রবিবাসরীয় বিভাগ
আজকের গল্প
কুলপিদিম
অজিত বাইরী
আমাদের বংশে আদ্যিকালের একটা সিন্দুক ছিল। উত্তরাধিকার সূত্রে সেটা আমাদের পরিবারের হাতে আসে। ঠাকুমাই সেটার তত্ত্বাবধানে ছিলেন। একসময় ঠাকুমা সিন্দুকটা আমাদের সামনেই খোলা-পরা করতেন। সংসারের বাতিল সামগ্রী সেখানে সংরক্ষণ করতেন। কারো কোন কাজে লাগবে না জেনেও, করতেন।
কিন্তু একটা বয়েসে পৌঁছে নিজের হেফাজতেই রাখতেন। কারো সামনে সহসা খুলতেন না। তাতে আমাদের কৌতূহল বেড়ে যেত। ঠাকুমা সিন্দুক রাখার ঘরে ঢুকলেই আমরা উঁকিঝুঁকি দিতাম। আমাদের কাউকে দেখলেই ঠাকুমা ডালা বন্ধ করে দিতেন। এরকমই চলছিল।একসময় আমরা ঠাকুমার সিন্দুকে কী আছে জানার আগ্রহ হারিয়ে ফেললাম। ঠাকুমা নিজের মতো সিন্দুকের ডালা খুলতেন,বন্ধ করতেন। কী রাখতেন, কী বের করতেন আমরা কেউ খোঁজ রাখতাম না। বাবা কাকারাও এ নিয়ে মাথা ঘামাতেন না।
এভাবেই দিনের-পর-দিন, বছরের-পর-বছর কেটে যাচ্ছিল । একসময় সুর কাটলো সংসারে ।একান্নবর্তী পরিবারের হাঁড়ি আলাদা হল। এক উঠোন;অথচ পরিবারগুলো আলাদা। ঠাকুমা অনেক কান্নাকাটি করেছিলেন; কিন্তু বৃদ্ধার চোখের জলেও চিড়া ভিজলো না। উনুন হল পাঁচখানা। পাঁচখানা হাঁড়িতে ভাত ফুটতো।
হাঁড়ি ভাগ হল; কিন্তু মা কোন্ হাঁড়িতে ভাত খাবেন তা নিয়ে গোল বাধলো। প্রথমে স্থির হল, মা সবার কাছে ভাগাভাগি করে থাকবেন । বাবা ছাড়া অন্য ভাইরা সেই সিদ্ধান্তে শিলমোহর দিলেন। বাবা বললেন,মার একার ভার আমিই নিতে পারবো। মা'র এ-ঘর ও-ঘর করার দরকার নেই। তবে যখন যার কাছে থাকার ইচ্ছে হবে, মা থাকতে পারেন।
ঠাকুমা এই ভবিতব্যের কথা কখনো ভাবতে পারেননি। কিন্তু পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে মেনে নিলেন। ঠাকুমা বাবার কাছে রয়ে গেলেন। এক জীবন ছিল, শুরু হল আরেক জীবন। সে জীবনেও ক্রমে ক্রমে অভ্যস্ত হয়ে গেলেন। অবশ্য কখনও কখনও আক্ষেপ করতে ভুলতেন না, সংসারটা ভেঙে টুকরো টুকরো হবে কল্পনাও করেননি।
গতানুগতিক দিনগুলো আরেক ছাঁদে বাঁধা হয়ে গেল। ঠাকুমা আমাদের নিজস্ব, এরকম একটা ভাবনা আমাদের মাথায় ঢুকে গেল।
ঠাকুমার কাছে অন্য ভাইদের তুলনায় বেশি বেশি প্রশ্রয় পেতে থাকলাম। সন্ধ্যায় পড়াশোনা শেষে ঠাকুমা আদর করে কাছে ডেকে নিতেন। ঘুমোবার আগে নানা রকম গল্প শোনাতেন। রাজপুত্র-রাজকন্যা, ভূত-প্রেত, ডাকাত আরও নানা ধরণের গল্প। গল্প শুনতে শুনতে আমাদের ঝচোখে ঘুম নামতো।
কয়েক বছরের মধ্যে আরও অথর্ব হয়ে পড়লেন ঠাকুমা । শরীরটা ঝুঁকে পড়লো সামনের দিকে। চোখের জ্যোতি একেবারেই কমে এল। তারপর রোগগ্রস্ত শরীরে স্থায়ীভাবে বিছানা নিলেন। ঠাকুমা একদিন কাছে ডেকে ফিসফিস স্বরে সিন্দুকের চাবিটা হাতে দিলেন। হাত পেতে নিতে হাত কাঁপছিল। ঠাকুমা কী আমাদের তাড়াতাড়ি ছেড়ে যাচ্ছেন!
বাবা একদিন সব ভাইকে ডেকে সবার সামনে সিন্দুকটা খুললেন। ডালা খোলার পর সবাই আশ্চর্য হয়ে দেখলেন, একটা কালো রঙের পিতলের পিদিম ছাড়া আর কিচ্ছু নেই। ঐ পিদিমটা ঠাকুমা পেয়েছিলেন তাঁর শাশুড়িমাতার কাছে থেকে। নিজে ব্যবহার করার পর মার হাতে দিয়েছিলেন। মা কিছুদিন পিদিম জ্বলে তুলসীমঞ্চে প্রণাম করতেন। কালক্রমে সেই পিদিমের প্রয়োজন সকলের কাছেই ফুরিয়ে গেল। ঠাকুমা বলতেন, কুলপিদিম। এ পিদিম জ্বাললে সংসারের মঙ্গল হয় । কিন্তু আর পাঁচটা অব্যবহার্য জিনিসের মতো পিদিমটাও গুরুত্ব হারালো। তখনই ঠাকুমা ওটা সিন্দুকে ভরে রেখেছিলেন সবার চোখের আড়ালে। যাবার আগে প্রিয় উত্তরসূরির হাতে প্রত্যর্পণ করে গেলেন। তাঁর আর্ত হৃদয় শেষ বারের জন্য বংশের মঙ্গল কামনায় পিদিমটাকেই আঁকড়ে ধরেছিলেন।
কুলপিদিম একটি সার্থক অণুগল্প। জীবনের শেষ
উত্তরমুছুনলগ্নে এসে সংসারের বিভাজন দেখতে হলো যা
তাঁর নিকট খুব কষ্টকর এবং অনভিপ্রেত। মানুষের যত দিন এগিয়ে আসে অন্য লোকে যাওয়ার জন্য
ততই তাঁরা কোনো একটা জিনিষকে আঁকড়ে ধরেন
জীবনকে ভালবেসে। একটা মোহ থেকেই যায়
জীবনের প্রতি। খুব ভালো লাগলো।
ভালো লাগলো।
উত্তরমুছুন