ধারাবাহিক উপন্যাস (পর্ব-৮)
ছায়া - ছায়া অন্ধকারের আড়ালে
অনন্যা দাশ
ডাঃ মিত্রর সঙ্গে এর পরের সেশানটা আমার খুব একটা ভালো হল না। মানে অনেক কিছুই বলতে না চেয়েও বলে ফেললাম। পলাশের ব্যবহারের কথাটা ভেবেছিলাম বলব না। যারা চলে গেছে তাদের সম্পর্কে খারাপ কথা না বললেই ভালো তাই আমি পলাশের কথা বলতে চাইনি কিন্তু ডাঃ মিত্র এমন সহানুভূতি দেখালেন যে আমি আর নিজেকে সামলাতে পারলাম না। পলাশের কথা, রজতের কথা সব বলে ফেললাম। উনি আমার কথাগুলোকে রেকর্ড করে ফেললেন।
আমি বলে তো দিলাম সব তারপর কিন্তু মনটা খুঁত খুঁত করতে লাগল, মনে মনে ভাবলাম কেন যে অত কথা বলতে গেলাম! ডঃ মিত্রর এই পেশেন্ট দেখার ঘরে বেশ কয়েকটা বড়ো বড়ো আলমারি আছে। সেগুলোকে দেখে আমার মনে হতে লাগল, আচ্ছা উনি এই সব রুগীদের কথা রেকর্ড করে কোথায় রাখেন? তারপর মনে হল এখন তো আর কাগজের ফাইলে কেউ কিছু রাখে না, উনি হয়তো কোন একটা কম্পিউটারে বা হার্ড ড্রাইভে সব কিছু সেভ করে রাখেন।
আমার মনের কথা বুঝতে পেরে ডাঃ মিত্র বললেন, “ভয় পেও না! তুমি আমাকে যা বলছ সেই সব কথা আমি কোনদিন কাউকে বলতে পারব না। আমরা আমাদের রুগীদের কথা কাউকে বলি না, বলতে পারি না! এখানে খুব কড়া নিয়ম আছে ওই ব্যাপারে। তাই নিয়ে কত গল্প, কত সিনেমা হয়ে গেছে!”
আমি আর কিছু বললাম না। গুড নাইট টাইট বলে বাড়ির দিকে রওনা দিলাম।
বাড়ি ফিরে জামাকাপড় ছেড়েছি সবে অমনি দরজায় বেল! আমি ভাবলাম এখন আবার কে এল রে বাবা? ঐশী তো এত তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরবে না তাছাড়া ওর কাছে চাবি আছে ও তো বেল টিপবে না। দরজা খুলতে গিয়ে দেখি অপরিচিত একজন দাঁড়িয়ে রয়েছে।
আমি শিকল দিয়ে দরজাটা অল্প ফাঁক করে জিজ্ঞেস করলাম, “কে আপনি? কাকে চান?”
“রোহন কুমার। হোমিসাইড ব্রাঞ্চ,” বলে দরজার ফাঁক দিয়ে নিজের ব্যাজ আর আই ডি কার্ড এগিয়ে দিলেন। আই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব দেখলাম। বলা তো যায় না।
“কী ব্যাপার বলুন তো?”
“আমি পলাশ সেনগুপ্তর হিট অ্যান্ড রান কেসটা নিয়ে তদন্ত করছি। সেই ব্যাপারেই আপনার সঙ্গে একটু কথা ছিল...”
“ও! ঠিক আছে ভিতরে আসুন তাহলে।”
উনি ভিতরে ঢুকে চারিদিকে চোখ বুলিয়ে নিলেন।
“আপনি কী একাই থাকেন এখানে?”
“না, আমার একজন রুমমেট আছে। তা যা জিজ্ঞেস করার তাড়াতাড়ি করুন। আমি খুবই ক্লান্ত। ইট হ্যাজ বিন আ লং ডে!”
রোহন কুমারের নাম আর চেহারা ভারতীয় হলে কী হবে উনি মনে হয় এদেশেই মানুষ তাই তিনি কথাবার্তায় পুরোপুরিই আমেরিকান।
“আপনার সঙ্গে পলাশের কবে থেকে আলাপ?”
“ঠিক মনে নেই। বছর দুয়েক হবে। বছর দুয়েক আগেই তো সে এসেছিল এখানে, তাই না?”
“কেমন সম্পর্ক ছিল আপনাদের?”
“আমাকে অনেক সাহায্য করেছে। আমি একটা মন খারাপের সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলাম। আমার আগের বস মারা যেতে আমাকে নতুন একটা ল্যাবে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় যেখানে কাজের চাপ অস্বাভাবিক রকম বেশি। আমার রাতে ঘুম হচ্ছিল না ঠিক মতন, একটু ডিপ্রেশান গোছেরও হয়েছিল। সেটা লক্ষ করেই পলাশ আমাকে ডাঃ মিত্রর কথাটা বলে। ডাঃ মিত্রর সঙ্গে দেখা করার পর থেকে আমি ভালোই আছি। এছাড়া ও ভালো গান গাইত বলে এখানাকার স্থানীয় বাঙালিরা ওকে খুব পছন্দ করতেন। সব জায়গা থেকে নিমন্ত্রণ ওর আসত, আমাকেও ও অনেকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল!”
