আষাঢ়ে গপ্প কথা -১৩
বিশ্বজিৎ রায়
চিরকুট
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটা খুব পুরনো উপন্যাস আছে "কালো রাস্তা সাদা বাড়ি"। সেই উপন্যাসটা পড়তে পড়তে হঠাৎ অনেকদিন পর সুতপার কথা মনে পড়ে গেল দীপাঞ্জনের। আসলে, তাপসী নামে একটা চরিত্র আছে ওই উপন্যাসটাতে। তার সঙ্গে কোথাও মিল আছে বলে হয়তো অবচেতনে সুতপার কথা হঠাৎ মনে পড়ে গেছে ওর। সেতো একযুগ আগের কথা, তবুও কেন মনে পড়ল সুতপাকে! যেন, বহুদিন পর গভীর সমুদ্র থেকে হঠাৎ উঠে এলো একটা মুখ, আর তার সঙ্গে কিছু হীরকচূর্ণ দিন।
দীপাঞ্জন মনে রাখেনি সেইসব দিনগুলোর কথা। স্বেচ্ছায় কালের সমুদ্রগর্ভে বিলীন করে দিয়েছে সব স্মৃতিগুচ্ছ। এখন সে বিবাহিত। স্ত্রী-পুত্র-কন্যা নিয়ে ঘোর সংসারী। পুরনো দিনগুলোর কথা প্রতিদিনের গতিময় জীবন থেকে কবেই মুছে গেছে। কিন্তু, আজ হঠাৎ সেই দিনগুলোর কিছুটা ঝলক ফিরে আসাতে নিজেই কেমন চমকে গেল। সুতপার সঙ্গে প্রেমের দিনগুলো ---- স্কুল, কলেজ, দুর্গাপুজো, গঙ্গার পাড়,পিকনিক, বসন্ত উতসব.... সব কেমন পুরনো দিনের সাদাকালো সিনেমার মতো চোখের সামনে ভাসতে লাগল......
কিন্তু, এই প্রেম কালের চিত্রনাট্য অনুযায়ী শেষ পর্যন্ত পরিনতি পায়নি। সেসময় মধ্যবিত্ত বেকার যুবকদের জীবনে প্রায়ই যা ঘটতো, সেটাই ঘটে ছিল দীপাঞ্জনের জীবনে। একটা ভালো চাকরির জন্য হন্যে হয়ে ঘুরতে ঘুরতে ক্রমশ যখন দিনগুলো অন্ধকার হয়ে উঠছিল, ঠিক তখনই সুতপা ওর বাড়ির বদরাগী জ্যাঠা ও বাবার চাপে ছাদনাতলায় যেতে বাধ্য হয়েছিল। দীপাঞ্জনের হয়ে কিছু বলার মতো ওর জোর ছিলনা মনে। এমনিতেই একটা 'নেগেটিভ পয়েন্ট ' নিয়ে তারা ঘুরছিল। সুতপারা 'মুখার্জি' আর দীপাঞ্জনরা 'পাল'। ভেবেছিল, দীপাঞ্জন একটা ভালো চাকরি পেয়ে গেলে ওই 'নেগেটিভ পয়েন্ট' ফুতকারে উড়িয়ে দেবে। কিন্তু, বিধাতা তা হতে দিলেন কই? পড়াশোনায় এতো ভালো হয়েও একটা ভালো চাকরি যোগাড় করতে দীপাঞ্জনের খুব বেগ পেতে হয়েছিল সে'সময় । কিন্তু, সেই ভালো চাকরি ও শেষপর্যন্ত পেয়েছিল। একসঙ্গে তিন জায়গায়। তিনটের মধ্য থেকে ব্যাঙ্কের চাকরিটাই বেছে নিয়েছিল। ততদিনে সুতপার বিয়ের দেড় বছর কেটে গেছে। পেটে সন্তান এসে গেছে।
চাকরি পেয়ে দীপাঞ্জন আর পিছন ফিরে তাকায় নি। বুকের ওপর থেকে সুতপা নামক পাথরটাকে সরিয়ে দিয়ে শুরু করেছিল নতুন জীবন। কাকলি ঘরে এসে সুতপাকে চিরদিনের মতো ভুলিয়ে দিয়েছিল।...... কিন্তু, এতদিন পর আবার কী করে সুতপা বেরিয়ে এলো সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের উপন্যাসের পাতার ভেতর থেকে সেটাই একটা বিস্ময়! যাইহোক, মন থেকে সেটাকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতে থাকল দীপাঞ্জন।
উপন্যাসটা শেষ করার ঠিক তিনদিন পর অরুণার সঙ্গে পাড়ার একটা ওষুধের দোকানে দেখা হলো। অরুণা, সুতপা, দীপাঞ্জন এক স্কুলে একসঙ্গে পড়তো। সুতপা-অরুণা হরিহরাত্মা ছিল। সুতপা-দীপাঞ্জনের প্রেমের পুঙখানুপুঙখ জানত অরুণা। সুতপাদের কয়েকটা বাড়ির পরেই ওদের বাড়ি একই পাড়ায়। অরুণার ভালো ঘরে বিয়ে হয়েছে। গড়িয়াতে শ্বশুর বাড়ি। সেখানেই থাকত বিয়ের পর। কিন্তু, অরুণার বাবা মারা যাওয়ার পর এবং ওর ভাই ব্যাঙ্গালোরে চাকরি সূত্রে থাকার কারণে অরুণা বাধ্য হয়ে ছেলে - স্বামীকে নিয়ে মায়ের কাছে থাকে এখন কয়েক বছর ধরে। সেই অসুস্থ মায়ের ওষুধ নিতে দোকানে এসেছে। দীপাঞ্জনের সঙ্গে কদাচিৎ দেখা হয় পাড়ায়। আজ যেমন হঠাৎ হলো। ওষুধ নিয়ে দোকান থেকে বেরনোর সময় দীপাঞ্জনকে দেখে অরুণা ----" আরে দীপু, কেমন আছিস? খুব ভালো হয়েছে তোর সঙ্গে দেখা হয়ে। একদিন সময় পেলে আমাদের বাড়ি একবার আসিস তো, দরকার আছে।"
--- মাসীমা কেমন আছে রে?
---- আর কেমন, ওই বিছানায় শোয়া।.... তুই এলে খুশী হবে।
----- আচ্ছা যাব। সামনের রোববার সকালে বাজার টাজার সেরে।
----- কী দরকার আছে এখন বলা যাবেনা ?
---- বাড়িতে আয়না, বলব।
ঠিক তার দুদিন পর রবিবারে বাজার-হাট-ব্রেকফাস্ট সেরে অরুণাদের বাড়ি গেল। বিছানায় শোয়া অরুণার মায়ের সঙ্গে অনেক কথা টথা বলার পর দীপাঞ্জন চা খেতে খেতে অরুণাকে বলল---- নে, কী বলবি বলেছিলি, বল?
অরুণা ---- বলছি বলছি। ( দু চারটে নানারকম কথা বলার পর আসল কথাটা পাড়ল অরুণা) আরে, কদিন আগে তপু এসেছিল। ( সুতপার ডাক নাম তপু)
----- তপু এসেছিল? তাতে কী হয়েছে? আমি কী করব?
----- কিছুনা। শোননা হাঁদা। তপুর জেঠিমা খুব অসুস্থ, তাকে দেখতে এসেছিল। সেইসঙ্গে আমার মাকেও দেখে গেল।.... অনেকদিন পর দেখা হওয়াতে অনেক গল্প হলো আমাদের। পুরনো, নতুন অনেক গল্প। তোর প্রসঙ্গেও অনেক কথা হলো। অনেক কিছু জিজ্ঞাসাও করল তোর ব্যাপারে। এই ফোন নম্বরটা দিয়ে গেছে তোর জন্য । (বলে, একটা চিরকুট ধরিয়ে দিল দীপাঞ্জনের হাতে।)
------ দীপাঞ্জন দোনমনা করে চিরকুটটা হাতে নিয়ে দেখল তাতে একটা মোবাইল নম্বর লেখা আছে--- ৯৮_ _ _ _ _ _ _ _
----- পারলে একদিন ফোন করিস। খুব খুশী হবে ও।
----- আচ্ছা, দেখব।
বলে, অরুণাদের বাড়ি থেকে বেরলো যখন ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে। ছাতা মাথায় হাঁটতে হাঁটতে, ভাবতে ভাবতে অনেকদূরে একটা সাদা বাড়ি দেখল দীপাঞ্জন, ধূসর জলধারায় ঝাপসা। সামনে কালো লম্বা একটা পিচরাস্তা। বাড়িটার ছাদে একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে ছায়া ছায়া, অস্পষ্ট। তাপসী না সুতপার মতো, সেটা ঠিক বোঝার আগেই আরও জোরে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল...
আরও পড়ুন 👇🏾👇🏾
https://wwwankurisha.blogspot.com/2021/07/ankurisha-emagazine-bengali-poem-in_27.html
কৈশোর ও যৌবনের সোনাঝরা দিনগুলিতে অনেকেই
উত্তরমুছুনপ্রেমে পড়ে কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেই প্রেম নানান কারণে চিরস্থায়ী হয় না।তা স্মৃতি হয়েই থেকে যায়। মাঝে মাঝেই তা উঁকি দিয়ে যায়।
গল্পটি পড়ে খুব ভালো লাগলো।