ধারাবাহিক ভ্রমণকথা (পর্ব-১৯)
পৃথিবীর উল্টো পিঠ
বিশ্বেশ্বর রায়
আবার চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে পরিস্থিতি প্রায় পুরোপুরি পাল্টে গেল৷ বাবাই বিভিন্ন জায়গায় mail করেছিল তার মধ্যে বেশ কয়েকজন উত্তর দিয়েছে৷ শেষ পর্যন্ত মনে হয় ও এখানে থেকে যেতে পারবে অন্য কোনো প্রজেক্টে৷ এবং সেটা সম্ভবত Bank of America-তে৷ তবে work place কোথায় হবে তা সঠিক জানতে পারে নি৷ তবে ক্যানসাস সিটিতে অবশ্যই নয়৷ শার্লটে হবার সম্ভবনাই সবচেয়ে বেশি৷ শার্লট মুনিয়াদের এখান থেকে অনেকটা কাছে৷ ফ্লাইটে দু'ঘন্টার পথ৷ ওখানেও যদি হয় তাও বাঁচোয়া৷ ওর অনেক টাকা বেঁচে যাবে৷ ৯ তারিখে ওকে ক্যানসাস সিটিতে যেতেই হবে৷ কারণ, ওখানকার ফ্ল্যাট, গাড়ি, অফিসের ঝামেলা মেটাতে হবে৷তারপর ওর ঘরের জিনিসপত্রগুলোর ব্যবস্থা করতে হবে৷ সম্ভব হলে নতুন জায়গায় নিয়ে যেতে হবে৷ তিন-চার দিনের মধ্যে এসব ঝামেলা চুকিয়ে নতুন করে টিকিট কাটতে হবে নতুন জায়গার৷ আমরা সম্ভবত ওর সঙ্গে যেতে পারবো না৷ ওর নতুন জায়গায় যাবার জন্য আমাদের টিকিট বদলে Reschedule করতে হবে৷ তাহলে কিছু টাকা বাঁচবে৷ নইলে পুরো টাকাটাই বরবাদ হবে৷ আমাদের টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ নিতান্ত কম নয়, প্রায় ষাট-সত্তর হাজার তো হবেই৷ যাইহোক, এখন অপেক্ষা করা ছাড়া অন্য উপায় নেই৷
এতো ঝামেলা আর অনিশ্চয়তার মধ্যেও বাবাই ধীর-স্থির আছে৷ এরই মধ্যে সবাই মিলে আজ Down Town-এ ঘুরতে যাওয়া হল৷ বাবাই তো পাগলের মতো শতাধিক ফটো তুলে গেল একের পর এক৷ যা পারলো, চোখের সামনে যা দেখলো সবই ওর ভালো লেগেছে৷ এটা ঠিক মরুদেশের ক্যানসাস সিটির থেকে হার্টফোর্ড অনেক অনেক সুন্দর৷ রাত্রে বাড়িতে খাওয়ার পাট ছিল না৷ Burger King এবং Pizza Hut থেকে বার্গার আর পিজ্জা এবং সঙ্গে যথেচ্ছা কোল্ড ড্রিঙ্ক খাওয়া হল৷ রাত্রে ঘরে ফিরে আজকের তোলা সব ফটোগুলো কম্পিউটারে দেখা হল৷ তারপর 'বাক্স বদল' ছবিটা দেখে যখন শুতে যাওয়া হল তখন ঘড়ির কাঁটা দু'তারিখে আর দাঁড়িয়ে নেই৷ রাত্রি দেড়টা৷ পরদিন, অর্থাৎ তিন তারিখে আবার New York tour. তারজন্য আজ রাত্রেই এখান থেকে রওনা হতে হবে৷ অন্য বারের মতো রাত বারোটায় হার্টফোর্ড ডাউনটাউন থেকে রাত্রি বারোটায় গ্রে হাউণ্ড বাসে নিউইয়র্ক যেতে হবে। পরদিন সকাল আটটা থেকে Tour Party-র বাসের নিউইয়র্ক ভ্রমণ শুরু হবে।
আজও তাড়াতাড়ি খেয়ে তিন জন্য প্রস্তুত হলাম বেরোবার জন্য। রাত্রি সোয়া এগারোটায় Yellow Taxi বলা ছিল। সে যথাসময়ে দরজায় পৌঁছে গেল। বারোটা পাঁচের দিকে বাস ছাড়ল। বাসটা আসছে বস্টন থেকে। নিউইয়র্কের আগে এটাই শেষ থামা। এই বাসকে এক্সপ্রেস বলা হয়। আমাদের দেশেও আছে। তবে এখানকার রাস্তা এতটাই ভালো এবং হাইওয়েতে কোনো সিগন্যাল বা ক্রসিং না থাকায় একটানা পঁয়ষট্টি মাইল গতিতে চলতে পারে। যদিও হার্টফোর্ড থেকে নিউইয়র্কের দূরত্ব একশো দশ মাইল তবু ওই রাস্তার জন্য সময় বরাদ্দ দু ঘণ্টা তিরিশ মিনিট। তবে যেহেতু বাসটা এক্সপ্রেস এবং আর কোনও থামার জায়গা নেই তাই দশ মিনিট আগেই পৌঁছে গেল নিউইয়র্ক। আমলারা চাইছিলাম রাস্তায় ট্রাফিক জ্যামিতিক হোক বা অন্য যে কোনও কারণেই হোক না কেন আরও দেরি হোক পৌঁছাতে। তাহলে গ্রে হাউণ্ড বাস টার্মিনাসের কমিটির সময় অপেক্ষা করতে হবে। ওখানে ঘণ্টা চারেক বসে কাটানোই এক বিষম কষ্টকর অভিজ্ঞতা। যায় এর আগে অ্যাকাডিয়া ট্যুরে হয়েছে। যাইহোক, আমলারা চার ঘণ্টা বসার প্রস্তুতি নিয়ে অন্য বারের মতো দোতলায় উঠে সবাই বেশ গুছিয়ে বসলাম। কিন্তু হঠাৎ ঘণ্টা খানেক পরে অন্যান্যদের সঙ্গে আমাদেরও নীচে নামিয়ে দিল। কারণটা তখন বুঝিনি। বুঝতে পারলাম ভোর ছটার দিকে টাইম স্কোয়ারে পৌঁছে। যে টাইম স্কোয়ারে সারা রাত মানুষ গিজ গিজার করে, হৈ চৈ, আনন্দ -ফুর্তি করে, সেখানটা আজ শুনশান। এখানকার জাতীয় ফুটবল উপলক্ষে টাইম স্কোয়ার এলাকাটা চকচকে ঝকঝকে করা হয়েছে। নানান ট্যাবলো, স্টল, ব্যানার ইত্যাদিতে জায়গাটা ছেয়ে আছে। অন্যবারের মতো এবার সেখানেও বসার জায়গা পেলাম না। বলা ভালো কাউকে ওই জায়গায় বসতেই দিচ্ছে না পুলিশ। ফলে আরো ঘণ্টাখানেক এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করে সাতটার দিকে আমরা কাছেই Metro Station-এ পৌঁছালাম বোয়ারি যাবার জন্য। যেখানে থেকে শুরু হবে ট্যুর।
আটটার একটু পরে আমাদের যাত্রা শুরু হল। প্রথমেই নিয়ে গেল নিউইয়র্ক 'বুল' বা ওয়ালস্ট্রিট 'বুল' দেখাতে। পিতলের বিশালাকার ষাঁড়টা সিং বাগিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যাকে সারা পৃথিবীর স্টকমার্কেট বা শেয়ার মার্কেট দেবতার জ্ঞানে মান্য করে। 'বুল'ছুঁয়ে সবাই ফটো তুললাম। পরের গন্তব্য 'স্টেট এম্পায়ার বিল্ডিং'। যে মহা প্রাসাদটি 1934 সাল অবধি পৃথিবীর উচ্চতম বাড়ির মর্যাদা পেয়ে এসেছে। পরবর্তীকালে এর চেয়ে অনেক বেশি উঁচু বাড়ি পৃথিবীর নানান দেশে নির্মিত হয়েছে বটেই তবে এর ঐতিহ্যই আলাদা। একশো দু'তলা এই প্রাসাদটি আমেরিকার অন্যতম শ্রেষ্ঠ গর্ব। তবে কর্তৃপক্ষ জনসাধারণকে ছিয়াশি তলা পর্যন্ত উঠতে দেয়। প্রাসাদটি প্রহরা নিশ্ছিদ্র।মনে হয়েছে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের যুগ্ম বাড়ি ধ্বংস হওয়ার পর প্রহরার কড়াকড়ি এতো প্রবল। এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিংয়ের ছিয়াশি তলায় উঠলে মালুম হয় নিউইয়র্ক শহরটাকে কেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ High rise City বলা হয়। পুব দিকটা ছাড়া অন্য তিন দিকে পঞ্চাশ তলার অধিক উচ্চতার বাড়ি মনে হয় শতাধিক দৃষ্টিগোচর হয়। কে কাকে ছাড়িয়ে আকাশ ছোঁবে তারই যেন প্রতিযোগিতা। ওখান থেকেই দেখা গেল গ্রাউন্ড জিরোতে নবনির্মিত বাড়ি দু'টি। 2013 সালের মধ্যে সম্পূর্ণ হওয়ার কথা। ইতিমধ্যেই একটির প্রায় একশো এবং অন্যটির আশি তলা পর্যন্ত উঠে গেছে। তবে সম্পূর্ণ ব্যবহারযোগ্য হয়েছে প্রথমটির ছাপ্পান্ন এবং দ্বিতীয়টির চল্লিশ তলার কাছাকাছি। মার্কিনরা তাদের বিপুল ক্ষতি সামলে আবার সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিউইয়র্ক নগরীর আয়তন 470 স্কোয়ার মাইল। তবে এর বিশালতা সবটা ধরা পড়ে না ওই ছিয়াশি তলার উপর থেকেও। আয়তন এবং বহুতলের সংখ্যায় আমাদের মুম্বই নিউইয়র্কের কাছাকাছি পৌঁছানোর স্পর্ধা রাখে কিছুটা। কিন্তু আমাদের সাধের কলকাতাকে নিতান্তই ছোট মনে হয় উভয় বিচারেই।(মুম্বই 234 স্কোয়ার মাইল আর কলকাতা মাত্র 71 স্কোয়ার মাইল।)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন