লেবেল

বুধবার, ১৭ আগস্ট, ২০২২

স্বাধীনতার ৭৫।। মুক্ত গদ্য -১৭।।আমরা কি সত্যিই স্বাধীন?" — দীপক বেরা।। Ankurisha।। E.Magazine।। Bengali poem in literature।।

 




স্বাধীনতার ৭৫

মুক্ত গদ্য -১৭



ভারতবর্ষের স্বাধীনতার দীর্ঘ ৭৫ বছর পেরিয়ে এসেও প্রশ্ন জাগে, —"আমরা কি সত্যিই স্বাধীন?" 


দীপক বেরা



'স্বাধীনতা' মানে কী? 
হ্যাঁ, এই স্বাধীনতার মানে খুঁজতে গেলে আমাদের চোখের সামনে ভেসে আসে খন্ড খন্ড কোলাজ—

স্বাধীনতা মানে কি
মহারাষ্ট্রের খরাজীর্ণ মাঠে কৃষকের শূন্যদৃষ্টি?
শহরের রাস্তায় পুলিশে খেদানো ফেরিওয়ালার ছোটাছুটি?
স্বাধীনতা মানে কি 
বিনা চিকিৎসায় মৃত শিশুর মায়ের কান্না?
বেকার তরুণ-তরুণীর অন্তহীন অপেক্ষা, 
আর শেষ পরিণতিতে আত্মহত্যার হার মানা?
স্বাধীনতা মানে কি 
একদল রাজনৈতিক খেলোয়াড়ের 
মিথ্যাবরণ প্রতিশ্রুতির চটুল ভাষণ? 
কিছু অধার্মিকের ধর্মকথা, আর ক্রমাগত 
টেনে চলা মানুষের মাঝে ধর্মীয় রেখা বিভাজন?


স্বাধীনতার ৭৫ বছর বছরের পূর্ণতার লগ্নে দাঁড়িয়ে আমাদের প্রশ্ন অগণন। ব্যক্তি কিংবা নাগরিক হিসেবে আমরা কি আজও কোনও স্বাধীনতার প্রত্যাশী?
'স্বাধীনতা' শব্দটির ব্যাপ্তি অনেক। 
এই প্রেক্ষিতে যে প্রশ্নটি সর্বাগ্রে আমাদের মনে আসে তা হল, — কতটা স্বাধীন হতে পেরেছি আমরা মনে প্রাণে। স্বাধীনতা মানে আমি শুধুমাত্র রাজনৈতিক স্বাধীনতার কথা ভাবি না। আমি বা আমার মত যারা স্বাধীন ভারতে জন্মেছি, ব্রিটিশদের দ্বারা পরাধীনতার গ্লানি আমরা ইতিহাসের পাতায় পড়েছি। কিন্তু তার পরেও একটা প্রশ্ন থেকে যায় যে, —আমরা কি সত্যিকারের স্বাধীন দেশের নাগরিক?

স্বাধীনতা মানে কি শুধুমাত্র একটি দিনের ছুটি? বাড়িতে, ক্লাবে, বিদ্যালয়ে, সরকারি অফিস-আদালতে তেরঙ্গা পতাকা উত্তোলন? কিংবা ক্লাবে ক্লাবে তারস্বরে মাইক বাজানো?
এই মুহূর্তে স্বাধীনতার ৭৫ বছর পেরিয়ে এসেও আমরা কি স্বাধীনতার সঠিক মূল্যায়ন করতে পারছি?
আত্মমর্যাদার জন্য কাউকে যদি আত্মহত্যা করতে হয়, ন্যূনতম বেঁচে থাকার অধিকারটা যদি না পাওয়া যায়, অথবা প্রত্যেক মানুষের বেঁচে থাকার অধিকারটুকু যদি কারুর দয়া-দাক্ষিণ্যের উপর নির্ভর করে, তবে কি আমরা কি স্বাধীন?
স্বাধীনতার অর্থ— দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, দেশকে একটি সুদৃঢ় ভিতের উপরে দাঁড় করানো। দেশের মানুষের প্রয়োজন শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্য, বস্ত্র এবং বাসস্থান। সেই চাহিদা পূরণে সক্ষম করে তোলার সাথে কর্মসংস্থান ও দেশকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক দিকে স্বনির্ভর করে তোলা।
স্বাধীনতার অর্থ এই নয় যে মানুষের তৈরি সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন প্রক্রিয়াকে সিঁড়ি বানিয়ে ক্ষমতা দখল আর সিংহাসনে বসে ক্ষমতার অপব্যবহার করা। এই ক্ষমতা দখলের সিংহাসনটি হতে পারে গ্রামের সালিশি সভার প্রধানের সিংহাসন অথবা গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধানের সিংহাসন, মুখ্যমন্ত্রীর সিংহাসন কিংবা প্রধানমন্ত্রীর সিংহাসন। তাই স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিকের উচিত কোনও ব্যক্তিকে ক্ষমতা দখলের সিংহাসনে বসাবার আগে সেই ব্যক্তির ন্যূনতম অন্তর্নিহিত মূল্যবোধের ও তাঁর শিক্ষার সঠিক মূল্যায়ন করে নেওয়া। নচেৎ স্বাধীনতার অপব্যবহার করার দায় শুধুমাত্র সেই ব্যক্তিবিশেষের উপর বর্তায় না, তাহলে স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিকের শিক্ষা, বুদ্ধি ও দায়িত্বশীলতা নিয়ে প্রশ্নচিহ্ন উঠে যায়। জনগণ যদি জ্ঞানত কোনও অসৎ ব্যক্তিকে সিংহাসনে বসায়, তাহলে সেই অসৎ ব্যক্তি অপেক্ষা জনগণ বেশি দায়ী।

দামি দামি অস্ত্র কিনছি, পরমাণু সমৃদ্ধ আমাদের দেশ। দেশ শক্তিধর হচ্ছে, দেশ উন্নত হচ্ছে— "আহা কী আনন্দ আকাশে বাতাসে"।
কিন্তু আসল অস্ত্রটি এখনও বানানো গেল না, যে অস্ত্রে আমাদের অশিক্ষা, কুসংস্কারকে মেরে ফেলা যায়। সমস্ত জনগণকে সঠিক শিক্ষা দেওয়া গেল না। দেশ যান্ত্রিক অস্ত্রে পরিপূর্ণ অথচ জনগণের অভ্যন্তরীণ অস্ত্র নেই। বিদেশী শক্তিকে আমাদের সাথে লড়াই করে জিততে হবে না, শুধু অশিক্ষার আগুনে হাওয়া দিলেই দেশ পুড়ে ছারখার হয়ে যাবে। কোনও আধুনিক অস্ত্রই কাজে আসবে না। অশিক্ষার কারণে আরও বেশি করে জন্ম নেবে দেশের মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদের চাহিদা। সেই চাহিদা পূরণ করতে প্রচুর মূল্য দিয়ে কেনা অস্ত্র বিদেশী শক্তির বিরুদ্ধে ব্যবহার করার আগেই বিলীন হয়ে যাবে দেশের মধ্যেই।

এদেশে ইংরেজ রাজত্বকালে ওরা ওদের শিক্ষা নিয়ে এল, আর যাওয়ার সময় দেশকে স্বাধীন করার নামে একটি দেশকে দুভাগ করে দিয়ে চলে গেল। সাথে সাথে সারাজীবন একটি ক্রেতা সুনিশ্চিত করল, যে কিনা আজীবন ধরে বিদেশীদের কাছে অস্ত্র কিনেই যাবে দেশের মধ্যে সন্ত্রাসবাদ ও বিচ্ছিন্নতাবাদকে ঠেকাবার জন্য। 
স্বাধীনতার সঠিক অর্থ একমাত্র হতে পারে দেশের জনগণের ন্যূনতম সঠিক শিক্ষাদানের অঙ্গীকারে ব্রত হওয়া। শিক্ষাই পারে সব পরাধীনতা থেকে মুক্ত করতে। অন্ধকারে জ্ঞানের আলো জ্বালাতে। উপযুক্ত শিক্ষা বিনা দেশের জনগণের সমস্ত স্বাধীনতাই পরাধীনতার শিকলে বাঁধা। সঠিক শিক্ষা হলে সঠিক মানুষ পাওয়া যাবে, আর সঠিক মানুষ পেলে সঠিক নেতৃত্ব পাওয়া যাবে, যে দেশকে সঠিক দিশা দেখাতে পারবে। 

তাই স্বাধীনতার ৭৫ বছরের পূর্ণতার দিনে দাঁড়িয়ে আমাদের ভাবতে হবে, —দেশের উন্নতি এবং মানুষের ব্যক্তিস্বাধীনতা থেকে শুরু করে সমস্তরকম স্বাধীনতার সার্থকতা তখনই সম্ভব হবে, যখন দেশের রাজা এবং প্রজা উভয়েই সত্যিকারের ভালো মানুষ হবে। যাদের মধ্যে ভক্তি, ত্যাগ, দায়িত্বশীলতা ও আদর্শ থাকবে, যাদের অন্তরে 'মান' এবং 'হুঁশ' থাকবে।
নচেৎ, স্বাধীনতার ৭৫ বছর কেন, আগামী অযুত বছর পেরিয়ে গিয়েও মানুষ রাজনৈতিকভাবে স্বাধীন দেশে বাস করা সত্ত্বেও ব্যক্তিগতভাবে পরাধীনতার গ্লানি থেকে চিরকাল মুক্তির দিশা হন্যে হয়ে খুঁজে যাবে..!









কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন