দুরন্ত বিজলী
১৫ই আগস্ট স্বাধীনতা দিবস। ২০২২ খ্রীষ্ঠাব্দের ১৫ই আগস্ট স্বাধীনতার ৭৫ বছর পেরিয়ে এল। অনেক বিপ্লবীর আত্মবলিদান, অনেক শহিদের রক্তের বিনিময়ে , অনেক স্বাধীনতা সংগ্রামীর কারাবরণের দুঃসহ যন্ত্রণা ও বিপুল বিক্রমে ইংরেজ রাজশক্তিকে পরাভূত করে পেলাম এই স্বধীনতা। দুটো দেশ হল। তিনটি খণ্ড হল - ভারত ও পাকিস্তান(পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান)। ১৯8৭ খ্রীষ্ঠাব্দের ১৫ই আগস্ট।
স্বাধীনতা সংগ্রামের চরম অবস্থায় পৌঁছতে কত রকমের সংগ্রাম হয়েছে, কত যুদ্ধ হয়েছে। পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতনের সাথে সাথে ভারতের স্বাধীনতা সূর্য অস্তমিত হল। শুরু হল শাসনের নামে ইংরেজের অত্যাচার। ভারতের জনমানসে ধিকিধিকি করে প্রতিবাদের আগুন জ্বলে উঠতে লাগল। প্রথমে ইংরেজের আগ্রাসন রুখতে টিপু সুলতান, নানা ফাড়নাবিশ, লালা লাজপত রায়, ঝাঁসির রানী লক্ষ্মীবাই প্রমুখের নেতৃত্বে স্বাধীনতা রক্ষার যুদ্ধ হয়েছে। অনেকেই মৃত্যু বরণও করেছেন। ইতিহাসের পাতায় তা স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে।
তারপর ১৮৫৭ খ্রীষ্ঠাব্দে সিপাহী বিদ্রোহের থাবা বুঝিয়ে দিয়েছিল - ইংরেজ , তুমি সাবধান ! বীর শহিদ ভগৎ সিং- এর নেতৃত্বে ইংরেজের বিরুদ্ধে দাবানল ছড়িয়েছিল।
তারপর দিন দিন ইংরেজের অকথ্য অত্যাচার ও দুঃশাসন ভারতের জনজীবনকে নাস্তানাবুদ করছিল। মহিলাদের মান-ইজ্জত হানি, ভারতের জনগণকে 'নেটিভ' বলে তুচ্ছতাচ্ছিল্য ও অপমান করা, যে মাটির উৎপাদনে বৃটিশের কোষাগার পূর্ণ হয়, সেই মাটিকে ঔপনিবেশিকতায় পদানত করে রাখায় ভারতবাসীর জীবনযাত্রায় নেমে এসেছিল দুর্বিষহ অন্ধকার।
সেই অন্ধকার দূর করে দিতে এলেন আলোকবর্তিকা হাতে Half Naked Fakir মহাত্মা গান্ধী - মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী। তাঁর অহিংস আন্দোলন, বিদেশী দ্রব্য বর্জন, লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলন, ভারত ছাড়ো আন্দোলন ইত্যাদির মাধ্যমে ইংরেজকে বুঝিয়ে দিলেন - ইংরেজ, আর তোমার স্থান এখানে নয়। যাও , চলে যাও। Quit India !
সেই সঙ্গে বাংলার বুকেও তখন জনজোয়ারে সংগ্রামের ধ্বনি - বন্দেমাতরম ! বাংলার দামাল ছেলে ক্ষুদিরাম, বিনয়-বাদল-দিনেশ,সূর্য সেন,অগ্নিকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার প্রমুখ সশস্ত্র বিপ্লবীদের আক্রমণ ইংরেজের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল। ভারতের স্বাধীনতা অর্জন আরও ত্বরান্বিত হল নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোসের নেতৃত্বে আজাদ-হিন্দ-বাহিনীর সঙ্গে ইংরেজের যুদ্ধ। তিনি ভারতবাসীকে আহ্বান জানালেন - 'তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব।' তারপর তিনি আক্রমণের জন্য নির্দেশ দিলেন - 'চলো, দিল্লি চলো!'
সেই সময়ে কবি সাহিত্যিকেরাও থেমে থাকলেন না। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জালিয়ান ওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ইংরেজের দেওয়া 'নাইট' উপাধি পরিত্যাগ করলেন। তাঁর লেখায় স্বদেশের প্রতি অনুরাগ ঝরে পড়ল - ' ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা।'
'বিদ্রোহী' কবিতা লেখার জন্য বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে কারাবরণ করতে হল। তাঁর অগ্নিকণ্ঠে ধ্বনিত হল -
'কারার ওই লৌহ কপাট,
ভেঙে ফেল, কররে লোপাট,....'
চারণ কবি মুকুন্দরাম গাইলেন -
'মায়ের দেওয়া মোটা কাপড়
মাথায় তুলে নে রে ভাই।'
কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় উপন্যাসে স্বদেশ ভাবনা ও স্বাধীনতার কথা লিখতে লাগলেন। তাঁর 'পথের দাবি' উপন্যাস ইংরেজ সরকার ব্যাণ্ড করে দিল। সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের 'আনন্দমঠ' উপন্যাসের 'বন্দেমাতরম' স্বাধীনতা আন্দোলনের মূল ধ্বনি অনেক আগেই হয়ে গেছে। আরো অনেক কবি সাহিত্যিক সাংস্কৃতিক কর্মী এই সময় দেশর জন্য এগিয়ে এসেছিলেন।
আজকের এই স্বাধীনতা লাভের পেছনে প্রাতঃস্মরণীয় মহাপুরুষদের সাথে স্মরণ করতে হয় হাজার হাজার স্বাধীনতা সংগ্রামীর যাঁরা গ্রামে গঞ্জে সকল বিপ্লব ও আন্দোলনকে পুষ্ট করেছিলেন। তাঁদের সবার কথা আমরা জানি না। তাঁদের অনেকের নাম ইতিহাসের পাতায় নেই। সেই সব বিপ্লবীরা সেই দিন স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে ছিলেন বলেই স্বাধীনতা আন্দোলনের কর্ণধাররা এগিয়ে যেতে পেরেছিলেন।
এই স্মরণ পর্যালোচনা শেষ করার আগে আমি আমার বাবার কথা বলব। আমার বাবা গল্প করে স্বাধীনতা আন্দোলনের কাহিনী শোনাতেন। বাবা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। আমার জেঠতুতো দাদা ঁপঞ্চানন বিজলী আমাদের চুনাখলী গ্রামের ঐতিহ্যপূর্ণ লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলনের কথা বলতে গিয়ে বলতেন ঁহারাধন বর্মন ছিলেন এই আন্দোলনের এখানকার নেতা। আমাদের পুরানো কালী মন্দিরের পাশে ছিল অফিস। আমাদের চুনাখালী গ্রাম নিবাসী প্রবীণ প্রাক্তন শিক্ষক শ্রীতপনকুমার বর্মন বলেন - ইংরেজের পুলিশরা যখন তখন ঢুকে পড়ত এখানে। তারপর গ্রামের লোকদের ধরে নিয়ে গিয়ে এই চুনাখালী ও.দয়ালদাসী গ্রামের সীমানা খালে
গলা অবধি ডুবিয়ে রাখত। শীত কালের কথা বলছি। তারপর বেশ কিছুক্ষণ পরে খাল পাড়ের পশ্চিম পাশে খোলা মাঠে বসিয়ে হাতপাখায় বাতাস দেওয়া হত। ইংরেজ পুলিশ বিপ্লবীদের খোঁজ নিতে এসব করত। এখানে ঁহারাধন বর্মন ও তাঁর ভাই ঁধরণীধর বর্মনকে পুলিশ ধরতে আসত। একবার এভাবে পুলিশ হানা দিয়েছে। হারাধনবাবু পালাতে পারলেন না। তখন রোয়া চাষের সময়। সমস্ত শরীর জলে ডুবিয়ে শুধু নাক জলের উপরে রেখে পুলিশ চলে যাওয়া অবধি জলাজমিতে শুয়ে ছিলেন। কত মানুষের কষ্টের বিনিময়ে আমরা এই স্বাধীনতা পেয়েছি।
পুলিশ এলে মেয়েরা ভয়ে পালিয়ে যেত আমাদের গ্রামের ঁগোলক বর্মনের বাড়িতে। একবার গোলকবাবুর স্ত্রী বিমলা দেবীকে পুলিশ ধরে ফেলে এবং খুব নির্যাতন করে। ঁরাধেশ্যাম জানা বর্মনের মা ঁ গঙ্গামনি দেবী ছিলেন আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী। ঁধরণীধর বর্মনের পুত্র শিক্ষক ঁ কানাইলাল বর্মনও ছিলেন সক্রিয় কর্মী। এ ছাড়াও প্রয়াত শিক্ষক নরেন্দ্রনাথ সামন্ত, ঁক্ষিরোদ হাজরা প্রমুখ আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন।
আমাদের চুনাখালী গ্রামের পুরাতন কালী মন্দির সংলগ্ন কংগ্রেস অফিসে স্বাধীনতা সংগ্রামী ও তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকারের সেনাপতি সুশীল ধাড়া , স্বাধীনতা সংগ্রামী ভূতনাথ সামন্ত প্রমুখ নেতারা আসতেন, মিটিং করতেন।
পুণ্য ভূমি চুনাখালী গ্রামে লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলনের অফিস ছিল। আজকের প্রজন্মের অনেকেই তা জানেন না । এ ভাবে অসংখ্য আন্দোলনের ছোট্ট ভূমি সারা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে আছে। সেগুলিকে জনমানসে তুলে ধরার চেষ্টা করতে হবে, যাতে স্বাধীনতা অর্জনের জন্য যে দুর্বিষহ অবস্থার সম্মুখীন হতে হয়েছিল, আজকের প্রজন্ম তা অনুধাবন করতে পারেন।
স্বাধীনতা পেয়েছি ১৯8৭ খ্রীষ্ঠাব্দে। তারপর স্বাধীনতার জন্য যিনি সারাজীবন সমর্পণ করেছিলেন, তাঁকেই স্বাধীন ভারতে খুন হতে হল। জাতির জনক প্রাণ হারালেন নৃশংস নাথুরাম গডসের হাতে গুলিবিদ্ধ হয়ে। শধু সেখানেই শেষ নয়, এখনও চলছে নৃশংস হত্যালীলা, নারী নির্যাতন, সাম্প্রদায়িক হিংসা, জাতিভেদ প্রভৃতি। আমরা স্বাধীন হয়েছি ঠিক, কিন্তু কতিপয় মানুষ তাকে যথেচ্ছাচারে পরিণত করতে চাইছে। আমরা আমাদের স্বাধীনতা ঠিক মতো রক্ষা করতে পারছি না। বেকারত্ব, ক্ষুধা ও অশিক্ষার জ্বালায় এখনও অনেকেই জ্বলছে।
আসুন সবাই মিলে রুটি,কপড়া আউর মকানের সাথে শিক্ষা , স্বাস্থ্য ও সুশৃঙ্খল রাজত্ব গড়ে তুলতে আমরা সবাই অঙ্গীকার বদ্ধ হই। ভুলবেন না -
'আমরা সবাই রাজা
আমাদের এই
রাজার রাজত্বে।'
--রবীন্দ্রনাথ
এই স্মরণ পর্যালোচনা শেষ করার আগে আমি আমার বাবার কথা বলব। আমার বাবা গল্প করে স্বাধীনতা আন্দোলনের কাহিনী শোনাতেন। বাবা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। আমার জেঠতুতো দাদা ঁপঞ্চানন বিজলী আমাদের চুনাখলী গ্রামের ঐতিহ্যপূর্ণ লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলনের কথা বলতে গিয়ে বলতেন ঁহারাধন বর্মন ছিলেন এই আন্দোলনের এখানকার নেতা। আমাদের পুরানো কালী মন্দিরের পাশে ছিল অফিস। আমাদের চুনাখালী গ্রাম নিবাসী প্রবীণ প্রাক্তন শিক্ষক শ্রীতপনকুমার বর্মন বলেন - ইংরেজের পুলিশরা যখন তখন ঢুকে পড়ত এখানে। তারপর গ্রামের লোকদের ধরে নিয়ে গিয়ে এই চুনাখালী ও.দয়ালদাসী গ্রামের সীমানা খালে
গলা অবধি ডুবিয়ে রাখত। শীত কালের কথা বলছি। তারপর বেশ কিছুক্ষণ পরে খাল পাড়ের পশ্চিম পাশে খোলা মাঠে বসিয়ে হাতপাখায় বাতাস দেওয়া হত। ইংরেজ পুলিশ বিপ্লবীদের খোঁজ নিতে এসব করত। এখানে ঁহারাধন বর্মন ও তাঁর ভাই ঁধরণীধর বর্মনকে পুলিশ ধরতে আসত। একবার এভাবে পুলিশ হানা দিয়েছে। হারাধনবাবু পালাতে পারলেন না। তখন রোয়া চাষের সময়। সমস্ত শরীর জলে ডুবিয়ে শুধু নাক জলের উপরে রেখে পুলিশ চলে যাওয়া অবধি জলাজমিতে শুয়ে ছিলেন। কত মানুষের কষ্টের বিনিময়ে আমরা এই স্বাধীনতা পেয়েছি।
পুলিশ এলে মেয়েরা ভয়ে পালিয়ে যেত আমাদের গ্রামের ঁগোলক বর্মনের বাড়িতে। একবার গোলকবাবুর স্ত্রী বিমলা দেবীকে পুলিশ ধরে ফেলে এবং খুব নির্যাতন করে। ঁরাধেশ্যাম জানা বর্মনের মা ঁ গঙ্গামনি দেবী ছিলেন আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী। ঁধরণীধর বর্মনের পুত্র শিক্ষক ঁ কানাইলাল বর্মনও ছিলেন সক্রিয় কর্মী। এ ছাড়াও প্রয়াত শিক্ষক নরেন্দ্রনাথ সামন্ত, ঁক্ষিরোদ হাজরা প্রমুখ আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন।
আমাদের চুনাখালী গ্রামের পুরাতন কালী মন্দির সংলগ্ন কংগ্রেস অফিসে স্বাধীনতা সংগ্রামী ও তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকারের সেনাপতি সুশীল ধাড়া , স্বাধীনতা সংগ্রামী ভূতনাথ সামন্ত প্রমুখ নেতারা আসতেন, মিটিং করতেন।
পুণ্য ভূমি চুনাখালী গ্রামে লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলনের অফিস ছিল। আজকের প্রজন্মের অনেকেই তা জানেন না । এ ভাবে অসংখ্য আন্দোলনের ছোট্ট ভূমি সারা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে আছে। সেগুলিকে জনমানসে তুলে ধরার চেষ্টা করতে হবে, যাতে স্বাধীনতা অর্জনের জন্য যে দুর্বিষহ অবস্থার সম্মুখীন হতে হয়েছিল, আজকের প্রজন্ম তা অনুধাবন করতে পারেন।
স্বাধীনতা পেয়েছি ১৯8৭ খ্রীষ্ঠাব্দে। তারপর স্বাধীনতার জন্য যিনি সারাজীবন সমর্পণ করেছিলেন, তাঁকেই স্বাধীন ভারতে খুন হতে হল। জাতির জনক প্রাণ হারালেন নৃশংস নাথুরাম গডসের হাতে গুলিবিদ্ধ হয়ে। শধু সেখানেই শেষ নয়, এখনও চলছে নৃশংস হত্যালীলা, নারী নির্যাতন, সাম্প্রদায়িক হিংসা, জাতিভেদ প্রভৃতি। আমরা স্বাধীন হয়েছি ঠিক, কিন্তু কতিপয় মানুষ তাকে যথেচ্ছাচারে পরিণত করতে চাইছে। আমরা আমাদের স্বাধীনতা ঠিক মতো রক্ষা করতে পারছি না। বেকারত্ব, ক্ষুধা ও অশিক্ষার জ্বালায় এখনও অনেকেই জ্বলছে।
আসুন সবাই মিলে রুটি,কপড়া আউর মকানের সাথে শিক্ষা , স্বাস্থ্য ও সুশৃঙ্খল রাজত্ব গড়ে তুলতে আমরা সবাই অঙ্গীকার বদ্ধ হই। ভুলবেন না -
'আমরা সবাই রাজা
আমাদের এই
রাজার রাজত্বে।'
প্রাবন্ধিক দুরন্ত বিজলীর প্রবন্ধ " আমরা সবাই রাজা" খুব নরম ভাষায় লেখা দেশের ইতিহাস নিয়ে সুপাঠ্য গদ্য। সব নিয়ে একটা নিটোল লেখা। তথ্যের নিরসতা নেই, বরং এতে আছে তথ্যের মহতি যৌলুস। আমি পাঠক হিসেবে মুগ্ধ। লেখাটি স্কুল পাঠ্যে পড়ালে ছাত্রছাত্রিরা জেগে উঠতো একটা বিরল সুখে।
উত্তরমুছুনএই লেখকের নানা আইটেমের লেখা চাই।