স্বাধীনতার৭৫
মুক্ত গদ্য — ৯
স্বাধীনতা পঁচাত্তোর
দেবব্রত ভট্টাচার্য্য
১৯৪৭-এর স্বাধীনতা দিবস পালনের পর দেশ নেতা বললেন -
-আগামী আর কোনো বছর স্বাধীনতা দিবস উদযাপন হবে না। মানে একটি বিশেষ দিনকে স্বাধীনতা দিবস হিসেবে পালনের প্রয়োজন হবে না। সবাই অবাক ! জন্মদিন পালন হয়, মৃত্যু দিন পালন হয়, বিবাহবার্ষিকী, বন্ধু দিবস, বাবা দিবস, মা দিবস, শিক্ষক দিবস -- সব পালন হবে, শুধু স্বাধীনতা দিবসটাই পালন হবে না !
দেশনেতা বললেন - -মুসলিমরা প্রতিদিন নামাজ পড়েন , তার জন্য কোনো বিশেষ দিন লাগে না। হিন্দু ব্রাহ্মণ রা প্রতিদিন ত্রিসন্ধ্যা গায়ত্রী জপ করেন। বিশেষ দিন দেখে গায়ত্রী জপের কথা বললে বিষয়টা কেমন দাঁড়াবে ? আসুন না প্রতিদিন সকালে পতাকা তুলবো আমরা। জয় ভারত, জয় জগৎ বলে দিন শুরু করি। কোনো একটি বিশেষ দিন দেখে অন্যান্য কাজ সরিয়ে রেখে ছুটি কাটাবো, এ কেমন স্বাধীনতা দিবস উদযাপন ? যদি আমরা প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তে পারি, যদি ত্রিসন্ধ্যা গায়ত্রী জপ সম্ভব হয়, তবে প্রতিদিন কেন স্বাধীনতা মন্ত্র পাঠ করতে পারবো না আমরা ?
সত্যি ! এ ভাবে ভাবিনি তো ! আমি প্রতিদিন কতটা অন্ধকার সরালাম, কতটা আলো দু হাতে বয়ে আনলাম, সেটাই তো স্বাধীনতার মন্ত্র জপ। এমন দিন কি সত্যিই আসবে ? অন্তত চেষ্টা করা যেতে পারে তো !
দেশ নেতার ইচ্ছে ইচ্ছেই থেকে গেছে! স্বাধীনতা দিবস কেবল একটা দিনই । মনে একে অপরকে পরাধীন করে রাখার বাসনা নিয়ে কি আর স্বাধীনতার পূজা করা যায় ? সে তো মিথ্যার বেসাতি। রাজনৈতিক নেতা চাইছেন প্রভুত্ব করতে, কোটিপতি ব্যবসায়ী চাইছেন প্রভুত্ব করতে, এমন কি একই পরিবারের মধ্যে প্রভুত্বের লড়াই। এও তো এক ধরনের উপনিবেশ বাদ।
একটি চারাগাছ যত বড় হয় তত ই তার সতেজ ডালপালা বিস্তৃত হতে থাকে। শেকড় আর ও গভীরে প্রবেশ করে। জমিতে তার অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। যেদিন আমাদের স্বাধীনতা অঙ্কুরিত হয়েছিল, তৎকালীন জননেতা, দেশ চিন্তা সর্বস্ব মহামানবেরা ভেবেছিলেন সময়ের সঙ্গে সঙ্গে স্বাধীনতা শব্দের প্রকৃত অর্থ প্রতিটি মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে যাবে। দেশমাতার প্রতি কর্তব্য বোধ যে মানুষের কল্যাণ সাধনের নামান্তর, এ বোধটুকু অচিরেই হৃদয়ঙ্গম হবে। সেদিন স্বাধীনতার সুবাস দেশ মহাদেশের গণ্ডী ছাড়িয়ে বিশ্বে পরিব্যপ্ত হবে। হায় রে সময়, তুমি তোমার পথে এগিয়ে গেলে। কিন্তু সে গতির সাথে আমার দেশবাসী সঙ্গী হলো না। আজ আমার ভারত তার সংকীর্ণ দীন মানসিকতা নিয়ে অন্ধকারময় অপুষ্টি রোগে জীর্ণ। কোনো আশার আলো নেই, প্রভাত আলোর প্রার্থনা নেই। অন্ধকার ই ভবিতব্য ভেবে বর্তমান প্রজন্ম সে পথেই পিছিয়ে চলেছে দ্রুত গতিতে।
এ অবস্থায় স্বাধীনতা দিবস কেবল ক্যালেন্ডারের পাতায় আটকে থাকে। আর স্বাধীনতা শব্দটির অপব্যাখ্যা বা উপব্যাখ্যা জন্ম নেয়। কথা বলার স্বাধীনতা যথেচ্ছ শব্দ প্রয়োগের উৎশৃঙ্খলতার জন্ম দেয়। পোশাকের স্বাধীনতা অশালীনতার জন্ম দেয়। আচরণের স্বাধীনতা অপসংস্কৃতি বুনে চলে সমাজের কোনে কোনে। আত্মসুখী স্বার্থসর্বস্ব মানুষ স্বাধীনতা কে নিজের ভোগবাদের হাতিয়ার করে নিয়েছে। এর ফলে নতুন একটা দেশ গড়ে না জন্ম নেয় পুতিগন্ধময় নরক। আমরা এখন সেই নরকের বাসিন্দা।
আঠারো বছর বয়স কি দুঃসহ -কবি কোন্ অসহনীয়তায কথা বলেছেন ? যেদিন ক্ষুদিরাম -প্রফুল্ল চাকি বোমা হাতে রাস্তার অন্ধকারে দাঁড়িয়েছিল, তখন তাদের বয়স কত ছিল ?ঝাঁসীর লক্ষ্মীবাই এর হাতের তরবারি দুপুর রোদে ঝলসে উঠেছিল, মনে পড়ে ? তখন ও তিনি অষ্টাদশী। জাহাজ থেকে ঝাঁপিয়ে সমুদ্রের গভীরে হারিয়ে যেতে চেয়েছিলেন সাভারকার, তখন তাঁর বয়স কত ? প্রদ্যোত -অনাথ বন্ধু প্যাডি -ডগলাস -বার্জ এর বুকে যখন আগুনে বারুদ ভরা বুলেট গেঁথে দিয়েছিল, তখন ঠিক তারা কত বয়সের ? সত্যিই আঠারোর দুঃসহ যন্ত্রণা তাদের ঘরের নিশ্চিন্ত আশ্রয় থেকে টেনে বাইরে এনেছিল -শুধু একটা নতুন কবিতা লিখবে বলে। মায়ের শৃঙ্খল মোচনের কবিতা।
আজকের আঠারোর দিকে তাকিয়ে বড় ক্লান্ত হয়ে পড়ি। ওরা হয় কিছু ডিগ্রীর বিণিময়ে নিশ্চিন্ত একটা জীবন খুঁজে নিতে চায় ,নয়তো রাজনীতির ঘোলা জলে আখের গোছানোর জাল পাতে। ওদর চোখ গুলোর দিকে তাকাই। মরা চোখের গভীরে কোনো ভাষা জাগে না। কোনো প্রতিজ্ঞা নেই ওদের কলিজায় উজ্জ্বল অতীত কেবল ইতিহাসের পাতায় বন্দী হয়ে থাকে। মুখে শুধু সমালোচনা । অন্যের কল্পিত অপরাধ খুঁজে চলেছে ওরা। ভেঙে যাওয়া আরশির খন্ডিত কাঁচের টুকরোয় না পড়ে যৌবনের ছায়া, না জ্বলে ভবিষ্যতের দীপ শিখা। এ কোন্ কালের অবক্ষয় রূপ ! স্বাধীনতা শব্দটি ও বহুল ব্যবহারে ক্ষয়প্রাপ্ত কমজোরি।
সে দিনের দেশ নায়ক প্রতিদিন স্বাধীনতা দিবস পালন করতে বলতেন। প্রতিদিন দেশ মায়ের পায়ে প্রণাম জানাবো। মা, আজ আর একবার ডাক দাও মা। যেন সব ছেড়ে আর একবার বেরিয়ে পড়তে পারি শুধু একটা তেরঙ্গা কবিতা বুকে বেঁধে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন