স্বাধীনতার৭৫
মুক্ত গদ্য —৭৫
স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরেও কি আমরা স্বাধীন?
সুকুমার রুজ
আজ ভারতের ৭৬তম স্বাধীনতা দিবস। ব্রিটিশের বিরুদ্ধে দীর্ঘকাল ধরে আন্দোলন করার মধ্যে দিয়ে আমাদের দেশ রাজনৈতিকভাবে স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরে আমরা কতখানি স্বাধীন, তা একটু আলোচনা করা যাক—
স্বাধীনতার পর দেশের
জনগণ যে অবস্থায় রয়েছে, সে সম্বন্ধে রাজনৈতিক দলগুলোর এবং বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের যে কোনো দৃষ্টিকোণ থেকে যে ব্যাখ্যাই থাকুক না কেন, এটা তো ঠিক যে, স্বাধীনতা আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল গণমুক্তি বা জনগণের স্বাধীনতা। দেশের জনসাধারণের সর্বপ্রকার শোষণ থেকে মুক্তি।
কিন্তু
একটু মাথা ঠাণ্ডা করে ভাবলে দেখা যায়, আমরা আদৌ শোষণ থেকে মুক্ত হইনি। আমরা এখনও
শোষণ-জুলুম-অত্যাচারের বশবর্তী হয়েই রয়েছি। শুধু শোষণের রূপ বদলেছে। ব্রিটিশ শাসনকালে শোষণ জুলুম-অত্যাচারের ধরন ছিল একরকম, এখন তার ধরন বদলেছে।
যাঁরা আমাদের দেশের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছিলেন, তাঁরা ইংরেজকে তাড়াতে চেয়েছিলেন এ কারণেই যে, তাদেরকে না তাড়ালে, সমাজে অন্যায়-অবিচার-অত্যাচার, ব্যবসাদারদের জুলুম, জমিদারদের জুলুম, এরকম সমস্ত জুলুমের অবসান ঘটানো যাবে। সমাজকে সর্বাঙ্গীণ মুক্তির সুযোগ দেওয়ার জন্যই তাঁরা স্বাধীনতা চেয়েছিলেন এবং লড়াই করেছিলেন।
কিন্তু একটু ভেবে দেখলেই বোঝা যায় যে, বর্তমানেও দেশের জনগণ সেইসব জুলুম থেকে নিস্তার পায়নি। তখন ছিল ব্রিটিশ ও তাদের প্রশাসনের
জুলুম, এখন আছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও দলীয় কর্মীদের জুলুম। সেইসঙ্গে কিছু দলদাস
প্রশাসনের জুলুম। কেননা, ভারতের রাজনীতি, অর্থনীতি এবং সামাজিক সমস্ত নীতিগুলোকে এবং আচার-ব্যবহার গুলোকে এখন পরিচালনা করে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। এছাড়া এখন আছে কালোবাজারিদের জুলুম, প্রমোটারদের জুলুম।
এবার আসি অন্য কথায়। স্বাধীন দেশের জনগণের সমস্ত স্তরের ছেলেমেয়েদের শিক্ষার সুযোগ, শিক্ষাশেষে তাদের কর্মসংস্থানের
সুযোগ, বিনা পয়সায় জনগণের স্বাস্থ্য-পরিষেবার সুযোগ, সর্বোপরি সর্বাত্মকভাবে পরিকল্পনা অনুযায়ী আর্থিক উন্নয়নের মধ্যে দিয়ে সামগ্রিক উন্নতিসাধন, সেসব তো সাধারণ মানুষ ঠিকঠাক পাচ্ছে না।
অনেকে
বলবেন, 'কে বলল, পাওয়া যাচ্ছে না! সরকার তো বিনা পয়সায় শিক্ষা, স্বাস্থ্য-পরিষেবার
পরিকল্পনা তো নিয়েছে।'
হ্যাঁ, পরিকল্পনা নিয়েছে, প্রকল্পও হয়েছে। কিন্তু তার গুণগত মান নিয়ে
জনসাধারণ সন্দিহান। তাই সাধারণ মানুষের কতজন সে প্রকল্পের সুবিধা নিচ্ছে, বলুন তো!
আর কর্ম সংস্থানের কথা না-ই বা বললাম।
এবার আসি সাহিত্য, সংস্কৃতি ও জ্ঞান বিজ্ঞানের কথায়। আমি প্রথমেই সাংস্কৃতিক আন্দোলনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে কিছু কথা বলতে চাই।সাহিত্য আন্দোলন, সাংস্কৃতিক আন্দোলন, যুবসমাজের জ্ঞান-বিজ্ঞান ও আদর্শবাদের চর্চা, এসবের কোন মানেই থাকে না, যদি তার একটা বাস্তব কার্যকারিতা জীবনের উপর, দেশের অর্থনৈতিক জীবনযাত্রার উপর, সামাজিক আন্দোলনের উপর, দেশের রাজনৈতিক আন্দোলনের উপর কোনও প্রভাব ফেলতে না পারে।
কিন্তু এখন কি সেটা পারছে? এখন সাংস্কৃতিক আন্দোলন হচ্ছে ড্রইংরুমের সাজানো আড্ডা। জীবনে যদি তার কোনো প্রতিক্রিয়া না থাকে, জীবনকে উন্নত করতে, পরিবর্তন করতে তা যদি বিন্দুমাত্র প্রভাব না ফেলে, তাহলে সে আন্দোলনের কী মানে থাকে! আমরা যারা নিজেকে সংস্কৃতিবান ব'লে মনে
করি, জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানা তথ্য নিয়ে যাঁরা আলোচনা করেন, তাঁরা কি স্বাধীনভাবে তাদের অভিমত ব্যক্ত করতে পারছেন? তা যদি পারতেন, তাহলে নাট্যকার
সফদার হাসমী, কবি তুকারাম, সাংবাদিক গৌরী লঙ্কেশ বা সাহিত্যিক কালবুরগি এঁদের
গ্রেফতার, নির্যাতন বা নিহত হতো না। তাহলে কি বলা যায় যে দেশ পরিপূর্ণ স্বাধীন হয়েছে?
যাঁরা স্বাধীনতা আন্দোলনে সামিল হয়েছিলেন, তারা তো বলেছিলেন 'দেশের স্বাধীনতা, জনগণের স্বাধীনতা আমার জন্মগত অধিকার।' এ কথাটা যাঁরা কাব্যের মধ্যে দিয়ে, সাহিত্যের মধ্যে দিয়ে, সংগীতের মধ্যে দিয়ে, আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে যেভাবেই হোক বলতে চেয়েছেন, সেই ব্রিটিশ জমানায় তাদের কিন্তু কঠিন মূল্য দিতে হয়েছে। তাদের কঠিন শাস্তি পেতে হয়েছে, জেলে যেতে হয়েছে, এমনকি মৃত্যুবরণও করতে হয়েছে।
কিন্তু দেশের স্বাধীনতার এই ৭৫ বছর পরেও কি তার কোন পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে হয়? এখনও কি আপনি 'স্বাধীনভাবে আপনার মত ব্যক্ত করতে
পারেন! তা বললেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দল কখনো মাওবাদী ব'লে, কখনো দেশদ্রোহী ব'লে, কখনো প্রতিক্রিয়াশীল ব'লে আপনাকে অ্যারেস্ট করে বা বিভিন্নভাবে আপনাকে শাস্তি দেয়। তাহলে কোথায় সত্যিকারের স্বাধীনতা!
তাহলে
আন্দোলনকে বাস্তবে রূপ দিতে গেলে পদে পদে বাধার সম্মুখীন হতে হয়, গ্রেফতার হতে হয়,
জেলে যেতে হয়, কিংবা মৃত্যুবরণও করতে হয় যে দেশে, সে দেশ কি প্রকৃত স্বাধীন?
নেতাজি সুভাষচন্দ্র, 'বিপ্লব কি' এপ্রসঙ্গে বলতে গিয়ে এক জায়গায় লিখেছেন, 'আমার ছেলেবেলায় আমি ব্রিটিশকে দেশ থেকে তাড়িয়ে দেওয়াই সবচাইতে বড় কর্তব্য বলে মনে করতাম। পরে গভীরভাবে চিন্তা করে দেখেছি যে, ব্রিটিশকে তাড়ালেই আমার কর্তব্য শেষ হয়ে যাবে না। ভারতবর্ষে নতুন সমাজ ব্যবস্থা চালু করার জন্য আরেকটি বিপ্লবের প্রয়োজন হবে।'ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে দেখলে, এই সিদ্ধান্তে আসা যাবে যে, সে বিপ্লব কিন্তু এখনও হয়নি।
স্বাধীনতার আগে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসকরা তাদের ঔপনিবেশিক শাসন চিরস্থায়ী করার জন্য এবং নিজেদের অর্থনৈতিক স্বার্থে আমাদের দেশে হিন্দু-মুসলমানকে লড়িয়ে দিয়ে 'ডিভাইড এন্ড রুল' নীতি চালু করেছিল। মুসলিম জনতাকে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলেছিল। কিন্তু এখনো তো সেই 'ডিভাইড এন্ড রুল' নীতি চলছে। এখনো সাম্প্রদায়িকতার জিগির তুলে বিভিন্ন সম্প্রদায়কে লড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। বর্তমান সময়ে স্বাধীনতার এত বছর পরেও কি তার কোন পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে হয়! এখনো তো ধর্মের জিগির তুলে মানুষে মানুষে বিভেদ তৈরি করা হয়। মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার ক্ষুন্ন করা হয়।
কেউ
হয়তো বলবেন, এসব রাজনৈতিক কথাবার্তা। সমাজে বাস করে কেউই কিন্তু রাজনীতির উর্ধ্বে থাকতে পারে না। রাজনীতি করা না করা কারও ইচ্ছার উপর নির্ভর করে না। কেউ যদি ভাবেন যে, তিনি রাজনীতির মধ্যে নেই, এসব সাত-পাঁচ এর মধ্যে নেই, তিনি নিরপেক্ষ। এটা কখনো হয় না।
আমি
একটা উদাহরণ দিই। আপনি না চাইলেও আপনার পরিবারের মধ্যেও কীভাবে রাজনীতি ঢুকে পড়ে
দেখুন। ধরুন, আপনার দুই ছেলে। একজন চাকরি করে, একজন বেকার। মা দুই ছেলেকে একসঙ্গে
বসিয়ে খেতে দিচ্ছেন। মাছের বড় পিস-টা, কিংবা মাংসের লেগ-পিস-টা চাকরি-করা ছেলের
পাতে দিলেন। সে রোজগার করছে, তাই ওটা তার প্রাপ্য। ভাবুন, স্নেহময়ী জননী রাজনীতি
না করতে চাইলেও কীভাবে পরিবারের ভেতরেও রাজনীতি চলে আসছে।
বাস্তবে রাজনীতিমুক্ত কোনও জীবন রাজনীতি বহির্ভূত বা রাজনীতি নিয়ন্ত্রণমুক্ত কোনও জীবন আপনি পাবেন না। সে ছাত্র হোক, শ্রমিক-কৃষক হোক বা নারী-পুরুষ হোক। কারও পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ যারা সমাজ-বিজ্ঞানের ছাত্র তারা জানেন যে, সমাজ কীভাবে চলবে, রাজনীতি তা নির্ধারণ করে এখনো তা নির্ধারণ করে চলেছে। আপনারা দেখতেই পাচ্ছেন যে, দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা একতরফা সিদ্ধান্ত নিচ্ছে এবং তারা সেটা জনগণের উপর চাপিয়ে দিচ্ছে। আমাদের সেটাই মেনে চলতে হচ্ছে। তারা অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করছে, সংস্কৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করছে, সবকিছুই রাজনৈতিক দল নেতা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। তাহলে কি আমরা বলতে পারি যে, আমরা নিরপেক্ষ রাজনীতি নিয়ন্ত্রণমুক্ত? কখনওই সেটা হয় না।
আমার কথা শুনে মনে হতে পারে যে, আমি বলতে চাইছি, দেশের স্বাধীনতা আসেনি। অবশ্যই দেশ রাজনৈতিকভাবে স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু স্বাধীনতার এতো বছর
পরেও স্বাধীনতার ত্রুটি-বিচ্যুতি ও সীমাবদ্ধতা, সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর প্রতি দেশের শাসকগোষ্ঠীর আনুগত্য, সাম্রাজ্যবাদী নীতি, সবচেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছে, দেশের শাসন ব্যবস্থাকে পুঁজিপতি শ্রেণীর স্বার্থে পরিচালনা করা, এসব রয়েছে। একটু ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখলে বোঝা যায় যে, এতে সাধারণ মানুষের স্বাধীনতা খর্ব হয়। তাহলে কি সত্যিকারের স্বাধীনতা এসেছে! ভাবা দরকার।
স্বাধীনতার ৭৪ বছর পরেও কি আমরা স্বাধীন -- সুকুমার রুজ-এর নিবন্ধ একটি গুরুত্বপূর্ণ লেখা। Ankurisha. blogspot.com এ প্রকাশিত হচ্ছে স্বাধীনতা নিয়ে পরপর অনেকের গদ্য। এই পত্রিকার সম্পাদকের এই যে ভাবনার ধা,, এটা খুব দরকার ছিল, এই সময়ে।এই ধরনের চিন্তার কাজ পাঠক হিসেবে আমি সমর্থন করি।
উত্তরমুছুনঅনেক কথাই ঠিক। আবার কিছু কথা আমার বিবেচনায় ঠিক নয়।তব গদ্য শৈলী ভালো।
উত্তরমুছুন