ধারাবাহিক ভ্রমণকথা(পর্ব—১৬)
পৃথিবীর উল্টো পিঠ
বিশ্বেশ্বর রায়
জীবন সম্পর্কে বাবাইয়ের এক সুস্থ, স্বচ্ছ এবং সরল দর্শন আছে যা আগে জানতাম না৷ ওর ওইটুকু জীবনে যে উপলব্ধি তা অবাক করে৷ ওর কথা হলো—জীবনে অনেক ভুল বোঝাবুঝি, ঝগড়াঝাঁটি, মনান্তর, মতান্তর ইত্যাদি প্রায়শই ঘটে৷ সেগুলিকে ভুলতে শেখাটাই বড় কথা৷ পুরানো কথা, বিবাদ-বিসম্বাদ, তিক্ততা যত ভোলা যায় ততই মঙ্গল৷ ততই জীবন সহজ হবে, আনন্দ বয়ে আনবে জীবনে৷ কী হবে তুচ্ছাতিতুচ্ছ ব্যাপারগুলো নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণে! ও একটা সাম্প্রতিক ঘটনার উল্লেখ করলো৷ চার-পাঁচ দিন আগে ওর অফিসের ক্লায়েন্ট সাইডের একজন, নাম জর্জ, তার সঙ্গে ওর অফিসের কাজকর্ম সংক্রান্ত ছোটখাট একটা ঝামেলা হয়েছিল৷ ওর কিছু কাজের কথা জর্জ ওকে mail করে না জানিয়ে ওর P. M-এর.(Project Manager) সাথে কথা বলেছিল৷ যা বাবাইয়ের পছন্দ নয়৷ যার কাজ সে-ই P. M.এর সঙ্গে কথা বলবে—এটাই ওর বক্তব্য৷ জর্জকে তাই ও সরাসরি বলে দিয়েছিল ওর কাজ নিয়ে জর্জ যেন বেশি মাথা না ঘামায়৷ যার যার কাজ সে নিজেই বুঝে নেবে৷ তারপর গতকাল জর্জের সঙ্গে আবার দেখা হতে ও বললো যে, আগের দিনের ওই সমস্ত কথা ভুলে যাওয়াই ভালো৷ এখানে কে বা কতদিন আছে? হয়তো এক বছর বা দু'বছর কিংবা তারও কম৷ যতদিন ঐই Project-টা চলবে৷ তারপর জর্জকে ওর গাড়িতে তুলে নিয়ে কোনো রেস্টোরেন্টে গিয়ে একটু খাওয়া-দাওয়া করেছিল৷ আসলে রাগ-অভিমান মনে পুষে রেখে গুম হয়ে থাকার চেয়ে খোলাখুলি কথা বলে নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ৷ তাহলে আর ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ থাকে না৷ কিন্তু এই সহজ সত্যটা মানুষ বুঝতে চায় না সহজে৷ আত্মাভিমান বা ইগো প্রবলেমই এর প্রধান অন্তরায়৷ যা কম বয়সে উপলব্ধি করা এবং আত্মস্থ করা খুই কষ্টসাধ্য ব্যাপার৷ এখন আমরা এই বয়সে এসে হয়তো উপলব্ধি করতে পারি সহজে যে, অনেককিছু ভুলতে হবে, ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে সবকিছুকে দেখতে হবে, উপলব্ধি করতে হবে৷
ঘটনা টা উল্লেখ করলাম এই কারণে যে, ওদেশে ক্লায়েন্ট মানে যে বা যারা কোনো Project run করায়৷ সেই প্রজেক্টে নিয়োজিত সব কর্মীদের মাইনা তারাই দেয়,অর্থাৎ মালিক৷
প্রজেক্ট ম্যানেজার থেকে অন্যান্য কর্মীরা সবাই সেই ক্লায়েন্টের অধীনস্থ হলেও সম্পর্কটা নিতান্তই বন্ধুর মতো৷ প্রভু-ভৃত্যের মতো নয়৷ তাই সবাই সবাইকে নাম ধরে তুমি সম্বোধনে কথা বলে৷ কোনো Bossing নেই আমাদের দেশের মতো৷
আজ মুনিয়াদের ১৭-১৯ অ্যাপার্টমেন্টের তৃতীয় তলের একটি ফ্ল্যাটে সম্ভবত গ্যাস লিক করেছিলো৷ এখানে সবই গ্যাস-লাইনের পদ্ধতি৷ প্রতিটি ফ্ল্যাটে যে গ্যাস ওভেন আছে তাতে চারটে করে বার্নার৷ এছাড়া নীচে একটা গ্রীল করার জায়গা থাকে৷গ্যাস ওভেনে সর্বদাই আগুন জ্বলে থাকে৷ ফলে কোনো গ্যাস লাইটারের প্রয়োজন হয় না৷ গ্যাস ওভেনের নবটা খুললেই গ্যাস জ্বলে ওঠে৷ বন্ধ করলে বার্নারের আগুন নিভে যায় কিন্তু নীচে আগুন জ্বলতেই থাকে৷ যাইহোক, তৃতীয় তলে ২০৬ নম্বর ফ্ল্যাটে সম্ভবত একটা গ্যাস বার্নার ঠিকমতো নেভানো হয়নি৷ ফলে গ্যাস লিক করেছিল৷ পাশের ফ্ল্যাটের একটি মেয়ে গ্যাসের গন্ধ পেয়ে ফায়ারব্রিগেডে ফোন করে৷ সঙ্গে সঙ্গে দু'তিনটি ফায়ারব্রিগেডের গাড়ি সঙ্গে পুলিশের গাড়ি ও অ্যাম্বুলেন্স বিকট আওয়াজ করতে করতে এসে হাজির৷ ফায়ারপ্রুফ জ্যাকেট পরে নানারকম সরঞ্জাম নিয়ে তারা দুড়দাড় করে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেল৷ কিন্তু দরজা বন্ধ৷ যাদের ফ্ল্যাট তারা কেউ নেই৷ অফিস থেকে ফেরে নি৷ তখন ৬টা বাজে৷ যে মেয়েটি ফোন করেছিল তার সঙ্গে কথা বললো ফায়ারব্রিগেডের লোকজন৷ বাইরে থেকে মই বেয়ে ঘরে ঢোকার চেষ্টা করলো৷ কিন্তু জানালা বন্ধ৷ ইতিমধ্যে ওই মেয়েটি ফ্ল্যাটের মালিককে ফোন করে ডাকার পর তারা এসে গেল৷ তখন ঘরে ঢুকে সবকিছু খতিয়ে দেখে কোনো গ্যাস লিক হবার হদিশ খুঁজে পেলো না৷ হয়তো কোনো ভাবে গ্যাসের গন্ধ পেয়েছিল মেয়েটি৷ ফলে ফায়ারব্রিগেড, পুলিশ এবং অ্যাম্বুলেন্স ঘন্টাখানেক পরে ফিরে গেল নিশ্চিন্ত হয়ে৷ এখানে ফায়ারব্রিগেড, পুলিশ এবং অ্যাম্বুলেন্স সদা তৎপর৷ গাড়ির দুর্ঘটনা হোক বা আগুন লাগা সর্বক্ষেত্রেই তিনটি সংস্থার লোকজন একযোগে অকুস্থলে পৌঁছে যায় ফোন পাওয়ামাত্র৷ এ ব্যাপারে এরা আমাদের দেশের থেকে অনেকটাই বেশি তৎপর এবং দায়িত্বশীলও বটে৷
এখানকার পুলিশ কোনো তদন্তে এলে বা কোনো গাড়ি ট্র্যাফিক আইন ভাঙলে পুলিশ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে খুব ভদ্রভাবে জিজ্ঞেস করে—"স্যার, আপনার কি খুব তাড়া আছে? এতো জোরে কেন গাড়ি চালাচ্ছেন বা সিগন্যাল মিস করলেন কেন?" তার উত্তরে পুলিশ যদি দেখে যে, সত্যিই সেই ব্যক্তির তাড়া আছে বা তিনি বেশ নার্ভাস তখন পুলিশই তাঁর গাড়ি চালিয়ে গন্তব্যে পৌঁছে দেয়৷ অবশ্য আইন ভাঙার অপরাধে তাঁকে যথাযথ ফাইন বা অন্যবিধ শাস্তি যা প্রযুক্ত তা পেতে হবে৷ আমাদের দেশের মতো প্রথমেই গাড়ির বনেটে এক রুলের বাড়ি মেরে বলে না—"এই গাড়ি সাইড কর্৷ লাইসেন্স দেখা" ইত্যাদি৷
পুলিশ-প্রশাসন এখানে এতটাই সক্রিয় এবং বিশ্বস্ত যে, মানুষ নির্দ্বিধায় তাদের কাছে যেতে পারেন নানা প্রয়োজনে৷ আমাদের দেশের কলকাতার মতো এখানে ১৯৯ নম্বরে ফোন করলেই পুলিশের সঙ্গে সঙ্গে ফায়ার ব্রিগেড এবং অ্যাম্বুলেন্স যিনি বিপদগ্রস্ত হয়ে ফোন করেছেন তাঁর বাড়ির দরজায় হাজির হয়ে যাবে৷ ১০০ ডায়াল করলে যেমন শুধু রিং-এর শব্দই কানে বাজে, কেউ ফোন ধরার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে না, এখানে তা ঘটে না৷ কেউ ফোন করলে পুলিশ তা ধরবে না এমন ঘটনা এখানে ঘটে না৷ তারপর আমাদের দেশে G. D. না করা পর্যন্ত পুলিশ কোনো action নেয়৷ এখানে ফোন কলই যথেষ্ট৷
আরও পড়ুন 👇🏾👇🏾
https://wwwankurisha.blogspot.com/2021/06/ankurisha-emagazine-bengali-poem-in_47.html
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন