স্বাধীনতার ৭৫
মুক্ত গদ্য —৮
আন্দামানের সেলুলার জেল ও বাঁকুড়ার স্বাধীনতা সংগ্রামী
আলোক মণ্ডল
বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে ১০০০ মাইল দূরে "কালাপানি" পার করে আন্দামানে ১৮৫৮ সালে ৪ মার্চ ২০০ জন "সিপাহী বিদ্রোহে" বন্দী সিপাহিকে নিয়ে প্রথমে চাথাম আইল্যান্ড পরে রস আইল্যান্ডে জেলখানা গড়ে তুলতে নৌযাত্রা শুরু করে এবং রস আইলান্ডে বন্দিব্যারাক, ভাইপারে ও চাথামে জেলখানা গড়ে তোলে। ১৮৫৮ সালেই বার্মা ও ভারতের থেকে আসা জেলবন্দির সংখ্যা ১৬১০০ গিয়ে দাঁড়ায়। ফলত ভাইপার আইল্যান্ডের জেলখানায় যেখানে ভাইসরয় লেঃজেনারেল লর্ড মেঁওকে হত্যা করেছিলেন (ওয়াহবি আন্দোলনের জন্য বন্দী) শের আলি এবং তার জন্য তাকে গাছে টাঙিয়ে ফাঁসি দেয় বৃটিশ কর্তৃপক্ষ কিংবা পুরীর রাজা গজপতি বীর কিশোর সিং ( বৃটিশ বিরোধী হওয়ার দোষে দীপান্তরিত) নির্যাতনে মৃত্যু হয়। সেই ভাইপার জেলে বন্দিদের রাখা সম্ভব না হওয়াতে একটা বড় জেলখানার প্রয়োজন হয়ে পড়ে।
ডাঃ আলফ্রেড সোয়াইন লেথব্রীজ ও চার্লস জেমস্ ১৮৯০ এপ্রিল ২৬ সরকারের কাছে রিপোর্ট পেশ করে যে আন্দামানে ৬০০ সেল যুক্ত একটি জেলখানা গড়ে তোলার প্রয়োজন আছে, সেই মাফিক পোর্ট ব্লেয়ারের এবারডিন এলাকায় ৬০০সেল যুক্ত জেলখানা গড়ে তোলার প্রস্তাবও দেয়। সেই মাফিক চিঠি নং ১২০১ তাং ৩ সেপ্টেম্বর ১৮৯৩. বাস্তবায়নের নির্দেশ জারি হয়।সাব-ইঞ্জিনিয়র ডাব্লিউ জি ম্যাককুলিন এস্টিমেট দেন আইরন মেটিরিয়াল ছাড়া খরচ পড়বে ২,৫৯, ৭৬৪ টাকা আর বন্দিলেবার দের জন্য পারিশ্রমিক বাবদ ১,৬২,৬০২ টাকা।
কাজ শুরু হোল সেলুলার জেলের, সমুদ্র তল থেকে ৬০ ফুট উঁচুতে তারামাছের আকৃতিতে তিনতলা বিশিষ্ট ৭ টি ব্লক বা wing প্রতি ব্লক তিন তলার।প্রথম ও দ্বিতীয় ব্লকে সেলের ( কুঠরির) সংখ্যা ৩৫×৩= ১০৫, তৃতীয় ব্লকে সেল সংখ্যা ৫০×৩=১৫০,চতুর্থ ব্লকে২৬×৩=৭৮, ৫ম ব্লকে ২৪×৩=৭২,৬ষ্ঠ ব্লকে ২০×৩=৬০ আর ৭ম ব্লকে ৪২×৩=১২৬টি, সর্বমোট ৬৯৬ টি সেল।এই বিশাল জেল তৈরী করতে ২০ হাজার কিউবিক ফুট স্টোন চিপস আর ৩০ লাখ ইট লেগেছিল,লেগেছিল ১০ বছর সময় আর ৬০০ শ্রমিক। প্রতি সেলে ১ জন করে স্বাধীনতা সংগ্রামী বন্দী থাকতেন। সেলের পরিসর ১৩.৫ ফুট লম্বা ৭.৫ ফুট চওড়া। ৯ ফুট উঁচুতে পেছুনের দিকে একটি মাত্র লোহার গ্রুিল দিয়ে আটকানো ঘুলঘুলি। সামনে মোটা লোহার গেট তার লক দু'ফুট দূরে দেওয়ালের ভেতরে কুলুঙ্গি করে তালা,বন্দির পক্ষে হাতবাড়িয়েও নাগাল পাওয়া সম্ভব নয়। সেলের ভিতরেই বন্দিদের প্রাতঃকৃত্য করতে হোত, পেট খারাপ হলে সারাদিন ঐ টয়লেটের নোংরা নিয়েই থাকতে হোত। সামনে ৪ ফুট চওড়া লম্বা বারান্দা, প্রতি ব্লকে প্রবেশ পথ মোটা লোহার গেট দিয়ে আটকানো।এক সেলের বন্দির সংগে অন্য সেলের বন্দির দেখা হওয়া বা কথা বলার কোন সম্ভবনা ছিল না।প্রতি ব্লকে ২১ জন করে ওয়ার্ডেন্ট ও সশস্ত্র প্রহরী দিনরাত্রি তিন ঘণ্টা করে ডিউটিতে থাকত।প্রতি ব্লকের সামনে একাধিক ঘানী থাকত বন্দিদের নারকেল তেলের ঘানী চালাতে হোত, না করলে অকথ্য অত্যাচার, তার কাহিনি বড়ই নির্মম ও পৈশাচিক।জেল বন্দীদের মাথা পিছু ঘানি টেনে শুকনো নারকেল থেকে ৩০ পাউন্ড নারকেল তেল বার করতে হত। কয়েদীদের মধ্যে কেউ জেলারের প্রতিবাদে উঁচু গলায় কথা বললে তাকে উলঙ্গ করে ফগিং স্ট্যান্ডে উল্টো করে হাত পা বেঁধে দাঁড় করিয়ে রাখা হত। তারপর বন্দীর নিতম্বের উপর সাদা এক টুকরো কাপড় রেখে চাবুকের ঘা মারা হত। চাবুকের ঘায়ে নিতম্ব ফেটে রক্ত বের হয়ে আসত। এর ফলে সেই বন্দীর পরিনতি হতো খুব খারাপ,বন্দী ভালো করে মল ত্যাগ করার জন্য বসতে পারতেন না ফাটা চামড়ায় টান পড়তো।বন্দিকে পাটের তৈরি কাপড় পড়তে দেওয়া হত যাকে "পানিশমেন্ট-ড্রেস" বলা হত। সেই পাটের ড্রেস পরে নিতম্বের ফাটা জায়গায় পাটের কাপড়ের ঘষা লেগে ঘা হয়ে যেত। এরকম শতশত
অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে বটুকেশ্বর দত্ত যেমন পাগল হয়ে গিয়েছিলেন তেমনি কত বন্দী অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছিলেন। তাতে ক্ষিপ্ত হয়ে জেল প্রশাসন একবার এক সঙ্গে ৭৮ জন বন্দী কে এক সঙ্গে ফাঁসি দিয়েছিল। কত যে নির্মম অত্যাচারে প্রাণ হারিয়েছিলেন তার হিসেব আর এক নিবন্ধের সূচনা করবে।
বর্তমানে সেলুলার জেলের মাত্র তিনটি ব্লক আছে বাকিগুলি কিছু ভূমিকম্পে এবং বেশীরভাগ ২য় বিশ্ব যুদ্ধের সময় জাপানি বোমার আঘাতে ধূলিস্মাৎ হয়েছে।ভারত সরকার দুটি ব্লক ভেঙে সেখানে ৫০০ শয্যা বিশিষ্ট "জে বি পন্থ হসপিটাল "গড়ে তুলেছেন পরবর্তীকালে।সেলুলার জেলে অবিভক্ত বাংলা থেকে ১৯১০ থেকে ১৯৩৮ সালের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক ৩৭০ জন, উত্তর প্রদেশ থেকে ২০ জন, অবিভক্ত পাঞ্জাব থেকে ৮৪ জন,বিহার থেকে ১৮ জন, দিল্লী থেকে ১ জন, মাদ্রাজ থেকে ৩ জন এবং মহারাষ্ট্র থেকে ৩ জন স্বাধীনতা সংগ্রামী জেল খেটেছেন
আমাদের জেলা,বাঁকুড়া থেকে মৃত্যুঞ্জয় বন্দ্যোপাধ্যায় সেলুলার জেলে বন্দি ছিলেন বিষ্ণুপুর ডাক গাড়ি লুঠের অভিযোগের শাস্তি স্বরূপ।সাত বছরের জন্য তাঁর দ্বীপান্তর হয়েছিল। তিনি ১৯৩৭ সালে জেলের অভ্যন্তরে আমরণ অনশনেও যুক্ত ছিলেন।১৯৩৮ সালে জেল মুক্ত হয়ে ১৯৩৯ সালে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিতে যুক্ত হন এবং পরে দল ত্যাগ করে মাকর্সবাদী কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন এবং জেলা সম্পাদক হন। কিন্তু সেই পার্টিই তাঁকে দল থেকে বহিষ্কার করে স্বাধীনতা সংগ্রামীর দের সম্মান জানিয়ে ভারত সরকার যে "তাম্রপত্র'' দেয় তা গ্রহণের অপরাধে।শেষ জীবন তাঁর চরম দারিদ্র্যে কাটে অবহেলায় ও বিনাচিকিৎসায় মারা যান।
বন্দী ছিলেন বাঁকুড়া জেলার মালিয়াড়া গ্রামের প্রভাকর বিরুনি। পিতা শশীভূষণ বিরুনি। জন্ম- ফেব্রয়ারি ১৮৯৮,অসহযোগ আন্দোলনের(১৯৩০) সংগে যুক্ত ছিলেন অনুশীলন সমিতির অন্যতম এই সদস্যটিকে বে-আইনী অস্ত্র রাখার অভিযোগে ২৮ আগষ্ট ১৯৩৪ সালে বন্দী করে ৫ বছরের জন্য সেলুলার জেলে চালান করে দেয় বৃটিশ সরকার।তিনি জেলখানায় দ্বিতীয় "হাঙ্গার স্ট্রাইক"-এ অংশ নেন জুলাই ১৯৩৭, মুক্তি পান ১৯৩৯ এ। জেলার কমিউনিস্ট পার্টি গঠনে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য, তাঁর পুরুষ্ঠ গোঁফ ওয়ালা ছবি এখনও সেলুলার জেলে দৃশ্যমান। তাঁর মৃত্যু হয় ১৯৭৬ সালে।
যুগান্তর দলের সদস্য , বিষ্ণুপুর ডাকলুঠের সংগে যুক্ত থাকার অভিযোগে বিমল কুমার সরকারের দীপান্তর হয়। তিনি সেলুলার জেলে বন্দী থাকেন ১৯৩৩ সালে,৫ বছরের জন্য। তিনিও জেলে দ্বিতীয় "হাঙ্গার স্ট্রাইক"-র সংগে যুক্ত ছিলেন, মুক্তি পান ১৯৩৮ সালে। পরবর্তি সময়ে তিনি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হন এবং ১৯৩৬ সালে বাঁকুড়া জেলাপার্টির প্রথম সম্পাদক হন।বে-আইনী অস্ত্র ও বিস্ফোরক রাখার জন্য বিষ্ণুপুরের বাসিন্দা দীননাথ কর্মকারের ছেলে ভবতোষ কর্মকারকে ব্রিটিশ সরকার ১৯৩৫ সালে ৪ এপ্রিল মেদিনীপুর সেন্ট্রাল জেলে বন্দি করে এবং পরে তাঁকে সেলুলার জেলে স্থানান্তরিত করে। তিনি সেলুলার জেল থেকে মুক্তি পান ১৯৩৮ এ তারপরেও তাঁকে অন্য জেলেই থাকতে হয়।
মেছুয়াবাজার বোমা ষড়যন্ত্র মামলায় সুধাংশু দাশগুপ্তের ৯ ডিসেম্বর ৫ বছরেরর জেল হয় জেলবন্দি অবস্থায় সেলুলার জেলে বিমল সরকারের সাহচর্যে এসে সুধাংশু দাশগুপ্ত কমিউনিস্ট ভাবাদর্শে অনুপ্রাণিত হন এবং জেল থেকে ১৯৩৫ এ মুক্তি পেয়ে বাকি জীবন বিষ্ণুপুরে সংগঠনের কাজে কাটিয়ে দেন, সে হিসেবে তিনি এই জেলারই মানুষ।একই ভাবে বিহার থেকে সেলুলার জেলে বন্দী প্রমথনাথ ঘোষও পরবর্তী ১৯৩৭ এর পর মুক্তি লাভ করে কর্মক্ষেত্রে হিসেবে বাঁকুড়া জেলাকেই বেছে নেন এবং কমিউনিস্ট পার্টির সংগে যুক্ত হন।
আমরা অনেকেই খুব আবেগ প্রবন ও গল্পবাজ তাই গল্পের গরু গাছেও চড়ে! তাই মনীষীদের নিয়ে সহজেই গল্প ছড়িয়ে পড়ে। এমনই এক গল্প সেলুলার জেলবন্দি বীর সাভারকারকে নিয়ে। বলা হয়, তিনি সেলুলার জেল ভেঙে পাহাড় প্রমান প্রাচীর ডিঙিয়ে ১০০০ মাইল উত্তাল সমুদ্র সাঁতরে পালিয়ে এসেছিলেন ভারতের মূল ভূখন্ডে। এরকম গপ্প কিন্তু ডাহা মিথ্যা তার কোন তথ্যও নেই।আসলে,১৯০৯ সালে ১ জুলাই মদনলাল ধিংড়া বৃটিশ প্রভু কার্জন ওয়াইলি কে লন্ডনে গুলি করে হত্যা করেন সেই সময় ভিনায়ক দামোদর সাভারকার বোমা তৈরীর মেথড নিয়ে জাহাজের কুক হয়ে লন্ডনে গিয়েছিলেন কিন্তু ধরা পড়ে যান। বৃটিশরা তাঁকে বন্দী করে জাহাজে ভারতে চালান করার সময় দামোদর ১৩ মার্চ ১৯১০ এ জাহাজ থেকে ঝাঁপ দিয়ে ফ্রান্সের পোর্ট মারসেল্স বন্দরে পৌছে আত্মগোপন করেন, ফ্রান্স পুলিশ তাঁকে আবার ধরে ব্রিটিশদের হাতে তুলে দেয়।১৯১১ সালে ৯ ফেব্রুয়ারি কার্জন হত্যায় যুক্ত থাকার মামলায় এবং নাসিক ষড়যন্ত্র মামলায় দোষী সাব্যস্ত হয়ে সেলুলার জেলে বন্দি হন ৫০ বছরের জন্য।বৃটিশ সরকারের অত্যাচার নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে তিনি জেল মুক্তির জন্য সরকারের কাছে আবেদন করেন তারপর ১৯২৪ সালে বৃটিশ সরকার তাঁকে শর্ত সাপেক্ষে মুক্তির প্রস্তাব দেয়, ইতিমধ্যে কংগ্রেস দল ভারতের ৭ টি রাজ্যে ক্ষমতায় এসে গেছে,সেটা ১৯৩৭ সাল,বিনায়ক দামোদর সাভারকার ব্রিটিশ সরকারের দেওয়া শর্ত মেনে মুচলেখা( বৃটিশ বিরোধী কোন আন্দোলনে থাকবেন না,কোন রাজনৈতিক কাজ-কর্মে যুক্ত থাকবেন না শুধু সমাজসেবায় যুক্ত থাকবেন এই শর্তে।) দিয়ে সেলুলার জেল থেকে মুক্তি পান।এই হচ্ছে তথ্য স্বীকৃত ইতিহাস। অথচ সেলুলার জেলের সামনেই যে পার্ক, তা সেটি তাঁর নামেই উৎসর্গীকৃত , পোর্টব্লেয়ার এয়ারপোর্টের নামও"বীর সাভারকার এয়ারপোর্ট" তাঁর নামেই অথচ নেতাজীর ১৯৪৩ এ বৃটিশমুক্ত আন্দামানে প্রথম স্বাধীন ভারতের পতাকা উত্তোলন করেছিলেন তার কোন স্বীকৃতি নেই! এমনকি তিন শতাধিক বাঙালী বীর বন্দিদের নামের তালিকা যা এতোদিন সেলুলার জেলের দেওয়ালে মার্বেল পাথরে উৎকীর্ণ ছিল তা প্রতিদিনই কোন এক অদৃশ্য কারনে কমতে থাকছে।যেমন আমরাও ভুলে যাচ্ছি বাঁকুড়ার ঐ সমস্ত বীরদের কথা, ক'জনই বা জানি তাঁদের সম্পর্কে বিস্তৃত ভাবে!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন