ধারাবাহিক গোয়েন্দা উপন্যাস
পর্ব- ৩
একটি মার্ডার : এবং তারপর...
সৈয়দ রেজাউল করিম
গভীর রাত্রে থানায় ফিরে আর কাগজপত্র দেখার মানসিকতা ছিল না যতীন দারোগার। ডিউটির লোকজন যে যার ডিউটিতে গেছে কিনা, কোন দুঃসংবাদ আছে কিনা, কোন মেসেজ পত্র এসেছে কিনা, এসব কিছু দেখে তিনি চলে গেলেন কোয়াটারে।
কোয়ার্টারে
তিনি একাই থাকেন । পরিবার-পরিজনেরা থাকেন ডায়মন্ডহারবারে। এখানে একজন হোমগার্ড থাকে
তার কাছে। সে রান্নাবান্না করে দেয়। দু'জনে খায়। টুকিটাকি কিছু জিনিসপত্র দরকার পড়লে
কিনে নিয়ে আসে। একেবারে যতীন দারোগার আত্মার আত্মীয় উঠেছে এই কয়েকদিনে। তার নাম
হরিহর দাস। কেটে-ছেঁটে এখন শুধুই হরি। সেই হরিই এখন পরপারের মাঝি হয়ে দাঁড়িয়েছে
যতীন দারোগার জীবনে।
রাত্রে
খেয়েদেয়ে বিছানায় শুয়ে টিভির দিকে চোখ রাখলেন যতীন দারোগা। দূরদর্শনে একসময় মানস
মিত্রের ছবি দেখালো। আত্মীয়-স্বজনকে হাওড়া জি.আর.পি. থানার সাথে যোগাযোগ করতে বলল।
এই খবরটা কতজন দেখছে কে জানে ? মৃত মানস মিত্রের পরিবার-পরিজনরা কেউ দেখতে পেলো কিনা
তা কে বলতে পারে ? তবে ব্যাপকভাবে যে সেটা সম্প্রচারিত হয়েছে, এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ
নেই । মানস মিত্রের বন্ধুবান্ধব, স্কুলের সহপাঠী, মাস্টারমশাইদের যদি চোখে পড়ে, তাহলেও
তারা চিনতে পারবে। এর একটা সুরাহা নিশ্চয়ই দু'-একদিনের মধ্যে পাওয়া যাবে। এসব কথা
ভাবতে ভাবতে একসময় ঘুমিয়ে পড়লেন যতীন দারোগা।
পরদিন
সকাল আটটায় যথারীতি হাজির হলেন হাওড়া জি.আর.পি. থানাতে। নিজের অফিস চেম্বারে বসে
প্রথমে দৈনন্দিন কাজগুলো সারলেন। দৈনিক খবরের কাগজের পাতা উল্টে দেখলেন। তারপর মৃত
মানস মিত্রের ফোল্ডারটা নিয়ে বসলেন। খুব মনোযোগ সহকারে এক একটি পাতা দেখতে থাকলেন।
খাতার অধিকাংশ পাতা জুড়ে আছে শুধু কষা অঙ্ক, আর অঙ্ক। অন্য খাতায় ইংরেজি এস.এ.। প্যাসেজ,
গ্রামার। খুঁজতে খুঁজতে এক জায়গায় দেখতে পেলেন, ছোট ছোট হরফে লেখা আছে 'সুমতি কোচিং
সেন্টার', বাগনান।
যতীন
দারোগা মনে মনে হিসাব কষতে থাকেন, মানস মিত্রের খাতার পাতায় 'সুমতি কোচিং সেন্টারের'
নাম লেখা আছে কেন? তাহলে কি মানস মিত্র ওই কোচিং সেন্টারে কোচিং নিত? হাওড়ার এ প্রান্ত
থেকে ও প্রান্তে পড়তে যেত? না কি মানস মিত্রের বাড়ি বাগনানের কাছাকাছি? তাহলে কেন
সে রামরাজাতলার দিকে আসছিল সে ? এরকম আরও অনেক প্রশ্ন মাথার ভেতর ঘুরছিল যতীন দারোগার।
সেসব প্রশ্নের উত্তর থানার চেয়ারে বসে পাওয়া যাবেনা। সরজমিনে তদন্ত করে দেখতে হবে।
এইসব জায়গাগুলোতে যেতে হবে।
জ্যোতিষ
বাবু থানাতে গিয়ে বিভিন্ন থানার ও.সি, আই.সি-দের সাথে যোগাযোগ করলেন। জানতে চাইলেন
তাদের থানায় কোন মিসিং পার্সেনের রিপোর্ট হয়েছে কিনা? তারা সকলেই মৃত মানস মিত্রের
ছবি পেয়েছে কিনা? কিন্তু কোথাও থেকে কোন সদর্থক উত্তর পেলেন না। জ্যোতিষবাবু ভেবে
পেলেন না, একটা জলজ্যান্ত ছেলে মারা গেল, অথচ তার কোনো খোঁজ-খবর করবেনা বাড়ির লোকজন! এরকমটা কখনো হতে পারে? আবার এটাও হতে পারে, মৃতের আত্মীয়-স্বজনরা হয়তো অন্যদিকে
খোঁজাখুঁজি করছে। হয়তো ভাবছে ছেলে মামার বাড়িতে দু-চার দিন কাটিয়ে আসবে। হয়তো কলকাতায়
বন্ধু-বান্ধবদের মেসে থাকছে। নতুন কলেজে ভর্তি হবার জন্য আগাম প্রস্তুতি নিচ্ছে। ফিরে
আসবে ঠিক সময়ে। তাদের সেই সব ভাবনার কি আর কোন শেষ আছে?
মৃত্যুর
খবর পেয়ে বিভিন্ন থানা থেকে পাঁচ-সাত জন লোক সদলবলে এসেছে হাওড়া জি.আর.পি. থানাতে।
তাদের ছেলে বা আত্মীয় স্বজন কিছুদিন আগে মিসিং হয়েছে হাটে, মাঠে, ইস্কুল থেকে। অনেকে
আবার কর্মস্থল থেকে ফেরার পথে। তারাও দেখতে এসেছে, চিনতে এসেছে, মৃতদেহটি তাদের হারানো
কোনো স্বজন কিনা ? জ্যোতিষ বাবু মৃতদেহের বিভিন্ন পোজে তোলা ছবি গুলো এক এক করে দেখালেন
সবাইকে। তারা গভীর আগ্রহের সাথে ছবিগুলো দেখল। কিন্তু কেউ বলল না, মৃতদেহটি তাদের পরিচিত
স্বজন । বিফল মনোরথে তারা ফিরে গেল যে যার বাড়িতে। জ্যোতিষ বাবু পড়ে গেলেন মহাফ্যাসাদে।
সুস্থভাবে
চিন্তাভাবনা করে কোন একটা পথ যে বার করবেন, তারও কোনো উপায় নেই থানা ফাঁড়িতে। নানান
ঘটনায় ব্যতিব্যস্ত হয়ে থাকতে হয় সর্বক্ষণ। ছোট-বড় নানান ঘটনা ঘটতে থাকে স্টেশন
চত্বরে। টিকিট চেকারদের সাথে প্যাসেঞ্জারদের, মুটেদের সাথে যাত্রীদের, হকারদের সাথে
সাধারণ মানুষদের, কাদের মধ্যে না বিবাদ হয় ? এরমধ্যে চুরি, বাটপারি, মারামারি, সব
ধরনের অপরাধ ঘটে। ট্রেনের মাধ্যমেই আসে মাদকদ্রব্য, সোনাদানা, বিদেশি জিনিসপত্র ইত্যাদি।
সবই চোরাপথে। কোন দিকে দৃষ্টি রাখবে পুলিশ প্রশাসন ? তাদের চোখে ধুলো দিয়ে অভিষ্ঠ
লক্ষ্যে পৌঁছে যায় অপরাধীরা। এমনকি এই পথ দিয়েই হয় নারী পাচারের মতো জঘন্যতম অপরাধ
কাজ। তার কজনই বা ধরা পড়ে পুলিশের হাতে ?
মৃতদেহের
ছবি দেখতে আসা লোকজন সব চলে গেলে মেজবাবু গিয়ে ঢুকলেন যতীন দারোগার চেম্বার। অনেকক্ষণ
ধরে যতীন দারোগা উসখুস করছিলেন মেজবাবুর সঙ্গে কথা বলার জন্য। মেজ বাবুকে সামনে পেয়ে
তাকে বসতে বললেন চেয়ারে। মেজবাবু বসলে তাকে এক এক করে বললেন সমস্ত ঘটনা। মৃতের ফোল্ডার
থেকে পাওয়া সব তথ্য। সব শুনে মেজবাবু বললেন-- তাহলে আমি বাগনান থেকে ঘুরে আসি স্যার? কিছুনা কিছু তথ্য ওখানে পাওয়া যেতে পারে স্যার!
যতীন
দারোগা কিছু বলার আগেই দুজন লোক কে ধরে নিয়ে এলো ডে-পেট্রোলিং কনেস্টেবলরা। কিছু জিজ্ঞাসা
করার আগেই শুনতে পেলেন বাইরের হই চই রব। পর্দার ফাঁক দিয়ে দেখলেন জনা পঞ্চাশ প্যাসেঞ্জার
চলে এসেছে থানার সামনে। তাদের কি অভিলাষ, কিসের এত আগ্রহ, তা যাচাই করতে গেলে অনেক
সময় ব্যয় হবে। তাই তিনি চোখ তুলে তাকালেন আসামী ও কনেস্টেবলদের দিকে । কনেস্টেবল
স্বপন দে বলল-- স্যার ! ষোল নম্বর প্ল্যাটফর্মের পাটনা এক্সপ্রেস ট্রেন এসে দাঁড়িয়েছে
কিছুক্ষণ আগে। আমরা ওখানে ডিউটি করছিলাম। এই দুজনকে দেখে আমাদের কেমন যেন সন্দেহ হয়
। ওদেরকে দাঁড়াতে বলি। ওরা ভয় পেয়ে ব্যাগপত্তর ফেলে ছুটে পালিয়ে যাচ্ছিল। চিত্ত,
সতীস দৌড়ে ওদের ধরে ফেলল। মনে হয় ব্যাগে কোন সন্দেহজনক জিনিস নিয়ে যাচ্ছিল।
যতীন
দারোগা এক এক করে তাদের নাম ঠিকানা জিজ্ঞাসা করলেন। কোন ব্যাগটা কার তাও জেনে নিলেন। বিহারের ছাবরায় ওদের বাড়ি। দুই বন্ধু। নাম ঝন্টু প্রসাদ ও কমলা প্রসাদ। তাদের ব্যাগ
সার্চ করে পাওয়া গেল সাতটি দেশি পিস্তল, দু' ডজন গুলি, হাজার পাঁচেক টাকা। জিজ্ঞাসাবাদ
করে জানা গেল বিহারের মুঙ্গের থেকে আগ্নেয়াস্ত্রগুলো কিনে নিয়ে এসেছে তারা। ভাটপাড়া
থেকে অর্ডার দিয়েছিল দুটো পার্টি। তাদেরকে সাপ্লাই দিয়ে দিতে যাচ্ছিল তারা।
যতীন
দারোগা আর দেরী না করে ছোট বাবু সুনির্মল নাগকে ডেকে বললেন-- আর্মসগুলো সিজ করুন। সিজার
লিস্টে জ্যোতিষ বাবু সিগনেচার করবে। কমপ্লেনও দেবে। আর এই কেসটা তুমি তদন্ত করবে। ঝন্টু
ও কমলা প্রসাদকে ভালো করে জিজ্ঞাসাবাদ করে বাকি আসামিদের ধরে নিয়ে এসো। ভাটপাড়ায়
কার কাছে অস্ত্রগুলো সাপ্লাই দিতে যাচ্ছিল তাদেরকেও ধরে নিয়ে এসো। ও.সি. ভাটপাড়াকে
আমি ফোন করে বলে রাখছি।
সুনির্মল বাবু বললেন--
ঠিক আছে স্যার !
আর
জ্যোতিষ বাবু মনে মনে ভাবলেন-- মানুষ ভাবে এক, ভগবান করেন আর এক। কোথায় যাবার কথা
ভাবলেন, আর কিভাবে তিনি আটকে পড়লেন। বড়বাবুর নির্দেশ মতো তিনি গুছিয়ে একটা অভিযোগ
পত্র লিখে দিলেন। আসামীদের নামে। সিজার লিস্টে সই করলেন। আসামীদের সই করালেন। ফরেনসিক
ল্যাবরেটরীতে পাঠাবার জন্য অস্ত্রগুলো আলাদা করে প্যাক করে লেবেল সেঁটে দিলেন। লেবেলে
সই করালেন। এসব কাজ করতে করতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামল। বাগনানে আর যাওয়া হলো না
মেজবাবুর।
অগত্যা
মেজবাবু হাজির হলেন বড়বাবুর কাছে । বড়বাবু অফিসিয়াল কাগজপত্র সব দেখছিলেন। মেজবাবুর
আগমনবার্তা বুঝতে পেরে মুখ নিচু অবস্থায় বললেন-- মেজবাবু ! কিছু বলবে ?
জবাবে
মেজবাবু বললেন-- হাঁ স্যার ! বলতে এসেছিলাম আজ তো আর বাগনানে যাওয়া হলো না, কাল সকাল
সকাল সন্তোষকে সাথে নিয়ে আমি বেরিয়ে যাব বাগনানে। কেসটা ডিটেকশন করতে না পারলেই নয়,
সুপিরিয়র অফিসাররা আপনাকে ছেড়ে কথা বলবেনা। জবাব দিতে দিতে আপনার প্রাণ ওষ্ঠাগত হবে।
যতীন
দারোগা বললেন-- ঠিক আছে, চলে যেও। আমি আই. সি. বাগনান কে বলে রাখছি, তিনি তোমাকে একটা
অফিসার দিয়ে দেবেন। 'সুমতি কোচিং সেন্টার' তোমাকে খুঁজে পেতে অসুবিধা হবে না।
একথা
বলে ফোন ঘুরিয়ে আই. সি. বাগনান, ডি. কে. গাঙ্গুলীকে ধরার চেষ্টা করলেন। তিনটে রিং
বাজতে না বাজতেই ফোন ধরলেন গাঙ্গুলী বাবু। যতীন দারোগার গলা শুনে তিনি উচ্ছ্বসিত। সব
শুনে তিনি বললেন-- কিছু চিন্তা করবেন না স্যার ! আপনি জ্যোতিষকে পাঠিয়ে দিন। আমি সব
ব্যবস্থা করে দেব। একজন অফিসার ডিটেল করে রেখে দেব। কিছু চিন্তা করবেন না। আমি সবরকম
সাহায্য করে দেব। সম্ভব হলে আজই 'সুমিতি কোচিং সেন্টার' এর লোকেশনটা দেখে আসতে বলব।
যতীন
দারোগা বললেন-- ধন্যবাদ ভাই! এই উপকারটুকু করলে আমি বেঁচে যাব।
আজকাল
গ্রাম-শহরের প্রতিটা জায়গায় কোচিং সেন্টারের প্রচলন হয়েছে। সেটা যুগের প্রয়োজনে,
নাকি উপার্জনের প্রয়োজনে, সেটা নির্ধারণ করবে কে? আজকাল কি স্কুল, কলেজ ভালো লেখাপড়া
হচ্ছে না ? শিক্ষক মহাশয় বা অধ্যাপকরা কি এ ব্যাপারে উদাসীন? তবে একটু গাইডেন্স পেলে
যে ছাত্রছাত্রীরা অনেক বেশি ভালো রেজাল্ট করতে পারে, তার প্রমাণ নানা স্থানে গজিয়ে
ওঠা কোচিং সেন্টারগুলো। বেকার যুবকদেরও উপার্জনের একটা মোক্ষম পথ হল কোচিং সেন্টার
খুলে বসা। সেখানে কিছু স্কুল-কলেজের শিক্ষকদেরও নিয়োগ করে রাখে তারা। সেখানে বিভিন্ন
বিষয়ে, বিভিন্ন সময়ে ছাত্র-ছাত্রীদের পড়িয়ে থাকেন তারা। বিনিময়ে ভালো সাম্মানিকও
পেয়ে থাকেন। আর ছাত্র-ছাত্রীদের যোগান দিতে হয় বিষয়ভিত্তিক নির্দিষ্ট টাকা।
এরকম
প্রতিষ্ঠান বাগনান শহরে অনেকগুলোই আছে। তার ক'টার আর হিসাব রাখেন আই.সি. সাহেব? তবুও
যতীন দারোগার কথা শুনে তাকে আশ্বস্ত করলেন। তিনি বললেন-- জ্যোতিষকে পাঠিয়ে দিন স্যার! আমি টাউন বাবুকে বলে রাখছি। নিশ্চয়ই ওরা খুঁজে পাবে 'সুমতি কোচিং সেন্টার।'
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
এই বিভাগে লেখা পাঠান
মতামত জানান
ankurishapatrika@gmail.com
বেশ ভালো লাগছে ঘটনা প্রবাহ।
উত্তরমুছুন