লেবেল

শনিবার, ১৮ জুলাই, ২০২০

পার্থেনিয়ামের ইতিহাস (পর্ব- ৬)।। - শঙ্কর তালুকদার






         পার্থেনিয়ামের ইতিহাস(পর্ব- ৬)
                     - শঙ্কর তালুকদার 

 

পার্থেনিয়াম  আগাছাটি সম্পর্কে সাধারণের সাথে আলোচনা করাতে  গিয়ে সকলের সচেতনতায় এই বিষাক্ত উদ্ভিদটিকে ধ্বংশ করার উদ্দেশ্যে এটির বিস্তার নিয়ন্ত্রণের প্রসঙ্গটি বারবারই উঠে আসছে মানব সমাজের সামগ্রিক  স্বাস্থের ও পরিবেশ তথা গৃহপালিত পশুদের কথা মাথায় রেখেই ; কি ধরণের ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয় সেগুলির উল্লেখের মাধ্যমে এই আলেখ্যটির মূল লক্ষ্যে উপনিত হতে আমার প্রচেষ্টার " পার্থেনিয়ামের ইতিহাসে"র এটি ৬ষ্ঠ পর্ব!

গবাদিপশুর ক্ষতি:


আগের পর্বে ( ৫ম পর্ব ) যে কটি অসুখ ও অসুবিধার কথা উল্লেখ করেছি, পশুদের ক্ষেত্রেও উপরোক্ত সব রোগগুলোই হতে পারে, বিশেষ করে মানুষের সঙ্গে, মানব বসতির মধ্যে যে গৃহপালিতরা বাস করে তাদের জন্য তো বটেই । সেগুলোর মধ্যেই ‘পার্থেনিয়াম আগাছা’ যুক্ত মাঠে গবাদি পশু চরাণো হলে পশুর শরীর ফুলে যাওয়া, তীব্র জ্বর সহ নানা রোগে আক্রন্ত এবং বদ হজম দেখা দেওয়ার ঘটনাও প্রায়সই ঘটে থাকে সেটির ও সম্ভবত পূর্বে উল্লেখ রয়েছে।

প্রকৃতপক্ষে পার্থেনিয়ামের ক্ষতিকারক জৈবিক ভাবে সকৃয় ( Bioactive) রাসায়নিক পদার্থগুলি  জীবদেহের যে কোন স্থানে লাগলে স্বাভাবিক অনাক্রম্যতার কারণে সেখানে এলার্জি হতে পারে এবং ক্রমে সেটি ভয়ানক অনিরাময়যোগ্য চর্মরোগ ডেকে আনে।

এছাড়া পার্থেনিয়ামের সূক্ষ্ম রেণু বাতাসে ভর করে দেহের উন্মুক্ত অঞ্চল, যেমন মুখ নাক,চোখ কান বা পায়ু পথে ভেজা মিউকাস যুক্ত দেহাংশে বা শ্বাস নালীর দেয়ালে পৌঁছোয় এবং সেখানে জৈব রস ও জলের প্রভাবে সহজেই অঙ্কুরোদগম হয় তথা নরম মিউকাস ভেদ করে জৈবীক বৃদ্ধি লাভ করতে থেকে দেহের প্রভুত ক্ষতি সাধন করে , যা প্রতিরোধ করতে দেহে ভয়ানক সব অজানা এলার্জি বা ট্রপিকাল রোগ  সমূহের উদ্ভব হয়।



এত ক্ষতি কারক জীবটির প্রকৃতিতে বিকশিত হবার মত ঘটনা এক তরফা ঘটতে দেখে মনে হতেই পারে যে - তাহলে প্রকৃতি এই জীবটিকে সৃষ্টি করেছিল কেন ?

এমন ভাবনার অন্বেষণে মানুষ পাশাপাশি খুঁজে এসেছে- যে কি গুন রয়েছে এই জীববৈচিত্রটির ?
তাঁর ই সন্ধানে উদ্ভিদ-কৃষিবিদরা যে মৃদু আলোর সন্ধান পেয়েছে সেটির এখানে উল্লেখ রাখলাম!

পার্থেনিয়ামের গুন

পর্যবেক্ষণে দেখা যায় যে, সূর্যমুখী বংশের অন্য উদ্ভিদদের মতই এঁদের ও গুণ রয়েছে জৈব প্রকৃতিতে নাইট্রোজেন তৈরিতে।

পশ্চিমবঙ্গে এমন কোনও জায়গা খুঁজে পাওয়া যাবে না যেখানে পার্থেনিয়াম নেই। এর ক্ষতিকর প্রভাবের জন্য মাঝে মাঝে সাফাই চলে। কিন্তু প্রকৃতির উত্তরে দেখা যায় যে, গুণও রয়েছে পার্থেনিয়ামের।

পার্থেনিয়াম ক্ষতিকর হলেও এর রয়েছে বেশ কিছু ঔষধি গুণ; রয়েছে সবুজ সতেজ দেহ জুড়ে উদ্ভিদের দেহের গঠনের বিভিন্ন উপাদানের প্রাচূর্য্য; যেটি কে মাথায় রেখে এই সর্বনেশে জীববৈচিত্রটিকে অন্যভাবে মানব কল্যানে তথা প্রকৃতির বিকাশে কাজে লাগানো যায় কি না, সেটিও ভাবা হচ্ছে !

 বর্তমানে এই আগাছা থেকেই মানুষের আমাশয়, প্রচণ্ড জ্বর, বদহজম, টিউমার, ক্যান্সারসহ নানা ধরনের জটিল রোগের প্রতিষেধকের সন্ধানে গবেষণা চলছে !
 তৈরি সম্ভাবনায় রয়েছে বিভিন্ন প্রতিষেধক ও নিরাময়ের ঔষধ।




উত্তর আমেরিকায়, জিকারিলা অ্যাপাচি জাতীয় লোকেরা ওষুধের জন্য পার্থেনিয়াম ইনকানাম ব্যবহার করেছিল (ওপলার 1946: 8)।
'গয়েলের স্যাপ' নামের ঐ ওষুধটির পি.আরজেন্টামের গবেষণা পত্রে যার উল্লেখ রয়েছে।

পার্থেনিয়ামের ফুল ফোটার আগে গাছগুলিকে খুব সাবধানে কেটে নিয়ে গোবরের মধ্যে বেশ কিছুদিন ডুবিয়ে রেখে পচিয়ে নিলে গোবর সারের মধ্যে নাইট্রোজেনের পরিমাণ বেড়ে যায়। যা ফসল উৎপাদনের পক্ষে খুবই সহায়ক। 

 ফসলের জন্য পার্থেনিয়াম কি ধরণের ক্ষতি সাধন করে :

আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, এ আগাছা ফসলের উৎপাদন প্রায় চল্লিশ শতাংশ কমিয়ে দেয়। বিশেষ করে ভূট্টার ক্ষেত্রে এ আগাছা ফল ধরার পর প্রাথমিক অবস্থায় মোচার ফল ধারণ ক্ষমতা ত্রিশ শতাংশ হ্রাস করে। এছাড়া ধান, ছোলা, সরিষা, গম, বেগুন, এবং মরিচের ক্ষেত্রে এ আগাছা বীজের অঙ্কুরোদগম ও বৃদ্ধি কমিয়ে দিয়ে ফসলের ফলন অনেকাংশে কমিয়ে দেয়।‘’ 

পার্থেনিয়ামে এত ক্ষতিকর কেন ?


একটা কথা আছে কলাগাছের কোনো অংশই নাকি ফেলা যায় না । সবটাই কাজে লেগে যায়। আর এই গাছের সমস্ত অংশটাই ক্ষতিকারক। গোঁড়া থেকে আগা পর্যন্ত। এর পরাগ ক্ষতিকর , ডালপালা সবটাই ক্ষতিকর।


এ আগাছা এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থ নিঃসরণ করে যা প্রাথমিক ভাবে ঐ পরিবেশের প্রায় সকল প্রকার উদ্ভিদের প্রকৃতি সংলগ্ন অংশে (মূল ও কান্ডের যে অংশের সাথে এই গাছের কোন অংশের স্পর্শ হতে পারে) এবং সেইমত অন্যান্য ফসল জাতীয় উদ্ভিদের সামগ্রিক বৃদ্ধি কমিয়ে দেয়।

এখন কথা হল কেন ক্ষতিকর?

এই গাছে যে ক্ষতি কারক sesquiterpene lactones এই নামের টক্সিন থাকে, তার জন্ম ই এরা এত ভয়ানক আগাছার চেহাড়া নিয়েছে;
এখন প্রশ্ন থেকে যায়-
প্রকৃতির জৈব অভিব্যক্তির নিয়মে এমন ধ্বংশাত্মক জৈবনিক ক্রিয়ার কি প্রয়োজন হয়ে পরেছিল ?

সন্ধান চলছে সেই বিশেষ প্রাকৃতিক কারণের, আগামী দিনে যা বলতে পারবে sesquiterpene এর মত ক্ষতিকারক রাসায়নিকটির প্রাথমিক উপাদান - caffeic acid, vanillic acid, ansic acid, p-anisic acid, chlorogenic acid, এবং parahydroxy benzoic acid এর মত জৈব-রাসায়নিকগুলি পৃথিবীতে কি উদ্দেশ্যে সৃষ্ট হয়েছিল- আর কি সেই উদ্দেশ্য ছিল এদের এরুপ সমন্বয় ঘটার?  যেটি মানুষ সহ অন্যান্য জীবের পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকর।

পার্থেনিয়াম দমন-


প্রতিটি সচেতন মানুষের উচিত যার যার এলাকার মানুষকে পার্থেনিয়াম গাছের ভয়াবহতা সম্পর্কে সচেতন করা। 
এটিতে মূলতঃ স্প্রেয়ার মেশিনের সাহায্যে লবন জল ছিটিয়ে পার্থেনিয়াম গাছ নষ্ট করার মাধ্যমে সকৃয় ভাবে সাড়া দেওয়া যেতে পারে। 



পার্থেনিয়াম ধ্বংস অভিযানে অংশ নিয়ে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থারাও প্রতিনিয়ত কাজ করে গেলেই সাড়া দেশে এই উদ্ভিদের স্বতস্ফূর্ত বিস্তার রোধ করা যেতে পারে মাত্র।গত কয়েক বছর আগেও এই জাতীয় গুল্ম আমাদের কাছে অপরিচিত ছিল। 

কিন্তু শেষ ক’বছরে তা বহুগুন বেড়ে গেছে। 
মূলতঃ মেক্সিকো থেকে গমের সাথে আসা এই পার্থেনিয়াম উদ্ভিদ বছরে চারবার বীজ থেকে চারা তৈরী করে; তাছাড়া খুব সহজেই এদের বৃদ্ধি ও বিভিন্ন প্রকারের জননের( যৌন জনন ও অঙ্গজ জনন) কারণে এবং একই বাস্তুসংস্থানের অন্য উদ্ভিদ প্রজাতীর বিস্তারটিকে ঋণাত্মক ভাবে প্রভাবিত করেই এদের এরূপ ভয়ানক বিস্তার । যার থেকে শিশু থেকে বৃদ্ধ ও গবাদি পশুরা সকলেই কম বেশী আক্রান্ত হচ্ছেন।

(ক্রমশ)


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন