বর জোগাড় করেছি। তাদের ফোন করে জিগ্যেস করে নেব একবার। কিন্তু আমার মনে হয় হ্যারি কিছু একটা গুলিয়ে ফেলেছে। শুধু গলার স্বর দিয়ে মানুষ নাও চেনা যেতে পারে!”
জিকো বলল, “কিন্তু ওই আংটিটা? ওটা তো উনিই পড়তেন রিসেপশানিস্ট বলেছে!”
“হুঁ, তাও বটে। বিশ্রী প্যাঁচ! ভাবছি ডাক্তারবাবুর সঙ্গে একবার কথা বলব। উনি কী বলেন শোনার জন্যে। দেখি ফোন করে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিই।”
ক্রমশ...
ধারাবাহিক এই রহস্য উপন্যাসটি অঙ্কুরীশা-র পাতায় প্রতি শুক্রবার প্রকাশিত হবে। পড়ুন ও মতামত জানান। সবাই ভালো থাকুন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন