লেবেল

রবিবার, ২০ ফেব্রুয়ারী, ২০২২

অমর একুশে... কাব্যনাট্য ভাষাজননীর কান্না — স্বপন শর্মা।।Ankurisha।। E.Magazine।। Bengali poem in literature।।



কাব্যনাট্য 

ভাষাজননীর কান্না

  স্বপন শর্মা

( ২১শে ফেব্রুয়ারির নতুন সকালের সুর্য হাসছে। আকাশ বাতাস যেন বিষাদ্গ্রস্ত ভাষাশহিদের বেদনগানে । নতুন    প্রভাতী আলোকে  এক দীপ্তিময় নারীর আবির্ভাব। গর্বের হাসি মুখে , এক আশ্চর্য তৃপ্তির মুখাবয়ব দেখে বিস্মিত এক  যুবক  সামনে   দাঁড়ায়। গঙ্গার তীরে অনন্তের স্রোত পিছনে রেখে যুবকের  দিকে তাকিয়ে সে নারী পরিতৃপ্তির হাসি হাসে যুবকের মনের মধ্যে পুঞ্জীভূত মেঘ ধীরে ধীরে সরে যায়  কৌতূহলী সে দাঁড়িয়ে পড়ে । )   

যুবকঃ সূর্যকরোজ্জল সকাল আর সামনে তুমি  যেন প্রভাতী সূর্যের আলোয় গড়া । কে তুমি ?                                                    

ভাষাজননীঃ আমি ভাষাজননী।  আজকের এই শুভ দিনে আমার  শৃঙ্খলমোচন হয়েছিল। তাই প্রাণোচ্ছ্বল দেখতে চাই আমার শত-সহস্র আমিকে।

যুবকঃ বুঝেছি ২১শে ফেব্রুয়ারি তোমাকে স্মরণের দিন, বরণেরও। তাই তুমি অনন্তের প্রবাহ থেকে জাগ্রত  এলে যেন অনশ্বর।  

ভাষাজননীঃ আমি চিরজাগরূক। আমার  চলার বাঁকে বাঁকে আমার রূপ বদলায় এটাই আমার  চরিত্র ও মাধুর্য।   যে ভাষায় তুই কথা বলিস , তেমনি একটি  দেশের ভাষাজননী আমি।  ফলে চিরস্থায়ী  গর্বের প্রতীক  স্মরণ আমার সেই পুত্রদের  , যারা আমার মুক্তির জন্য জীবনকে বাজি রেখেছিল।                                         

চেয়েছি উদযাপন শোনো ভাবীকাল

কখনো চাইনি জেনো মুক্তা ও প্রবাল

আমার মুখের ভাষা উড়ে যেন ফুল                         সন্তান কুড়ায় সব সানন্দে নির্ভুল ।   

যুবকঃ  শোনো ভাষাজননী। সন্তান  আমিও, তোমার ভাষায় হৃদয়ের বন্ধ দুয়ার উন্মুক্ত করি। কিন্তু তোমার আসন্ন  মৃত্যুর সম্ভাবনায়  আমি যে শঙ্কিত ।       

ভাষাজননীঃ অসম্ভব, আমি মৃত্যুহীন। এ শঙ্কা অমূলক।                           

যুবক ঃ  কেন ?          

ভাষাজননীঃ, মাতৃদুগ্ধ পান করে  সন্তান মাকে ভুলে  যেতে পারে ? আমার মুখের ভাষায়  প্রথম মা ডাক শুনে  যে শিহরন, সেটা অন্য মা ই শুধু অনুভব করতে পারেন। আর কী বললি ? আমার মৃত্যু আসন্ন ? কিন্তু কেন ?    

যুবকঃ  তোমার কি মনে হয় না বঙ্গবাসীর হৃদয় থেকে তোমার পরিচর্যা যতটুকু প্রয়োজন,   আমরা তা করি না। আসলে বাঙালি চিরকাল আত্মঘাতী। পৃথিবীতে সবচেয়ে সুমিষ্ট ভাষার প্রতিমূর্তী  তুমি, অন্তত এই মুহূর্তে। কিন্তু  বিস্মরণের কুয়াশা আমাদের মনের উন্মুক্ত প্রান্তর ঢেকে দিয়েছে বলে আজ ঔপনিবেশিক ঘোরে আচ্ছন্ন। বিজাতীয় বুলি তোমাকে উপহাস করে। ফলে আজ এক বেদনার্ত বিস্ময়ে  মনের চোখে দেখি এক অদেখা অক্টোপাস তোমাকে ঘিরে তোমার কন্ঠরোধ করে  তোমাকে রাক্ষসের মতো গিলে খেতে চাইছে ? আমারা বাঁচাতে  অক্ষম ।

ভাষাজননীঃ কোটি কোটি সন্তানের একজন  তুই। তাই এমন বলছিস ?  আসলে প্রিয়জন তার খুব কাছের মানুষের  অমঙ্গলটাই  তার মনের চোখে দেখতে পায়।

যুবকঃ   তোমার স্নেহে , তোমার বুকের উষ্ণতায় সিক্ত লক্ষ লক্ষ সন্তান তোমাকে উপেক্ষা করে জ্ঞান অর্জন   করছে অন্য  ভাষায় । আর রাষ্ট্রভাষা ও ইংরেজির মিশ্রণে সৃষ্ট এক কিম্ভূতকিমাকার রূপ তোমার প্রতিদ্বন্দ্বী 

 আশংকার কালোমেঘ ঘনিয়েছে দেখো

 তুমি যে বিলুপ্ত হবে বহু ভাষা জননীর মতো       

ভাষাজননীঃ পৃথিবীতে কিছুই স্থায়ী নয় । আশংকা হবে কেন?  কবিগুরু বলেছিলেন না , সত্যেরে লও সহজে । যদি সত্যিই দূরবর্তী ভবিষ্যতে আমার মৃত্যু হয়,  তোরা ভুলে যাস বিজাতীয় ভাষাকেই নিজের  মা বলে ভাবিস। 

যুবকঃ কত সহজে , কত নির্লিপ্তভাবে তুমি কথাগুলো বলে দিতে পারলে। আসলে তোমার শূন্য হৃদয়ে  রয়েছে এক অশ্রুত কান্না। সংবেদনশীল সন্তান সেটা বুঝতে অপারগ নয় ।     

ভাষাজননীঃ ভেবে দেখ, কজন তোর মতো হৃদয় দিয়ে বুঝতে পারে ভবিতব্য, তাই তো নিজের ভাষা, নিজের সংস্কৃতি, নিজের ঐতিহ্যের প্রতি অবহেলা। যে জাতি নিজের ভাষাজননীকে  উপেক্ষা করে , ভবিষ্যতে শুধু সন্তানের  বৈষয়িক সমৃদ্ধির অলীক আলোয় নিজেকে দেখতে চায়, সে জাতি তো আত্মঘাতী হবেই। নিজের মাকে  চেনার বা জানার কোন আকাঙ্ক্ষাই নেই। ফলে যা হবার হবে । আমি মোটেই বিচলিত নই ।  

যুবকঃ কিন্তু আমি যে বিচলিত , আশঙ্কিতও বটে। জানি, জীবনের দাবি অনেক বড়ো ।  সে জন্যই তোমাকে ভুলে , গড্ডলিকা প্রবাহে ভেসে চলেছি  উজ্জ্বল ভবিষ্যতের আশায় বিজাতীয় ভাষার কদর।  বাঙালির এ প্রজন্ম  ও তাদের  সন্তানেরা শিখছে অন্য ভাষা হয়ত জীবনের প্রয়োজনে।  যারা তোমার প্রতি শ্রদ্ধাশীল,  তারা কিন্তু স্রোতের  অনুকূলে ভেসেও তোমার সেবা ও পরিচর্যায় রত। বিদেশি ভাষা আত্মস্থ করেও তোমার প্রতি সমান শ্রদ্ধাশীল।  তোমার পরিচর্যা ও প্রসারে তাঁরা নিবেদিত প্রাণ ।      

ভাষাজননী ঃ জানিস তো , সংবেদনশীলতা সবার এক হয় না । যারা  আমার সাহিত্য,  ইতিহাস, সংস্কৃতি,  ঐতিহ্য এবং পরম্পরা ভুলে যেতে চায় , তারা তো আমাকে চিনতেও  চায় না,  জানতেও চায় না আসলে এটা নিয়ে আমি ভাবি না । তোর মতো সন্তানের যা কর্ত্তব্য, তা-ই কর। কাজের মধ্যে দিয়েই প্রমাণ কর  আমার প্রতি তোদের আবেগ ও ভালোবাসা।

যুবকঃ ঠিকই বলেছ ভাষাজননী  তোমার মুক্তির দিনে এসব অসুভ কথা ছেড়ে একটাই শুধু গান হোক, ‘মোদের  গরব মোদের আশা, আ মরি বাংলা ভাষা    (গান)   

ভাষাজননীঃ আমার প্রশস্তিতে আমি আপ্লুত। তবে যদি অন্তরে স্থান দিতে না পারিস, তা হলে মিথ্যা এই সুরের প্রবাহ।    

যুবকঃ  পুণ্য এ বঙ্গভূমিতে আজ শপথ নিচ্ছি, তুমি যাতে সব ক্ষেত্রে সমাদ্রিত হও, সে চেষ্টাই আমরা করে যাব।  যত্ন নেব   তোমার পরিচর্যায় আর প্রসারে

 ভাষাজননীঃ শুনে খুশি হলাম । আমার জন্য তোর যে সব ভাইয়েরা শহিদ হয়েছে তাদের আজ স্মরণের দিন । বরকত , সালাম  জব্বার  ও রফিকের জন্য  প্রাণ কাঁদে। প্রাণ কাঁদে আরও এগারোটি সন্তানের জন্য যাঁরা আমার  প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে  বিভোর হয়ে পুলিশের গুলিতে  প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিল অসমে। ওরা সবাই সমস্বরে চিৎকার করে বলেছিল  “ জান্ দেব , তবু জবান দেব না ‘’।  ওদের জান চলে গেছে, তবু জবান হারায়নি।   

যুবকঃ কিন্তু সবচেয়ে বিদারক সত্যটি শুনে যাও, অসমের সেই শহিদ সন্তানেরা আজো শাসকের  চোখে দুষ্কৃতির   তকমায়  কলংকিত ।  শহিদ সেই ভাই –বোনেদের কলঙ্ক আজও মোছানো সম্ভব হয়নি।     

ভাষাজননীঃ আমি শুধু সময়ের ওপর ছেড়ে দিচ্ছি সব। প্রতিশোধ নিক জীবন্ত ইতিহাস।  হে অনন্ত জলরাশি,  হে মহাপৃথিবী,  হে ভূলোক ও  দ্যূলোকের সম্রাট, পুণ্যাত্মা আমার শহিদ  সন্তানেরা যেখানেই রয়েছে,  ওদের সামনে এনে দাও। আমার চোখের জলে স্নান করিয়ে আবার ফিরে যাব অদৃশ্যে। আর তুই দৃশ্য থেকে অদৃশ্যের সেতু গড়ে সেই সেতুতে শহিদ ভাইদের আবাহন করে একে একে মালা পরিয়ে দিস।

যুবকঃ বেশ তাই হবে, ভাষাজননী ।

 দূরাগত তুমি হঠাৎ মূর্ত এলে

 দেখে নিয়ো মাগো, তোমার কান্না যাবে না বিফলে

 ফিরে যাবে যদি, যাও

 অলক্ষ্যে থেকে  বিমূর্ত তুমি

 স্মৃতিতর্পণে শহিদ স্মরণ দেখো ।

 

ভাষজননীঃ     উড্ডীন থাক রক্তে রাঙানো জয়ের পতাকা

বাজুক বিষাদ বাঁশি

 অঙ্কুরিত হোক নতুন প্রভাতে শস্যের বীজ

খুশি শস্যেরা শহিদের গান গাক

    জননীর পাশাপাশি।

  আমার কন্যা শহিদ কমলা তারও জীবন গেল

    আমার চোখের অশ্রুতে ভিজে

     প্রথম মহিলা  ভাষা শহিদের মর্যাদা পেল

  বিদায় পৃথিবী, থাকবই আমি বাঙালির মুখেমুখে      থাকবে শহিদ সন্তান যত গর্বে জয়ের সুখে                                                                                                           ( যুবকের সামনে থেকে সে নারী  ধীরে ধীরে  বিলীন হয়ে যায় , বিলীন হয়ে যায় এক অলৌকিক আলোকের উদ্ভাস। শুধু প্রতিধ্বনিত হতে থাকে যুবকের প্রতি  ভাষা জননীর আর্ত আবেদন। সেই আবেদনে সাড়া দিয়ে যুবক শহিদের স্মৃতিতে পুস্পার্ঘ্য নিবেদন করে)                                                                                  (সমবেত সংগীতঃ আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারি--


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন