রবিবাসরীয় বিভাগ
আজকের গল্প
দম
সন্দীপ দত্ত
জুতোর তলায় মরচে ধরা একটা পেরেক ছিল শিবুর। কাল বিকেলে বিল মাঠ দিয়ে আসার সময় চৌধুরীদের বাড়ির মূল ফটকের কাছে যখন সে পাগলা কুকুরের ভয়ে ছুটতে ছুটতে এসে খানিক দাঁড়িয়ে পড়ে হাঁপায়,অসাবধানবশত তখনই ওটা বিঁধে যায়। শিবুর আজ মনে হল,ভাগ্যিস বিঁধেছিল। নইলে সবার কাছে আজ এভাবে হিরো হওয়া যেত না।ফুলকির কাছে তো নয়ই। মেয়েটা একদিন রূপের দেমাক নিয়ে বলেছিল,"পেশিবহুল সলমন খান চাই আমি। তাকত দিয়ে যেদিন আমায় খুশি করতে পারবি,সেদিন আমি তোর।" কথাগুলো মনে পড়ে গেল শিবুর। মনে পড়তেই আড়চোখে ফুলকির দিকে তাকাল সে। মেয়েটার চোখদুটো এখন খাপ খোলা তরবারির মতো চকচক করছে। শরীর জুড়ে উদ্দামতার বিদ্যুৎ। হাতের তালিতে শুধু উচ্ছ্বাস আর আস্ফালন। চিৎকার করে বলছে,"মার,মার শিবু,আরও মার। মারতে মারতে একেবারে শেষ করে দে। বড্ড সাহস লোকটার!"
শিবুকে যেন নেশায় পেয়ে গেল। মারের নেশা। এলোপাথাড়ি লাথি আর লাথি। দম নেওয়ার সময়টুকু পর্যন্ত দিল না লোকটাকে। ঠোঁটের কোণ বেয়ে ঝরে পড়া রক্তকে মোছবার ফুরসৎ দিল না এতটুকু। অনর্গল নামতে থাকা নাকের রক্তটাও গতি পেয়ে টপটপ করে পড়তে থাকল মাটিতে। সতেরো বছরের ফুলকির বুকের দিকে তাকিয়ে নিজেকে রোমিও মনে করে শিবু বলল,"লোকটা তোর সাথে অসভ্যতামি করেছিল? সত্যি কথা বল। এক্ষুণি ওর হাতদুটো ভেঙে গুঁড়িয়ে দিই।"
বলতেই পারত ফুলকি। সহজেই বলতে পারত অনেক কথা। এমন সুযোগে ইচ্ছেমতো রটানো যায়। মনোজের বউ যেমন রটালো। কুসুমভোরে তার পরনের কাপড় ধরে টেনে ছিল লোকটা। শিকারী হায়েনার মতো লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল বুকের দিকে। এরকম আরও অনেক কথাই বলল অনেকে। গ্রামশুদ্ধ সবাই। সকলের চোখেই ঘৃণা আর আগুন। বাপের বয়েসি একটা লোক,তার আবার এত নোলা! ছিঃ!
পলাশের নিকোনো দাওয়াতে সদ্য সদ্য হাট থেকে দু'দিন আগে কিনে আনা চোখজুড়োনো টর্চ'টা দেখতে না পেয়েই সে ছুটে এসেছে। এসেই তেরিয়া দেখাল খুব। আজকাল চোর ধরা পড়লে তাকে গাছের সঙ্গে বাঁধা হয়। তারপর কিল,চড়,ঘুসি মারার প্রতিযোগিতা চলে। লোকটার মুখের সমস্ত কথা কেড়ে নিয়ে পলাশ ঠিক করল,তাকে গাছেই বাঁধা হবে। পুলিশকে খবর দেওয়ার দরকার নেই। ওরা আসবেও কচ্ছপের মতো। বরং তারাই আইন নিয়ে খেলা করুক। আজকাল কোন কাজটা আইনি পথে হয়? মারতে মারতে তাই তারা লোকটাকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে চাইছিল। সমস্ত শরীর যখন রক্তে রাঙা হয়ে গেছে তার,কোনওরকমে উঠে দাঁড়াতে গিয়েও পড়ে যাবে এমন অবস্থা,খবর পেয়ে হন্তদন্ত হয়ে প্রধান এসে সকলকে শান্ত হতে অনুরোধ করে লোকটার দিকে তাকালেন। "নাম কী তোমার?"
"আজ্ঞে সদানন্দ।"
প্রধান দেখলেন,লোকটি যথেষ্ট বুড়ো। যতখানি বয়েস হলে চুল পেকে শন হয়ে যায়,দাঁতের গোড়া আলগা হতে শুরু করে,শারীরিক ক্ষমতা কমতে কমতে পথ চলতে অসুবিধে হয়।
লোকটার ছানি কাটা মোটা কাচের চশমার দিকে তাকালেন প্রধান। যার ডানদিকের অংশটা মারতে মারতে ভেঙে ফেলেছে মানুষগুলো। "এ গাঁয়ে ঢুকলে কেমন করে? মতলবখানা বলো দেখি!"
প্রধানের কথায় হাউমাউ করে কেঁদে উঠল সদানন্দ। রক্তমাখা মুখে গড়িয়ে নামা অশ্রু একাকার হয়ে গেল। "কোনও মতলব নেই বাবু। আমি পিছিয়ে পড়েছি। ছোকরাদের সাথে আমি কি পারি? ওরা ঘোড়ার মতো ছোটে আর আমি কোথায়......."
সদানন্দের কথা শেষ করতে দেয়না শিবু। "পিছিয়ে পড়েছ মানে? যাচ্ছ কোথায় তুমি? সঙ্গে আছেটাই বা কারা?"
"সে অনেক লোকলস্কর বাবু। কাল সাঁঝের বেলা গোরক্ষপুরের হাট ভাঙতেই রটে গেল আজ থেকে চাঁদপুরের মাঠে ডাকসংক্রান্তির মেলা। তাই আমরা চলেছি ওখানে। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে সরু রাস্তা ধরে পথ হেঁটেছি সারারাত। ভোরের আঁধারে এ গাঁয়ে এসে থমকে গেছি আমি। ওরা পিছন ফিরে তাকায়নি।"
"কীসের দোকান তোমাদের?" মনোজের বউ জিজ্ঞেস করে।
"খাবারের দোকান মা। গজা,জিলিপি আর পাঁপড়। মালিকের তৈরি করে যাওয়া ব্যবসা। নতুন নতুন ছেলেরা কি পারে? পুরনো কর্মচারী হিসেবে মালিকের মৃত্যুর পর মালকিন তাই আমায় রেখে দিয়েছেন। আপনারাই বলুন,এই বয়েসে আমি কি আর পারি? মালকিন কোনও কথাই শুনছেন না। খালি বলছেন,আমায় থাকতে হবে। আমার হাত নাকি জাদু। খদ্দের টানতে ওস্তাদ।" কথাগুলো বলে সদানন্দ ঠোঁট থেকে গড়িয়ে নামা রক্ত মোছার চেষ্টা করে। পারেনা। হাতদুটোতে বেদম ব্যথা। বুড়ো হাড়। মারতে মারতে ওরা ভেঙে ফেলেনি,এই যা।
দু'চোখ ছলছল করে ফুলকির। পায়ে পায়ে সে এগিয়ে যায় সদানন্দের কাছে। পরম যত্নে চুড়িদারের ওড়না দিয়ে মুছিয়ে দেয় রক্ত আর লালা। মুছিয়ে দেয় চোখের জল। মনোজের বউ,হেমন্তর বউ নিয়ে আসে খাওয়ার জল।
পেট ভরে জল খায় সদানন্দ। ঢেঁকুর তোলে। ততক্ষণে তার খোঁজ করতে করতে গাঁয়ে এসে ঢোকে দুটো দেহাতি চেহারার শ্যামলা ছেলে।
"তাই বলি,বুড়ো গেল কোথায়? তা এখানে বসে কী করছো গো তুমি? ভাগ্যিস পেছন ফিরে একবার তাকিয়ে ছিলাম। নাও,তাড়াতাড়ি চলো। কী যে করো তুমি!"
সর্বাঙ্গে ব্যথা নিয়েও খিলখিলিয়ে হাসে সদানন্দ। "তোদের সাথে আমি কি আর পারি রে? বুড়ো বুকের দম! বুঝতেই তো পারছিস।"
কুসুমভোরের গায়ে সূর্যের আলো এসে লাগছে তখন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন