আমাদের স্বামী বিবেকানন্দ
শ্রদ্ধা ও স্মরণে -অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়
ঠাকুর শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ নরেনকে
নিত্যসিদ্ধ বলে পাতালফোঁড়া শিবের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। কোনও কোনও জায়গায়
শিবলিঙ্গ যেমন নিজে থেকে আবির্ভূত হন নিত্যসিদ্ধের পৃথিবীতে আশা ঠিক সেইরকম।
ঠাকুর শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ বলেছেন –
নরেন পদ্মের মধ্যে সহস্রদল। মায়ামোহ নাই – যেন কোন
বন্ধন নাই। খুব ভাল আধার। একাধারে অনেক
গুণ, গাইতে, বাজাতে, লিখতে, পড়তে! এদিকে জিতেন্দ্রিয় – বলেছে বিয়ে করবো না। নরেন্দ্র বেশি আসে না। সে ভাল। বেশি এলে আমি
বিহ্বল হই।
নরেন যেদিন প্রথম দক্ষিণেশ্বরে গিয়েছিলেন, ঠাকুর শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ সেদিন তাঁর কাছে দাঁড়িয়ে স্তব পাঠ
করেছিলেন। বলেছিলেন – তুমি জান না তুমি
কে! আমি জানি। নররূপী নারায়ণ তুমি। এসেছ লোককল্যাণের জন্য।
স্বামীজী একদিন ঠাকুরের কাছে
সমাধিলাভের ইচ্ছা জানিয়েছিলেন। সর্বক্ষণ
সমাধিতে মগ্ন হয়ে থাকবেন, এই তাঁর ইচ্ছা।
একথা শুনে ঠাকুর বলেছিলেন – ছিঃ তোর এত হীন বুদ্ধি? তুই হবি একটা বিশাল বটগাছের মত। লোকে তোর কাছে এসে ছায়া পাবে, আশ্রয় পাবে,
শান্তি পাবে।
স্বামী বিবেকানন্দের মত মানুষ
যে কোন দেশে যে কোন সময়ে যদি আলাদা আসেন, তবে পৃথিবীর লোক কৃতার্থ হয়ে যায় এ বিষয়ে মিস ম্যাকলাউড স্বামীজী সম্পর্কে বলেছেন – তোমরা স্বামীজিকে এখন বুঝবে না। দেশ যদি কোনদিন স্বাধীন হয় তবে সেদিন বুঝবে। আমাদের দেশে যদি তিনি জন্মাতেন, দেখতে
কী সম্মান তাঁকে আমরা দিতাম। মাথার মনি
করে রাখতাম তাঁকে। কিন্তু তোমাদের দেশ,
হায়! এ এক আত্মবিস্মৃত দেশ। নিজেকে ভুলে
গিয়েছে। নিজের মানুষকে চিনতে পারে না। মিস ম্যাকলাউড বলতেন – স্বামীজিকে যেদিন
প্রথম দেখেছি, সেই দিনই আমার প্রকৃত জন্মদিন। ঐ দিন থেকে আমি বয়সের হিসাব করি। তার
আগে কি আর মানুষ ছিলাম?
মেরি লুই বার্ক বলেছেন –
পাশ্চাত্য দেশবাসীদের প্রতি স্বামীজী বিশেষ অনুগ্রহ। আমরা বলি স্বামীজি আমাদের। উনি দাবি করেন
স্বামীজী ওদের। উনি বলেন, যেসব উদ্দীপক
কথা স্বামীজী ওদের বলেছেন সে সব ভারতবর্ষে তিনি বলেন নি।
স্বামী অভেদানন্দ কথাপ্রসঙ্গে
স্বামীজী সম্পর্কে বলেছিলেন – স্বামীজীকে যেদিন বিলাতে প্রথম দেখলাম, তাঁর অসাধারণ
ব্যক্তিত্ব আর পান্ডিত্যের শক্তি দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। ভাবছিলাম, আমাদের সেই নরেন তাঁর এই তেজোময়
ব্যক্তিত্ব!
এসব ঈশ্বরের অনুগ্রহ ছাড়া হয় না ।
যেমন বুদ্ধি, তেমনি হৃদয়, তেমনি কর্মশক্তি, তেমনি ব্যক্তিত্ব। স্বামীজি সব
দিক দিয়েই অনন্য। কাজেই তাঁকে কেউ অবতার
বললে সেটা অতিকথন হয় না।
রোঁমা রোঁলা বলেছেন - স্বামী
বিবেকানন্দ কোথাও দ্বিতীয় স্থানে আসীন একথা আমি ভাবতেই পারি না। আমি আজ এত বছর পরে স্বামী বিবেকানন্দের কথা যখন পড়ি, ছাপা কথা, আমার শরীর দিয়ে
যেন বৈদ্যুতিক শক্তি বয়ে যায়।
স্বামী সারদানন্দ বলতেন – আমার
গানে রুচি ছিল না, কিছু বাজাতেও পারতাম না।
কিন্তু স্বামীজীর চাপে পড়ে একটু বাজনা শিখতে হলো। স্বামীজী যখন তাঁর দিদিমার বাড়ির একটা
চিলেকোঠায় থাকেন। সেখানে আছে একটা
তানপুরা আর একটা ভাঙা বাঁয়া। গানের সঙ্গে
ঠেকা না হলে চলে না। স্বামীজীর ওখানে
গেলে বাধ্য হয়ে আমাকে ঠেকা দিতে হতো। এই
করতে করতে তবলা শিখে গেলাম। এমনি মানুষ
স্বামীজী। নিজে আনন্দে ভরপুর, অপরের মনও
ভরিয়ে দিতেন আনন্দে। কখনো গম্ভীর মুখ করে
থাকতেন না। একজন তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিল –
মশায়, আপনি কি গম্ভীর হতে পারেন না?
উত্তরে স্বামীজী বলেছিলেন – পারি বই কি, যখন পেট কামড়ায় তখন গম্ভীর হই।
স্বামী ওঁঙ্কারনন্দ (অনঙ্গঁ
মহারাজ) বলতেন – আমরা যখন প্রথম মঠে যাতায়াত করি স্বামীজীর বই-টই পড়ি, তাঁর ছবি
দেখি তখন ভাবতাম, আমাদেরও তো ওইরকম স্বাস্থ্য আর পড়াশুনোও তো কিছু আছে –স্বামীজি
বি.এ., আমি এম.এ.পাশ করেছি। স্বামীজীর চেয়ে আমরা এক পা এগিয়ে যাব। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে ততই দেখছি, কোথায়
স্বামীজী আর কোথায় আমরা! সাড়া জীবন কাটিয়ে দিলাম, তবু তাঁকে বুঝতেই পারি না। আর তাঁকে ছোঁয়া? সে তো আরো কঠিন।
স্বামীজীর ধ্যানের যে বিখ্যাত
আলোকচিত্রটি আছে সেটি লন্ডনে তোলা। স্বামীজীর অনুরাগীরা
স্বামীজীর ধ্যানমূর্তির একখানি ছবির জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেন। একদিন ছবি তোলার ব্যবস্থা হল। স্বামীজী স্থির হয়ে বসলেন। সঙ্গেঁ সঙ্গেঁ
গভীর ধ্যানে নিমগ্ন।
আমেরিকায় পার্লামেণ্ট অফ
রিলিজিয়নস-এ বক্তৃতার পর তাঁর নাম যশ যখন চারিদিকে ছড়িয়ে পরে সবাই যখন তাঁর
প্রশংসায় পঞ্চমুখ, সেই সময় যে বাড়িতে তিনি থাকতেন সেই ঘরে বসে তিনি কাঁদছিলেন। তিনি অবাক হয়ে ভাবছিলেন – এ কি হলো?
এই নাম যশ খ্যাতি এসবের কী প্রয়োজন আমার?
বলেছিলেন – মা, আমাকে তুমি আমার পুরানো জীবনে ফিরিয়ে নিয়ে যাও। এসব আমি চাই না। এই কথা শুধুমাত্র তাঁর পক্ষে বলাই সম্ভব। আমেরিকা থেকে রামকৃষ্ণানন্দকে তিনি চিঠিতে
জানিয়েছিলেন - ... আমার নামের আবশ্যক নাই । I want to be a voice without a form । আমি যন্ত্র, তিনি যন্ত্রী । তিনি আরো
বলেছিলেন – যদি আমি জগতের কোথাও সত্য ও ধর্ম সম্বন্ধে একটি কথা বলিয়া থাকি, তাহা
আমার গুরুদেবের আর ভুলভ্রান্তিগুলি আমার।
স্বামীজী শঙ্করাচার্যের মতই প্রতিষ্ঠাকে ঘৃনা করতেন। শেক্সপিয়রের মতে – নাম,যশ,আকাঙ্খা মানুষের
সবচেয়ে বড় দুর্বলতা। স্বামী বিবেকানন্দ এসবের ধার ধারতেন না। কোথাও কোন কাগজে তাঁর সম্পর্কে কী প্রশংসার কথা
ছাপা হয়েছে সেই বিষয়ে তাঁর কোন কৌতূহল ছিল না।
নাট্যকার গিরিশচন্দ্র ঘোষ স্বামীজী সম্পর্কে একটি কবিতায় বলেছেন – ‘তারা উজ্জল পশিল ধরাপর, নির্মল গগন বিকাশি’
কবি নজরুল ইসলাম স্বামীজীসম্পর্কে তাঁর অন্তরের শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন এইভাবে –
যজ্ঞাহুতির হোম-শিখাসম
তুমি তেজস্বী তাপস পরম।
স্বামীজীর শিষ্যা সিস্টার
ক্রিস্টিন বলেছেন – অনেক যুগ যুগ পরে এক একজন লোকের আবির্ভাব হয় । তাঁরা যে জগতের মানুষ নন। অন্য এক জগত থেকে তাঁরা আসেন অর্থাৎ a wonder from another sphere ঐ যে সপ্তর্ষী অখন্ডের ঘর সেই জগতের মানুষ তিনি হঠাৎ আমাদের মধ্যে এসে উপস্থিত
হয়েছিলেন।
স্বামীজীর শিষ্যা মিসেস ফাঙ্ক
লিখেছেন – স্বামীজি আমাদের অন্তরে এমন এক আগুণ জ্বেলে দিয়েছেন যা অনির্বাণ।
শিকাগোতে প্রথম দিনের বক্তৃতার শেষে তাঁকে সবাই ঘিরে ধরেছে। বিশেষ করে
মেয়েরা। একটি বৃদ্ধা এক পাশে দাঁড়িয়ে
দেখছেন সেই দৃশ্য। তরুণ সন্ন্যাসী
স্বামীজীর সঙ্গে এতগুলো মেয়ে হ্যান্ডসেক করছে।
সেই বৃদ্ধা মনে মনে ভাবছেন – তুমি যদি এ আক্রমণ সহ্য করতে পার তাহলে বুঝবো
তুমি সাক্ষাৎ ভগবান! অনেক পরে সেই মহিলাই বলেছেন – আমি সেদিন এই কথা ভাবছিলাম। তারপর কাগজে তাঁর কথা পড়েছি। নিজে গেছি তাঁর কাছে। পরীক্ষা করে বুঝেছি, সত্যি তিনি অদ্ভুত!
অপাপবিদ্ধ।
স্বামীজী স্বয়ং বলেছেন – কোন সুন্দরী নারী যদি আমার দিকে অন্য দৃষ্টিতে তাকায়, সেই মুহূর্তে সে একটি ব্যাঙে পরিনত হয়ে যাবে। স্বামীজী যখন প্রশান্ত মহাসাগরের থাউজ্যান্ড আইল্যান্ড পার্কে ছিলেন তখন তিনি ধ্যান-ধারণা সম্পর্কে শিক্ষাদান করছিলেন। একদিন রাত ন’টায় দুটো অপরিচিত মেয়ে ঘুরতে ঘুরতে ওখানে উপস্থিত। স্বামীজিকে দেখে তাঁরা বললে – শুনেছি, আপনি এখানে আছেন তাই এসেছি। যেমন একদিন সবাই আসতো যীশু খ্রিষ্টের কাছে। তেমনি আজ আমরা এসেছি আপনার কাছে। আপনি সেই ঈশ্বরের দূত। তাঁদের কথা শুনে স্বামীজি উত্তরে বলেছিলেন – আমার যদি যীশু খ্রিষ্টের মতো ক্ষমতা থাকতো তবে এখনি তোমাদের মুক্ত করে দিতাম।
আমেরিকায় থাকার সময় স্বামীজীকে
একজন জিজ্ঞাসা করেছিলেন – স্বামীজী, আপনি কি ঈশ্বরকে প্রত্যক্ষ করেছেন?
স্বামীজী উত্তরে বলেছিলেন –আমাকে দেখে তাই মনে হয় বুঝি? আমার মতো মোটা লোক কি ঈশ্বর দর্শন করতে পারে?
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন