লেবেল

বৃহস্পতিবার, ২৮ অক্টোবর, ২০২১

ধারাবাহিক রহস্য উপন্যাস (পর্ব-৬) ।। ট্রেকিংয়ের পথে রহস্য — অনন্যা দাশ।। Ankurisha ।E.Magazine ।।Bengali poem in literature ।

 






ধারাবাহিক রহস্য উপন্যাস  (পর্ব-৬)


ট্রেকিংয়ের পথে রহস্য 

অনন্যা দাশ 



শিকারির চোখ দুটো ধ্বক করে জ্বলে উঠল। সামনে দাঁড়ানো দুটো লোকের মধ্যে একজনের বুক দুরু দুরু শুরু হয়ে গেল। অন্যজনের অবশ্য ভ্রুক্ষেপ নেই। সে মনের সুখে হট ডগ খেয়ে চলেছে।

শিকারির রেগে যাওয়া মানে বিপদের সঙ্কেত সেটা ব্রুনো জানে তাই ওর বুকে ধুক পুক।

“একটা কাজ যদি তোরা ঠিক করে করতে পারিস! পার্কিং লটে অ্যালার্ম অন করে লোক জড়ো করে ফেললি তাই কিছুই হল না। তারপর ছেলে দুটোকে ফলো করতে বললাম তাও পারলি না মাঝপথেই ফিরে এলি!”

ওরা তো লাইব্রেরিতে ঢুকে বসে ছিল। আপনি তো জানেনই স্যার অ্যালের লাইব্রেরির প্রতি কেমন অ্যালার্জি। বই দেখলেই ওর কান কটকট, নাক সরসর, গা ম্যাজম্যাজ ইত্যাদি নানা রকম উপসর্গ দেখা দেয়! লাইব্রেরির সামনে ওকে কেউ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেই নাকি ওর সর্বনাশ হয়ে যেতে পারে! তাছাড়া ওর খিদেও পাচ্ছিল। খিদে পেলে ও কী রকম হয়ে যায় তো জানেনই তাই ওখানে আর থাকা গেল না। ছোকরাগুলো খুব চালাক বলতে হবে!”

“হুঁ। এবার থেকে গাড়িতে খাবার নিয়ে রাখবি বলে দিচ্ছি! তোদের ট্যাঁ ফোঁর চোটে আর পারি না!”

“আজকে ওকে যে হট ডগগুলো কিনে দিলাম সেগুলোর দামটা পাবো তো? অ্যাল বারোখানা হট ডগ কিনেছে!”

“ঠিক আছে বাবা ক্যাশিয়ারের কাছ থেকে নিয়ে নিস। তবে এর পর থেকে এই রকম সব বোকা বোকা কারণে কাজ ছেড়ে পালিয়ে আসলে তোর আঙ্গুলগুলো কেটে হট ডগ বানিয়ে অ্যালকে খাইয়ে দেবো! মনে থাকে যেন!”

ব্রুনো কোন রকমে পালিয়ে বাঁচল। অ্যাল তখনও নির্লিপ্ত ভাবে খেয়েই চলেছে।



বুধবার দিন সকালের কয়েকটা ক্লাস করেই ওরা বেরিয়ে পড়ল। গ্রান্টের মৃত্যুর খবরটা তো সবাই জানে তাই ওর ফিউনারালে যাচ্ছে শুনে প্রোফেসাররা কেউ আপত্তি না করেই অনুমতি দিয়ে দিলেন। নাহলে ক্লাস কামাই করাটা এরা মোটেই ভালো চোখে দেখে না।

রকের গাড়ি করেই যাচ্ছিল ওরা। রক আর প্যাট্রিক সামনের সিটে আর পিছনের সিটে অঙ্কন আর ভজা। যদিও ভজার মোটেই যাওয়ার ইচ্ছে ছিল না। বার বার বলছিল, “ওকে তো আমি তেমন ভালো করে চিনতামও না। ওর পরিবারের এই রকম একটা দুঃসময়ে আমরা গিয়ে পড়ব সেটা আমার ঠিক ভালো লাগছে না। মনে হচ্ছে যেন ওদের একটা প্রাইভেট মুহূর্তে ঢুকে পড়তে চলেছি!”

রক কিন্তু ওর কোন আপত্তি শুনল না। বলল, “গ্রান্ট আমার বন্ধু ছিল। খুব ভালো বন্ধু। আমার মন বলছে ওকে খুন করা হয়েছে এবং আমি চাই যে ওই নৃশংস খুনির শাস্তি হোক। সেই জন্যেই তোমাদের ওখানে যেতে হবে। সব কিছু দেখতে হবে। আমি ও সব পারি না। প্লিজ, আমার জন্যে আমার বন্ধুর জন্যে তোমরা চলো!”

এর পর আর ভজা কিছু বলেনি।

গ্রান্টের বাড়িটা সমুদ্রের ধারে ছোট্ট একটা গ্রামে। দু ঘন্টার ড্রাইভের পর ওরা যখন ওখানে পৌঁছল তখন দুটো বাজে। চার্চের অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে। ওরা চারজন একেবারে পিছনের একটা সারিতে গিয়ে বসল। সামনে একটা কাসকেটে গ্রান্টের মৃতদেহ রাখা। ওরা এসে বসামাত্র লোকজন পিছনে ফিরে ফিরে ওদের দেখতে লাগল। তাদের দৃষ্টিতে যেন রাজ্যের ঘৃণা ঝরে পড়ছিল। কয়েকজন গান গাইছিল।

অঙ্কন ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, “কী হচ্ছে বল তো? সবাই ওই রকম করে তাকাচ্ছে কেন আমাদের দিকে?”

“কী জানি। আমরা অচেনা লোক মাঝপথে ঢুকে এসেছি সেই জন্যেই হবে!”

বেশ অস্বস্তির মধ্যে কাটল সময়টা। চার্চের সার্ভিসের পর কফিনটা কবর দেওয়ার জন্যে গোরস্থানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল একটা কালো গাড়ি করে। ভজারা কী করবে ভাবছে এমন সময় এক বয়স্ক ভদ্রলোক ওদের দিকে এগিয়ে এসে বললেন, “তোমরা কেন এসেছো এখানে? আমার ছেলেটা তো চলে গেছে এখন কী নিয়ে এসেছো?”

রক আমতা আমতা করে বলল, “না, মানে গ্রান্ট আমার খুব ভালো বন্ধু ছিল। ওর ওইভাবে চলে যাওয়াটা আমি এখনও মেনে নিতে পারছি না তাই এলাম। আমিই খাদে ওর মৃতদেহ প্রথম দেখতে পাই!”

“আমি ও সব নিয়ে কোন কথা বলতে চাই না! যার যাওয়ার সে গেছে – এবার আমাদের বাঁচতে দাও! তোমরা যাও! তোমাদের যেন আর এ তল্লাটে না দেখি!” শেষের দিকে ওনার গলার স্বর বেশ রূঢ় হয়ে উঠল।

কথা শেষ করে উনি মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে একটা কালো গাড়িতে গিয়ে উঠে পরলেন। গাড়িতে এক মহিলা বসে ছিলেন, তিনি খুব কাঁদছিলেন। দেখে তো গ্রান্টের মা বলেই মনে হচ্ছিল।

ওরা চারজন অপমানে জর্জরিত হয়ে স্থম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

প্যাট্রিক রেগে গিয়ে বলল, “আচ্ছা অসভ্য লোক তো! আমরা এত দূর থেকে ক্লাস কামাই করে এলাম গ্রান্টের জন্যে আর উনি ওই রকম ব্যবহার করলেন!”

ভজা এতক্ষণ চুপ করে ছিল। এবার সে বলল, “ভয়। সাংঘাতিক কিছু একটার জন্যে উনি মারাত্মক ভয় পেয়েছেন। আমরা কাইনেসিওলজিতে বডি ল্যাঙ্গুয়েজ নিয়ে পড়াশোনা করি। আমি ওনার চোখের দৃষ্টি আর ওনার অঙ্গভঙ্গি থেকে বুঝতে পারছি যে উনি প্রবল ভাবে ভয় পেয়েছেন। এই রকম একটা ঘটনার পর শোক আর শক দুটোই বেশি মাত্রায় দেখা যায় নিকট জনদের মধ্যে কিন্তু ভয়? ভয় কেন হবে? কিছু একটা ব্যাপার চলছে এখানে যেটা আমরা জানি না। এখানে কোন হোটেল আছে যেখানে আজ রাতটা থাকা যাবে? আমি পুরো ব্যাপারটাকে আরেকটু কাছ থেকে দেখতে চাই।”

ওদের পাঠ্য বিষয় কাইনেসিওলজিতে একটা অংশ হল বডি ল্যাঙ্গুয়েজ থেকে কিছু বোঝার চেষ্টা করা। মোটামুটি মিথ্যেবাদীদের ধরার চেষ্টার জন্যে তিনটে জিনিস লক্ষ করার চেষ্টা করে ওরা। বডি ল্যাঙ্গুয়েজ, কথা বলার ধরন – মানে গলার স্বরের ওঠানামা বা কথা বলতে বলতে থামা আর কী বলা হচ্ছে সেটা। প্রথম দুটোর ওপর মানুষের খুব একটা নিয়ন্ত্রণ থাকে না। কী বলছে সেটা বরং লোকে ভেবে বলে কিন্তু কথা বলার সময় শরীরের ভঙ্গিমা বা কথা বলার সময় স্বরের পরিবর্তন সেই সব নিয়ে লোকে মোটেই ভাবে না। তাই ওরা প্রথমে একটা বেসলাইন তৈরি করে নেয়, মানে সাধারণ আচরণের রীতিনীতি, তারপর তার সঙ্গে পরের আচরণের তফাৎ মিলিয়ে দেখে এই ভাবেই নানা রকম পদ্ধতিতে কেউ কিছু লুকোচ্ছে কিনা, বা কার কী রকম প্রবৃত্তি সেগুলো বোঝা যায়। 

একটু দূরেই সি সাইড স্লিপ মোটেলে একটা ঘর নিল ওরা। প্যাট্রিক আর থাকতে চাইল না তাই রককে ফিরতে হল। অঙ্কন ভজা বলল ওরা একটা গাড়ি ভাড়া নিয়ে ফিরে যাবে।

অঙ্কন অবশ্য একটু গাঁই গুঁই করছিল, “কালকের ক্লাস মিস হয়ে যাবে আর শুধু শুধু গাড়ি জন্যে এক গাদা ভাড়া গুনতে হবে,” বলে।

ভজা বলল, “ক্লাস মিস হওয়া নিয়ে চিন্তা করিস না আমি তোকে বুঝিয়ে দেব। আর গাড়ি ভাড়া...একটা জলজ্যান্ত ছেলে দুম করে এমন ভাবে মরে গেল আর তার বাড়ির লোকজন ভয়ে কাঁটা সেটা কেন বোঝার চেষ্টা না করেই তুই আমাকে পালিয়ে যেতে বলছিস? না, আমি যাচ্ছি না।”

অগত্যা অঙ্কনকেও থাকতে রাজি হতে হল।  

কিছুক্ষণ পরে অঙ্কন হোটেলের বিছানায় বসে বসে রাতে কী খাওয়া যায় সেই মেনু বুকলেটটা উলটে পালটে দেখছিল। ভজা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিল হঠাৎ বলল, “এই অঙ্কন শোন, এখানে আয় এই পর্দাটার কাছে। খোলা জানালার দিকটায় যাস না।”

কিছু একটা ঘটছে বাইরে সেই আশঙ্কা করে অঙ্কন ভজার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। হোটেলের পার্কিং লটটা দেখা যাচ্ছে ওই জানালাটা দিয়ে। সি ভিউ ঘরের দাম অনেক বেশি তাই ওরা পার্কিং লট ভিউ ঘরই নিয়েছে। একটা ধূসর রঙের গাড়ি থেকে দুজন লোক সুটকেস নামাচ্ছে। তাদের একজনের বিশাল চেহারা। অন্তত ছ’ফুট চার পাঁচ তো হবেই, সঙ্গে মানানসই মাসেল। অন্যজন অবশ্য মাঝারি গড়নের কিন্তু তার পিছন পিছনই গেল বিশাল বপু লোকটা।

অঙ্কনের চোখ গোলগোল হয়ে গেল, “এটা তো সেই ধূসর গাড়িটা রে, যেটা আমাদের পিছু নিয়েছিল!”

ভজা বলল, “হ্যাঁ, তাই তো মনে হচ্ছে!”



চলবে...






কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন