।। প্রতিদিন বিভাগ।।
।। জুন সংখ্যা।।
বিষয় - গল্প ( ৪০০ শব্দের মধ্যে) —৮
আত্মোপলব্ধি
জয়শ্রী সরকার
সুজয়ের টাই ঠিক করতে করতে অন্বেষা বললো, 'অফিস থেকে ফেরার পথে রবীন্দ্রনাথের 'শেষের কবিতা' উপন্যাসটা এনো তো '। 'পেলে অবশ্যই আনবো' বলে দ্রুত বেরিয়ে গেল সুজয়।
রবিবার এলেই সকাল আটটার সময় সুজয় আর অন্বেষা উন্মুখ হয়ে বসে প্রিয় রেডিওটার সামনে। শুরু হয় 'শিশুমহল'। সঞ্চালিকার মিষ্টি কন্ঠের সঞ্চালনা আর ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের আধো আধো স্বরে আবৃত্তি আর গানে মুখর হয়ে ওঠে গোটা অনুষ্ঠান। এরই মধ্যে ব্রেকফাস্টটা সেরে নেয় ওরা। অদ্ভুত এক আকর্ষণে আবিষ্ট হয়ে ওঠে ওদের মন। ছোট্ট ভবনটা যেন এক আলোকিত ভুবন হয়ে ওঠে। অনুষ্ঠান শেষে এক বুক অক্সিজেন নিয়ে ওরা বাস্তবে ফেরে। বুকের থেকে অসহনীয় জগদ্দল পাথরটা যেন একটু একটু করে সরে যায়। এ এক অন্য আবেশ। অন্য অনুভূতি ! না পাওয়ার যন্ত্রণাটা কিছু সময়ের জন্য হলেও লাঘব হয়।
অন্বেষা একটা কিন্ডারগার্টেন স্কুলে পড়াতো। নিঃসন্তান হওয়ার কারণে সহকর্মীদের নানান টিকাটিপ্পনী শুনতে শুনতে ক্লান্ত অন্বেষা শেষমেশ চাকরিটাই ছেড়ে দিয়েছে। আঘাতে আঘাতে ছিন্নভিন্ন ওর মাতৃসত্তা।
সুজয় বেরিয়ে যাওয়ার পর নিঃসন্তান অন্বেষা নিজেকে নিয়ে বসলো। অনেক কাটাছেঁড়া করলো নিজেকে। যেন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেই নিজের প্রতিপক্ষ। এ এক অন্য অন্বেষা। একেবারেই নিরপেক্ষ। সুগভীর ভাবনায় ডুব দিল অন্বেষা। 'এতদিন নিজের কথাই ভেবেছি। পরস্পরকে ভালোবেসে আমাদের বিয়ে। সুজয় কেন ওর অক্ষমতাকে স্বীকার করে না ---- একবারও ভেবেছি? সুজয়ের যন্ত্রণা এমনিতেই কুরে কুরে খাচ্ছে ওকে। সেখানে আমিও যদি ------- । কথায় কথায় নারীনির্যাতন নিয়ে সোচ্চার হই আমরা। কিন্তু পুরুষের যন্ত্রণা, তার অন্তর্দহন কোনোদিন হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করেছি কী? পুরুষের ঘাম দেখলেও অশ্রু দেখতে পাই কী?' মায়ের কথাগুলো মনে পড়ে গেল অন্বেষার -----'দ্যাখ্ অনু, দাম্পত্যসুখের চাবিকাঠিই হলো আন্ডারস্ট্যান্ডিং, অ্যাডজাস্টমেন্ট আর স্যাক্রিফাইস ! তুই তো তবু চাকরি ছেড়ে দিয়ে রেহাই পেয়েছিস । কিন্তু সুজয়? ওকেও তো একই সমস্যায় পড়তে হচ্ছে । তবু , চাকরিটা ওকে করতেই হচ্ছে । একটু ওর দিকটাও ভাবিস । নিজেকে আত্মবিশ্লেষণের এ্যানাটমি টেবিলে বসিয়ে ডিসেকশন করছে অন্বেষা। আমূল পরিবর্তন এল অন্বেষার মধ্যে। এও কী সম্ভব !
সেদিন সন্ধ্যে থেকেই প্রচন্ড ঝড়, সেইসঙ্গে মুষলধারে বৃষ্টি। অন্বেষার অন্তর্দেশেও চলছে তুমুল তোলপাড়। প্রশ্নের পর প্রশ্নে বিদ্ধ করছে নিজেকেই। দু'চোখে বাঁধভাঙা বৃষ্টি। একসময় শান্ত হলো আকাশ। ঝড়ও গেল থেমে। অন্বেষা আকুল হয়ে অপেক্ষা করছে সুজয়ের জন্য। অবশেষে, সুজয় এলো। একেবারেই কাকভেজা। 'শেষের কবিতা' কিন্তু অক্ষত। টাওয়েল নিয়ে অন্বেষা ছুটে এলো। অফিস ব্যাগ থেকে বইটা বের করে অন্বেষার হাতে দিল। খুশিতে আত্মহারা অন্বেষা। রাত্রে একান্তে সুজয়কে বললো, 'অনাথ শিশুদের জন্য একটা আশ্রম গড়তে চাই, তুমি পাশে থাকবে তো?'
দুই বাহু দিয়ে সুজয় ওর প্রশস্ত বুকে অন্বেষাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে নিল !
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন