বরেণ্য নাট্যব্যক্তিত্ব শম্ভু মিত্রঃ শ্রদ্ধা ও স্মরণে
- অনীশ ঘোষ
প্রয়াণের ২৪ বছর পরেও জনমনে অমর হয়ে আছেন বরেণ্য নাট্যব্যক্তিত্ব শম্ভু মিত্র
বাংলা তথা ভারতের এক কিংবদন্তি মঞ্চ ও চলচ্চিত্র অভিনেতা, নাট্যকার, নির্দেশক ও খ্যাতনামা আবৃত্তিশিল্পী ছিলেন শম্ভু মিত্র। আজ তাঁর ১০৫তম জন্মদিন। ১৯১৫ সালের ২২ আগস্ট কলকাতার ভবানীপুর অঞ্চলে মামার বাড়িতে জন্ম তাঁর। পৈত্রিক ভিটে ছিল হুগলির কলাছাড়া গ্রামে। বালিগঞ্জ সরকারি বিদ্যালয়ের পাঠ শেষে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ভর্তি হলেও কলেজ শিক্ষা শেষ করেননি। । ১৯৩৯ সালে বাণিজ্যিক থিয়েটার দিয়ে শুরু তাঁর মঞ্চাভিনয়। প্রথমে রঙমহল, সেখান থেকে মিনার্ভা থিয়েটারে। ‘কালিন্দী’ নাটকে অভিনয়ের সূত্রে কিংবদন্তি নট ও নাট্যগুরু শিশিরকুমার ভাদুড়ির সঙ্গে তাঁর আলাপ হয়। পরে শিশিরকুমারের প্রযোজনায় ‘আলমগীর’ নাটকে অভিনয় করলেও বরাবরই তিনি নাট্যজগতে একেবারেই নিজস্ব একটা ঘরানা গড়ে তুলতে আগ্রহী ও উদ্যোগী ছিলেন। ১৯৪২ সালে ফ্যাসিবিরোধী সঙ্ঘ এবং ’৪৩–এ তৎকালীন সি পি আই দলের সাধারণ সম্পাদক পি সি যোশির সঙ্গে পরিচয় ঘটার পর যোশির ডাকে যোগ দেন ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘে। ’৪৫ সালে সেখানে কাজ করতে করতেই বিশিষ্ট মঞ্চাভিনেত্রী তৃপ্তি মিত্রের সঙ্গে পরিচয় ও বিয়ে হয় তাঁর। দেশের স্বাধীনতার পরের বছর, ১৯৪৮–এ মনোরঞ্জন ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে গড়ে তোলেন বিখ্যাত ‘বহুরূপী’ নাট্যদল। ’৪৯ থেকে টানা ’৭১ পর্যন্ত বহুরূপী প্রযোজিত একাধিক নাটক অভিনীত হয় তাঁর নির্দেশনায়। রবীন্দ্রনাথ, সফোক্লিস, ইবসেন, তুলসী লাহিড়ী প্রমুখের লেখা সেগুলি প্রতিটিই মঞ্চনাট্যাতিহাসে প্রবল সাড়া ফেলে। শম্ভু মিত্র নির্দেশিত ‘নবান্ন’, ‘ছেঁড়া তার’, ‘রক্তকরবী’, ‘চার অধ্যায়’, ‘রাজা অয়দিপাউস’, ‘রাজা’, ‘বিসর্জন’, ‘পাগলা ঘোড়া’, ‘দশচক্র’, ‘পুতুলখেলা’ বা স্বরচিত ‘চাঁদ বণিকের পালা ইত্যাদি নাটকগুলি ছিল তৎকালীন সময়ে একেকটা কালজয়ী হীরের টুকরোর মতো প্রযোজনা! ’৭০ সালে একটি আর্ট কমপ্লেক্স গড়ার উদ্দেশ্যে বঙ্গীয় নাট্যমঞ্চ সমিতি গড়ে তোলেন তিনি। সমিতির প্রযোজনায় অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশনায় মঞ্চস্থ হয় ‘মুদ্রারাক্ষস’ নাটকটি। শম্ভু মিত্র নিজেও তাতে অভিনয় করেন। কিন্তু প্রয়োজনীয় জমির অভাবে শেষ পর্যন্ত সেই উদ্যোগটি আর বাস্তবায়িত হয়নি।
১৯৭৬ সালে নাটক ও সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য শম্ভু মিত্র ভূষিত হন আন্তর্জাতিক ম্যাগসেসে পুরস্কারে। সে বছরই ভারত সরকার তাঁকে সম্মান জানায় পদ্মভূষণে। ’৭৭ সালে বিশ্বভারতীর ভিজিটিং ফেলো হন এক বছরের জন্য। বহুরূপীতে তাঁর অভিনীত শেষ নাটক ‘দশচক্র’, ’৭৮–এর ১৬ জুন। এর পর ’৭৯–তে প্রায় দৃষ্টিহীন অবস্থায় নান্দীকার প্রযোজিত ‘মুদ্রারাক্ষস’–এ চাণক্যর চরিত্রে এবং ’৮০–৮১ সালে ফ্রিৎজ বেনেভিৎজের নির্দেশনায় ক্যালকাটা রেপার্টারির ‘গ্যালিলিওর জীবন’–এ অভিনয় করেছিলেন। কন্যা শাঁওলি মিত্রের পরিচালনায় ’৮৩ সালে ‘নাথবতী অনাথবৎ’ নাটকেও অভিনয় করেন। শাঁওলির নাট্যদল পঞ্চম বৈদিকের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে আমৃত্যু যুক্ত ছিলেন। ’৮৫–র সেপ্টেম্বরে পঞ্চম বৈদিক প্রযোজিত ‘দশচক্র’ নাটকটির নির্দেশনা–সহ রবীন্দ্রসদনে পরপর ছটি শোয়ে অভিনয়ও করেন নিজে। সেই ছিল তাঁর শেষ মঞ্চাভিনয়। জ।ওতিরিন্দ্র মৈত্রর ‘মধুবংশীর গলি’ কবিতাটির আবৃত্তি তাঁর কণ্ঠে আজও অমর হয়ে আছে। রবীন্দ্রকবিতাপাঠেও তিনি ছিলেন অনন্য। বেশ কিছু হিন্দি ও বাংলা চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন শম্ভু মিত্র। এর মধ্যে ‘একদিন রাত্রে’ ও রাজ কাপুর–কৃত এটিরই হিন্দি ভার্সন ‘জাগতে রহো’র কথা অবশ্যই বলতে হয়।
’৮৩ সালে বিশ্বভারতী তাঁকে ‘দেশিকোত্তম’ উপাধি দিয়ে সম্মান জানায়। বিশ্বভারতী ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় সাম্মানিক ডি লিট–এও ভূষিত করে। ’৯৭ সালের ১৯ মে কলকাতায় নিজের বাড়িতে প্রয়াত হন কিংবদন্তী এই নাট্যব্যক্তিত্ব। মারা যাওয়ার আগে ইচ্ছাপত্রে লিখে গেছিলেন— ‘আমি সামান্য মানুষ, জীবনের অনেক জিনিস এড়িয়ে চলেছি, তাই মরবার পরেও আমার দেহটা যেন তেমনই নীরবে, একটু ভদ্রতার সঙ্গে, সামান্য বেশে, বেশ একটু নির্লিপ্তির সঙ্গে গিয়ে পুড়ে যেতে পারে।’ তাঁর ইচ্ছানুসারেই দাহকাজ সম্পন্ন হওয়ার আগে পর্যন্ত সংবাদমাধ্যমে কোনও খবর জানানো হয়নি তাঁর মৃত্যুর বিষয়ে। নীরবে প্রয়াণের পর ২৪ বছর পেরিয়ে গেলেও আজও মানুষের মনে অমর হয়ে আছেন এই বরেণ্য শিল্পী।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন