লেবেল

বৃহস্পতিবার, ২ জানুয়ারী, ২০২৫

।। প্রতিদিন বিভাগ।। ।। জানুয়ারি সংখ্যা।। ।। দীর্ঘ কবিতা (উন্মুক্ত) -৩।। ব্যাড টাচ গুড টাচ — বিশ্বেশ্বর রায়।।Ankurisha।। E.Magazine।। Bengali poem in literature।।

 


    

       ।।  প্রতিদিন বিভাগ।। 

        ।।  জানুয়ারি সংখ্যা।। 

       ।।  দীর্ঘ কবিতা (উন্মুক্ত) -৩।।


        




ব্যাড টাচ গুড টাচ
    বিশ্বেশ্বর রায়



আমি তখন দ্বিতীয় শ্রেণী, তুই ছিলি সপ্তমে,
ছোড়দা, তোর কি মনে আছে সেই দিনটার কথা--
পাশের গ্রামে চড়ক মেলায় গিয়েছিলাম বিকেল বেলা,
তোর সাথে সেই প্রথম পথে হাঁটা।
কতই বা আর পথ, আধ মাইলও হবে না বোধ হয়।
মা বলেছিল--ফিরে আসিস সন্ধে নামার আগে।
একটা টাকাও দিয়েছিল নাগরদোলা চ্ড়া
আর হাওয়াই মিঠাই খেতে।
তুই নিবি না, মা-ও নাছোড়,
জোর করে গুঁজে দিয়েছিল কয়েনটা তোর অনিচ্ছুক মুঠোয়।
পাড়ায় তোর সুনাম ছিল ভাল ছেলে বলে।
আমার ছিল না কোন দাদা,
কেন জানি না আমি তোকে ডাকতাম ছোড়দা বলে।
একজন দিদি ছিল তোর বয়সি, ভাইটা মোটে তিন।
ওরা কেউ যায়নি সাথে, শুধু তুই আর আমি।
দিদির শরীর খারাপ ছিল, ভাই তো বড্ড ছোট।
কাঁটা ঝাঁপ দেখার পরে খাওয়া হল হাওয়াই মিঠাই,
নাগরদোলা চড়তে চড়তে ঠাণ্ডা বরফ চোষা,
অনেক পরে জেনেছিলাম ললিপপ নাম তার।
ফেরার পথেই সন্ধে নেমেছিল।
গ্রাম্য মাটির ছায়া নিবিড় পথ,
হোঁচট খেয়ে গেলাম পড়ে আমি।
যদিও তুই পাশে ছিলি, তুই তোলবার আগে
অন্য দুটো বয়স্ক হাত দাঁড় করাল আমায় তুলে।
দেখি সে জন বাদলকাকা, আমাদেরই পাড়ার।
আদর করে বলল আমায়--কোলে এসো,
অন্ধকারে আবার যাবে পড়ে।
মনে আছে ছোড়দা, ডান হাতে তুই আমার বাঁ হাত ধরে
বলেছিলি--না থাক বাদলকাকা,
আমি ধরে আছি মলির হাত, পড়বে না ও আর।
বাদলকাকা শোনেনি তবু, আমাকে কোলে তুলে
সারা পথে অনেক আদর করেছিল হাত বুলিয়ে গায়ে।
তখন তো জানতাম না ব্যাড টাচ আর গুড টাচ কাকে বলে।
পরে বুঝেছি ওটা ছিল ব্যাড টাচ।
মা একটু বকেছিল সন্ধের আগে ফিরিনি বলে।
আর বাদলকাকাকে বলেছিল-- ভাগ্যে তুমি ছিলে বাদল।
#
এরও বছর পাঁচেক পরে
আমি 'টিন'-এ পা দিয়েছি সবে,
শরীর-মনে চলছে তখন অনেক ভাঙা-গড়া,
তুই তখন প্রথম বর্ষে, 'টিন'-এর শেষ সীমায়,
সেবারও সেই সর্বনেশে চৈত্র মাসের বিকেল,
ডাক দিলি তুই এসে--যাবি নাকি এবার গাজন মেলায়?
আমি তখনই বাড়ির পোশাক ছেড়ে
ভাল একটা ফ্রক নিয়েছি পরে। চল্।
মা বলল--অনীশ, মলির আজ শরীর ভালো নেই,
ও আজ আর যাবে না মেলায়।
জেদ ধরলাম যাবোই আমি, শরীর আমার ভালোই।
তুইও বলেছিলি--না থাক, অসুস্থ শরীরে না যাওয়াই ভালো।
এখন আমি বুঝি মা কেন সেবার
আমার মত দিদির শরীর খারাপের অজুহাত দিয়েছিল।
আমার জেদ দেখে মা শেষে দিয়েছিল অনুমতি।
তবে সঙ্গে যাবে ভাই, আট বছরের ঋভু।
তোকে নিয়ে মায়ের কোনো আশঙ্কা নেই আর।
তাছাড়া তুই যে ভালো ছেলে গ্রামের সবাই জানে।
গাজন মেলায় ঘুরতে ঘুরতে দেখা হল বাদলকাকার সাথে।
বাদলকাকা পাছ ছাড়ে না, গল্প জোড়ে,
হাবিজাবি নানা কথা। না বললেও
কিনে আনে বেগুনি আর খাস্তা গজা,
ভাইয়ের জন্য হাওয়াই মিঠাই আর ললিপপ।
এবার আরও দেরি হল। ফিরতে হবে।
বাদলকাকা সঙ্গ নিল। চলো, আমিও ফিরবো।
পথের মধ্যে আধো অন্ধকারে কাঁধে হাত, একটু চাপ।
ব্যাড টাচ।  বুঝতে পারি কার হাত।
আমার আর তোর মাঝে ঋভু,
দুজনে দুদিক থেকে ধরে আছি তার দুহাত।
পিছনে বাদলকাকা, মধ্য তিরিশের, বিবাহিত।
এবার গাজনমেলা বেশ জমেছিল, কী বলো!
অনেক বেশি দোকানপাট, নাগরদোলা---
সব মিলে একটা বিকেল আনন্দে কাটলো বেশ।
কথা বলতে বলতে আনন্দের আতিশয্যেই বুঝি কাঁধে হাত--
অন্য ধরণের আনন্দ খুঁজছে মনে হয়।
হঠাৎ খপ্ করে আমার খালি বাঁ হাতটা ধরে হাল্কা টান।
আমি কিছু না বলে শুধু ঘাড় ঘোরাতেই হাত গেল সরে।
বাদলকাকাকে কিছু কড়া কথা বললে ভাই ফেলবে শুনে,
বাড়ি ফিরে মাকে যদি কিছু বলে এই ভয়ে খুলছি না মুখ।
কিন্তু বাদলকাকার অস্থির হাত ক্রিয়াশীল, রাস্তা আসছে ফুরিয়ে।
হাতটা সরান। ঘাড় ঘুরিয়ে রূঢ় স্বরে বলে উঠলাম।
ঘটনাটা বুঝতে এক মুহূর্তও বিলম্ব হয়নি তোর।
পিছন ফিরে প্রচণ্ড এক ঘুষিতে ভূশায়িত বাদলকাকা।
তুই তখন 'টিন'-এর শেষ সীমায়।
"আঠারো বছর বয়স কী দু:সহ
স্পর্ধায় নেয় মাথা তোলবার ঝুঁকি"
বাড়ি ফিরে একটা কথাও বলেনি ঋভু মাকে। আমিও না।
তুই তো আমাদের পৌঁছে দিয়েই গিয়েছিলি ফিরে।
বাদলকাকা কিল খেয়ে হজম করার লোক ছিল না।
পরদিনই এলো আমাদের বাড়ি, থুতনিতে ব্যান্ডেজ।
বাদল, কী হয়েছে তোমার! মুখে ব্যান্ডেজ কেন!
মায়ের উদ্বিগ্ন প্রশ্নে বাদলকাকা যা বলল মাকে
শুনে আমি থ হয়েই গেলাম।
বাদলকাকার বক্তব্যের সারমর্ম ছিল খুবই প্রাঞ্জল।
আমার সঙ্গে রাস্তায় তুই নাকি চেষ্টা করছিলি ফস্টিনস্টির,
ঋভু ছিল বাদলকাকার কোলে।
বাদলকাকা বাধা দিতে যায় তোর অসভ্যতা দেখে,
তাতেই ক্ষিপ্ত হয়ে বাদলকাকাকে তুই মেরেছিস যথেচ্ছ।
ঋভুকে মা জিজ্ঞেস করল শুধু--
হ্যাঁরে ঋভু, অনীশদাদা এই কাকুকে মেরেছিল কাল?
ঋভু হ্যাঁ জানিয়েছিল তার ঘাড় নেড়ে।
ওইদিন থেকে চিরতরে বন্ধ হল তোর যাতায়াত আমাদের বাড়িতে।
সত্যি কথাটা বলার জন্য আসিসনি তুই আমাদের বাড়ি।
আর আমার একটা কথাও শুনতে চায়নি মা,
শুনলেও বিশ্বাস করেনি।
#
সেই থেকে কেটে গেছে সাতচল্লিশ বছর।
নিভাননী গার্লস স্কুলের অ্যাসিস্ট্যান্ট টিচার থেকে
হেডমিস্ট্রেস হয়ে গত মাসেই মিলেছে অবসর।
সেই কবে থেকে আমিও গ্রামছাড়া,
কলকাতার এই শহরতলি নি:সঙ্গ জীবনের ঠিকানা।
ক্লাসে কতবার মেয়েদের বুঝিয়েছে ব্যাড টাচ আর
গুড টাচের তফাৎ আইবুড়ি এই মলি মজুমদার।
তোর সাথে আর হবে না দেখা এ জন্মে বোধহয়,
গ্রাম ছেড়ে তুই চলে গেলি শহরে হস্টেলে,
গ্রামে বড় আসতিস না, এলেও ঘরবন্দি।
খবর পেতাম বন্ধুদের এ ওর মুখে,
দেখা করার হয়নি সাহস, যদিও আমি নারীবাদী প্রতিবাদী।
ভুলতে চেয়েছিলাম একটা ভীরুকে।
ভাবতাম কী করে সে অমন একটা পাঞ্চ
বসাতে পেরেছিল একটা লম্পটের চোয়ালে!
শুনেছিলাম সেই ভীরুটা পালিয়ে গেছে আমেরিকায়,
এখন সে এক মস্ত বড় সায়েন্টিস্ট, বিশ্বজোড়া নাম---
ভুলতে চেয়েও পারিনি তাকে ভুলতে,
ওই নামটাই চলেছি জপ করে আজও।
তার কিশোর হাতের ছোঁয়ায় ব্যাড টাচ ছিল না কোনো।
এখনও নির্দ্বিধায় রাখতে পারি হাত তার হাতে।
#
আমার কথাটা এখানে শেষ হলেই গল্পও হত শেষ,
তা আর হল কই!
হঠাৎ সেদিন সংবাদপত্রে দেখলাম তার নাম---
বিশ্ববন্দিত বিজ্ঞানী অনীশ সরকার এসেছেন কলকাতায়
আন্তর্জাতিক এক বিজ্ঞান সম্মেলনে ভাষণ দেবার আমন্ত্রণে।
অডিটোরিয়াম বিশিষ্ট গুণীজনে পরিপূর্ণ।
বহু ক্লেশে সেখানে পেলাম প্রবেশাধিকার।
মাইকে ঘোষণা হল শীঘ্র তিনি পৌছবেন এসে।
এলেন তিনি, সৌম্য দীপ্তকান্তি পুরুষ,
চালচলনে নেই কোনো দাম্ভিকতা কিংবা দৃপ্ত ভঙ্গিমা।
বরং যেন সেই কবেকার ভীরু আত্মগোপনের নিষ্ক্রিয়তা।
মঞ্চে দাঁড়িয়ে সে কিয়ৎক্ষণ শ্রোতাদের দিকে দৃষ্টিক্ষেপ করে
উপবিষ্ট হল তার জন্য নির্দিষ্ট আসনে।
বক্তব্য রাখতে উঠে আবার শ্রোতৃবৃন্দের প্রতি অবলোকন।
সে কি খুঁজছে কাউকে! আমার ষাটোর্ধ্ব বুকেও স্পন্দন।
হঠাৎই দেখি সে পড়ে যাচ্ছে টলে,
কয়েকজন ত্রস্তে এসে পতনের আগেই ফেলল তাকে ধরে।
সংগাহীন শরীরটাকে শুইয়ে দিল মঞ্চের উপরেই।
আমি কালক্ষেপ না করে ছুটে গিয়ে উঠতে চাইলাম মঞ্চে।
কণ্ঠ ভেদ করে অজান্তে বেরিয়ে এল--ছোড়দা!
সিকিওরিটিরা আটকালো আমাকে।
হঠাৎ শুনি সুপ্তোত্থিত কণ্ঠে সে বলছে--ওঁকে আসতে দিন।
কাছে গিয়ে হাঁটু মুড়ে তার পাশে বসতেই
একটা হাত এগিয়ে এসে স্থিত হল আমার হাতে---
সে ছোঁয়ায় এখনও কোনো ব্যাড টাচ নেই।
                             -- --






 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন