ভ্রান্তি
আজ ছন্দার জন্মদিন । প্রতি বছর আজকের এই বিশেষ দিনটি শুরু হয় ছোটবেলার জন্মদিন গুলোর স্মৃতি রোমন্থন করে । স্মৃতির পাতায় রাখা ঝাপসা চোখের জল মুছতে মুছতে বিছানা ছাড়ল ছন্দা।নাঃ,অনেক দেরী হয়ে গেল ,এবার তৈরি হয়ে তাকে 'কচিপাতা' য় যেতে হবে । বাচ্চাগুলো যে ওর জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে । 'কচিপাতা ' হলো দশ'জন অনাথ বাচ্চা ছেলে- মেয়ের একটি হোম যার পরিচালনার সিংহভাগ দায়িত্ব নিয়েছে ছন্দা । তার এই মহান কাজে সাহায্য করেন এই গ্রামের কিছু সহৃদয় মানুষ।গ্রামের এক সরকারি স্কুলের শিক্ষিকা ছন্দা । স্কুলের কাজের পরে বাকি সময়টুকু দেয় ঐ হোমের বাচ্চাগুলো কে ।ওদের নিয়ে যে ছন্দার অনেক স্বপ্ন ।
একদম ঠিক সময়ে পৌঁছে গেল ছন্দা । এবার যে ছন্দার অবাক হবার পালা । হোম এর ই এক স্চ্ছোসেবিকা মোহরদির সহায়তায় বাচ্চারা কি সুন্দর সাজিয়েছে হলঘরটি । সবাই মিলে আনন্দ করে মোহরদির বানিয়ে আনা কেক কাটা হলো। বাচ্চারা নাচ ,গান ,আবৃত্তি করে ছন্দার মনটা আনন্দে ভরিয়ে দিল । সব্বাই কে আদর করে ছন্দা ওদের জন্য আনা উপহার আর মিষ্টি দিল । ওদের নির্মল হাসিমুখগুলো দেখে ছন্দার আবেগে চোখে জল এসে গেল। ওদের সাথে কথা বলতে বলতেই ছন্দার হঠাত্ খেয়াল হলো,সবাই আছে কিন্তু কলি গেল কোথায়? অন্যদের জিজ্ঞাসা করতে জানল যে কলি দীপা দিদিমণির বাড়ি পড়তে গেছে । দীপাদি সামনের বাড়িতেই থাকে আর এই হোমের বাচ্চাদের পড়ায়। শুনে একটু অভিমান হলো ছন্দার । সব্বাই আজ ওর কাছে এল,একসাথে আনন্দ করলো,আর কলি একবারের জন্যও ছন্দার সাথে দেখা করল না? যদিও 'কচিপাতা'র সব বাচ্চারাই ছন্দার নয়নের মণি তবু কলি একটু বেশি আলহাদী। তাই অন্যদের চেয়ে ওকে একটু বেশিই ভালবাসে ছন্দা। কিন্তু আজ কলির ব্যবহার ছন্দাকে ব্যথিত করল। ওদের সাথে আরও কিছুক্ষণ কাটিযে কলি'র সাথে দেখা না হওয়ার দুঃখ নিয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে এই ভেবে মনটা শান্ত করল যে কলি একটা ছোট্ট মেয়ে, ওর কি এত কিছু বোঝার বয়স হয়েছে যে ছন্দা দিদিমণির জন্মদিনের অনুষ্ঠানে না থাকলে দুঃখ পাবে দিদিমণি?না,না,ওইটুকু মেয়ের উপর ছন্দার অভিমান করা মোটেই সাজেনা।ছন্দা বরং নিজেই আর একবার সনধেবেলা হোমে গিয়ে কলির সাথে দেখা করে আসবে। এইসব নানা কথা ভাবতে ভাবতে কখন বাড়ির সামনে পৌঁছে গেছে । গেট খুলে দরজার তালা খুলতে যাবে,ওমা,দরজার সামনে ওটা কি রাখা ?নীচু হয়ে দেখল,হাতের তৈরি একটা খুব সুন্দর কলম রাখার স্যান্ড আর একটা ছোট্ট চিরকুটে গোটা গোটা হরফে লেখা, 'শুভ জন্মদিন,ছন্দাদিদি,খুব ভালোবাসি তোমায় কলি।'ছন্দা বুঝল যে আজ সকালে এই জিনিসটা কীভাবে বানিয়ে তাকে অবাক করে দেবে, সেটা শিখতেই কলি দীপাদির কাছে গেছিল।অজানা আনন্দে, কি অসম্ভব ভাললাগায় মনটা ভরে গেল আর কলি'র সম্পর্কে অকারণে ভুল ভাবার জন্য নিজের উপরে খুব রাগ হচ্ছিল । কলি'র উপহার বুকে নিয়ে যে পথ দিয়ে এসেছিল,সেই পথ ধরেই ছুটতে লাগল ছন্দা হোমের দিকে ।এখনই গিয়ে কলিকে অনেক আদর ক'রে কপালে, গালে চুমুতে ভরিয়ে দেবে।
মিনুর দুঃখ
প্রতিদিনের মতো আজও রাতে মিনু ঠাম্মার পাশে শুয়ে গল্প শুনছে ।কিন্তু, আজ যে মিনুর গল্প শোনায় একটুও মন নেই। বিকেল থেকেই তার মন খারাপ । কাল যে মিনুর এক মাসের ছোট্ট ফুটফুটে ভাই আর মা আসছে। পুতুলের মতো মিষ্টি ভাই কে নিয়ে যে কি কি করবে, তাই ভেবেই আকুল মিনু ।
সবই তো ঠিক ছিল কিন্তু আজ বিকেলে বাবার কথায় মনটা খারাপ হয়ে গেল ।বাবা অফিস থেকে ফিরে মিনুকে বললেন,"শোন,তুমি তো জানো আজ আমি যাচ্ছি তোমার মা আর ভাইকে নিয়ে আসতে ।তুমি ঠাম্মার কাছে লক্ষী মেয়ের মতো থাকবে আর কাল বিকেলেই আমরা এসে পড়ব।ঠাম্মা কে না বলে বাড়ির বাইরে যেও না ।ও,আরও একটা খুব দরকারী কথা হলো, কাল থেকে তোমার ঐ পুচু কে নিয়ে বাড়ির মধ্যে খেলা করবে না বা বাড়ির মধ্যে পুচু কে কিছু খাওয়াবেও না। মোট কথা, এই বাড়িতে পুচু'র চলাফেরা একেবারে বন্ধ ।বুঝেছ?যাও,এবার তুমি খেলতে যাও।"
বাড়ির সামনের মাঠে গেল মিনু ।ততক্ষণে ওর বন্ধুরা সব খেলা শুরু করে দিয়েছে । মিনু আর খেলবে কি,বাবার কথায় তো মিনুর চোখ ফেটে জল আসছে ।কেমন করে ও পুচুকে না খেতে দিয়ে বা ওর সাথে না খেলে থাকবে?বাবা এত নিষ্ঠুর কেন হলেন ?ওহ,পুচু' র তো পরিচয় দেওয়াই হয়নি।পুচু হলো মিনুর খুব আদরের এক ছোট্ট মেনিবিড়াল। মিনুর সব সময়ের সাথী। মায়ের কাছ থেকে দুধ,মাছভাত এসব নিয়ে মিনুই তো ওকে খেতে দেয় । কত গল্প ওর সাথে করে মিনু আর পুচু চুপ করে শোনে। পুচু কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনোদিন মা,ঠাম্মার রান্না করা খাবারে মুখ দেয়নি । এ হেন ভদ্র বিড়ালের সাথে খেলা করা যাবে না বা ঘরে আনা যাবে না বাবা বলে দিলেন ?আহা, পুচু তো সবসময় ওদের বাড়িতেই বসে থাকে না,সারাদিন এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ায় আর মিনু যখন সময় পায়,ওর সঙ্গে খেলে, গল্প করে, খেতেও দেয়।ও নিশ্চিত যে ভাই এলে পুচুর সাথে ভাইয়ের ও খুব ভাব হয়ে যাবে। তাহলে বাবার এত আপত্তি কেন পুচু কে বাড়িতে ঢোকানোর ব্যাপারে ,সেটা মিনু কিছুতেই বুঝতে পারছে না ।
আজ খেলাতে মন দিতে পারল না মিনু ।ঠাম্মার ডাকে বাড়ি ফিরে হাত মুখ ধুয়ে দুধ বিস্কুট খেয়ে পড়তে বসল।পুচু'র কথা ভাবতেই কান্না পেয়ে যাচ্ছে ,পড়া আজ মাথায় ঢুকল না ।
রাতে ঠাম্মার কাছে গল্প শোনাতেও যে মন নেই ।গল্প বলার সময় মিনুকে চুপচাপ থাকতে দেখে ঠাম্মা নিজেই শুধোলেন, "কি হয়েছে দিদিভাই, আজ একদম চুপচাপ?মুখটা কেমন শুকনো করে আছিস?"মিনু তখন ঠাম্মাকে বাবার কথাগুলো বলল আর তখনই ঠাম্মা ওর মনের অবস্থা টা বুঝতে পারলেন ।বিড়ালের গা থেকে খুব লোম ছড়ায় চারিদিকে আর বাড়িতে খুব ছোট্ট ভাই আসছে ,যার জন্য বাড়ি পরিচ্ছন্ন রাখা ভীষণ জরুরী, তাই তো মিনুর বাবা পুচুকে বাড়িতেই ঢোকাতে না করেছেন ।এসব কথা ঠাম্মা মিনুকে বুঝিয়ে বললেন । কিছুটা বুঝলেও মিনুর মনের কষ্ট মোটেও কমল না,পুচুর কথা ভাবতে ভাবতে ক্লান্ত মিনু ঘুমিয়ে পড়ল ।
পরদিন রবিবার । স্কুল ছুটি, তাই একটু দেরিতেই ঘুম ভাঙল মিনুর।আজ বিকেলে ভাই আসছে মনে পড়তেই যে পুচুর কথা ভেবে আবার মনটা খারাপ হয়ে গেল । ঠাম্মা ডাক দিলেন, "দিদিমণি, উঠে পড়্ ,জলখাবার চটপট খেয়ে নে।" বিছানা ছেড়ে উঠে হাত মুখ ধুয়ে খাবার খেতে খেতে মিনু বলল,"ঠাম্মা, পুচুকে দেখেছ সকালে?" ঠাম্মা উত্তর দিলেন,"ওরে মা, আগে খাওয়া শেষ কর্,তারপর দেখছি তোর পুচু কোথায়?"
খাওয়া শেষ হলে ঠাম্মা মিনু কে নিয়ে বাড়ির পিছনের বাগানে এলেন ।এদিকে একটু জঙ্গল মতো বলে মিনু বড় একটা আসে না ।কিছুটা ভেতরে ঢুকে ঠাম্মা একটা ছোট্ট খড়ের তৈরি ঘরের সামনে এসে থামলেন ।মিনু অবাক হয়ে বলল, "এই ছোট্ট ঘরে কে থাকে ঠাম্মা?"কোন কথা না বলে ঠাম্মা মিনুকে ঘরের মধ্যে উঁকি দিতে বললেন ।ওমা, এ যে অবাক কান্ড । ঘরের মধ্যে পুচু তার সামনে রাখা বাটি থেকে চুকচুক করে দুধ খাচ্ছে।ঠাম্মা বললেন, "আমার মিনু দিদিমণির যে বড্ড দুঃখ হচ্ছিল পুচুর সাথে খেলতে পারবে না, খাওয়াতে পারবেনা বলে,তাই তো আমি ওর জন্য ঘর বানিয়ে দিলাম ।এবার তুই যখন ইচ্ছা পুচুর সাথে এখানে এসে গল্প করে যাবি আর ওকে খাওয়ানোর দায়িত্ব আমি নিলাম।আর একটা কথা, এটা খেয়াল রাখতে হবে যে পুচু যেন কোনোভাবেই আমাদের বাড়ির ভিতরে না ঢোকে।"এর চাইতে ভালো আর কি হতে পারে?মিনু আনন্দে লাফাতে শুরু করল ।ঠাম্মা ওকে সস্নেহে বুকে জড়িয়ে ধরলেন ।
Very well written ... very touchy!
উত্তরমুছুন