“ডাক্তার? মানে ডিপ্রেশানের ডাক্তার? তার মানে সাইকিয়াট্রিস্ট!”
“হ্যাঁ, তো? শরীরের রোগ হতে পারে আর মনের রোগ হতে পারে না বুঝি?
রোহন কুমার হাসলেন, “নিশ্চয়ই হতে পারে! যারা মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের কাছে যায় তাদের আমি অন্তত পাগল বলে মনে পরি না। মনের স্বাস্থ্য হল ভালো থাকার একটা বিশাল অঙ্গ! আমি শুধু জিজ্ঞেস করলাম ওই রকম একজন ডাক্তারকে পলাশ কী ভাবে চিনল সেই ভেবে! সেও কী ওনার কাছে গিয়েছিল?”
“না, ও আমাকে যা বলেছিল, ওর এক বন্ধুর স্ত্রীর মিসক্যারেজের পর খুব ডিপ্রেশান হয় এবং সে ডাঃ মিত্রর কাছে গিয়ে খুব ভালো ফল পায় সেখান থেকেই নামটা জেনেছিল। তাছাড়া মিত্র নামটা বাঙালি, মানে আমরা ভারতের যে জায়গা থেকে এসেছি সেই খানকার লোক তাই ওনার প্রতি একটা বাড়তি,...।“
“আপনি তো কলকাতা থেকে এসেছেন তাই না?”
“আপনি ইন্ডিয়া গেছেন কখনও?”
আবার হাসলেন রোহন কুমার, “হ্যাঁ, অনেকবার। তাজ মহল দেখেছি, আরও অনেক কিছু দেখেছি। আমার মা-বাবা প্রায় প্রতি গরমের ছুটিতেই আমাদের নিয়ে যেতেন বা পাঠিয়ে দিতেন। খুব মজা করতাম আমরা। ওনারা মুম্বাইতে থাকেন এখন!”
“বাহ!”
“যাই হোক এবার কাজের কথায় আসা যাক! ১৯শে মে সুনেত্রা আর প্রদীপ মজুমদারের বাড়িতে কী হয়েছিল?”
আমার মাথায় ঝনঝন করে একটা শব্দ হল যেন। এরা কী করে জানল? আর এরা কী আমাকে পলাশের মৃত্যুর জন্যে দোষী মনে করছে নাকি? তবে আমি মনে করি পুলিশ, উকিল আর সাইকিয়াট্রিস্টকে সত্যি কথাটা বলে দেওয়াই ভালো। শুধু শুধু কিছু লুকিয়ে তো লাভ নেই। কোন না কোন রকম ভাবে ওরা জানতেই পেরে যায় আর তখন মিথ্যে বলার জন্যে আরো অন্য বিপদে পড়তে হয়। তাছাড়া আমার লোকাবার তো কিছু নেই! আমি তো কিছু ভুল করিনি। যা বাজে কাজ তো পলাশই করেছিল।
“আপনি চা, কফি বা জলটল কিছু খাবেন? তার চেয়ে বেশি স্ট্রং আর বাড়িতে কিছু নেই!”
রোহন আবার হাসলেন, “না ডিউটিতে অ্যালকহল খাওয়া বারণ আমাদের। তবে জল খেতে পারি।”
আমি এক বোতল জল ওনাকে দিয়ে নিজে এক বোতল নিয়ে বসলাম। গলাটা কেমন জানি শুকিয়ে গেছে। আজকে ডাঃ মিত্রর ওখানেও প্রচুর কথা বলেছি।
“আমি সত্যি কথাই বলছি আপনাকে। পলাশদার সঙ্গে আমার যখন কথা হত তখন আমার মনে হত ওর আমাকে পছন্দ। আমারও ওকে মন্দ লাগত না। হ্যান্ডসাম, ভালো কথা বলতে পারে, সবার উপকার করে এই রকম ছেলেকে পছন্দ না করার কারণ ছিল না। আমি ভেবেছিলাম আমাদের মধ্যে একটা সম্পর্ক গড়ে উঠলেও উঠতে পারে। তবে সুনেত্রাদিদের বাড়িতে যখন ওর এনগেজমেন্টের কথটা ঘোষণা হল তখন আমি একটু শকই পেয়েছিলাম। বিবাহিত বা এনগেজেড লোকের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার আমার কোন ইচ্ছে ছিল না। তারপর নিচের বাথরুমে খুব ভিড় বলে আমি ওপরের একটা গেস্ট রুমের বাথরুমটা ব্যবহার করতে গেলাম, সুনেত্রাদিই বলেছিলেন। বাথরুম থেকে বেরিয়ে দেখি পলাশ দাঁড়িয়ে। সে আমাকে জড়িয়ে ধরে। হি ট্রাএড টু কিস মি অ্যান্ড টাচ মি! বলল যার সঙ্গে বিয়ে ঠিক হয়েছে তাকে ওর মা-বাবা পছন্দ করেছেন। আরও বলল “বউ বউয়ের জায়গায় আর ভালো লাগা ভালো লাগার জায়গায়!’ আমি হয়তো চিৎকার করে ওকে চড়টড় মারতাম কিন্তু ভাগ্যিস তখন দুটো বাচ্চা মেয়ে এসে পড়ল বাথরুম ব্যবহার করতে বলে পলাশ আমাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। তাও খুব শক পেয়েছিলাম, কী বিশ্রী মানসিকতা রে বাবা! সেদিন রাত থেকে আমার খুব জ্বর হয়েছিল। আমি তিনদিন বাড়ি থেকে বেরতেই পারিনি। বিছানা থেকে ওঠাটাই খুব কষ্টকর হয়েছিল। চতুর্থ দিন সেরে উঠে ল্যাবে গিয়ে শুনলাম পলাশের খবরটা। ব্যাস, এটাই আমার দিক থেকে যা ঘটেছিল তার বিবরণ!”
“আপনি পরদিন রাতে ওকে নটা নাগাদ ফোন করেননি?”
“না, না সেদিন আমার অবস্থা ভীষণ খারাপ ছিল জ্বরের চোটে, ফোন করা আমার পক্ষে অসম্ভব ছিল!”
“আপনার যে জ্বর হয়েছিল সেটা কেউ দেখেছে যে বলতে পারবে আপনি সত্যি কথা বলছেন?”
আমার ভারি রাগ হল! লোকটা আমার কথা বিশ্বাস করছে না! মনে করছে আমি মিথ্যে কথা বলছি! আমি তাও নিজেকে সংযত করে বললাম, “হ্যাঁ, আমার রুমমেট জানে। ও আপনাকে সব কিছু বলতে পারবে। প্রথম দুদিন তো গলা দিয়ে কিছুই নামেনি আমার!”
“আচ্ছা, আপনার রুমমেটের ডিটেলগুলো দিন তাহলে আমাকে, ওর সঙ্গে কথা বলে দেখব। আর ওকে কখন পাওয়া যাবে? এখন তো সে বাড়িতে নেই বলে মনে হচ্ছে, তাই না?”
“নাহ, ওর কাজ থেকে ফিরতে রাত হয়। ওর নাম ঐশী, ঐশী ঘোষ।”
“হোয়াট! ও মাই গড! ঐশী ঘোষ! সে আপনার রুমমেট! আমরা তো তাকে খুঁজছিলাম!”
“কেন? কী হয়েছে? কী করেছে ও? ওকে কেন খুঁজছেন আপনারা?”
“ওর সঙ্গে কথা বলা আমাদের ভীষণ দরকার! বেশ কয়েকটা কেসে ওর নাম জড়িয়ে আছে! আমরা গত কয়েকদিন ধরে ওর সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছিলাম কিন্তু ওর কোন ঠিকানা বা ফোন নম্বর পাচ্ছিলাম না!”
আমি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “কী কেস?”
আমার মাথায় ঘুরছিল আমার জামায় লাগা লাল লাল ছোপগুলো! ঐশী বলল বটে যে ওগুলো রেড ওয়াইনের দাগ কিন্তু যদি রেড ওয়াইন না হয়ে রক্ত হয় তাহলে? কী করেছে মেয়েটা আমার জানা দরকার।
“না, কেসগুলো নিয়ে তো তদন্ত চলছে তাই আপনাকে ঠিক বলা যাবে না! তাতে ভায়োলেশান হবে, কিন্তু এই আমার কার্ড। ও ফিরলে ওকে আমার সঙ্গে কথা বলতে বলবেন!”
“হ্যাঁ, নিশ্চয়ই! আমার দৃঢ় বিশ্বাস ঐশী কিছু করেনি। ও এমনিতে ভালো মেয়ে। একটু নারীবাদী গোছের কিন্তু তাতে কী? তার মানে এ তো নয় যে ও সাংঘাতিক কিছু করে বসবে!”
“আচ্ছা আপনি পলাশের ব্যাপারটা ঐশীকে বলেছিলেন?”
“হ্যাঁ, সেই রাতে আমি যখন বাড়ি ফিরি তখন আমার মনের অবস্থা খুব একটা ভালো ছিল না। পলাশ যে ওই রকম ব্যবহার করবে আমি ভাবতেও পারিনি। সেই শকেতেই ঐশীকে সব কিছু বলে দিয়েছিলাম আমি। ও শুনে আমার কষ্টে কষ্ট পেয়েছিল!”
“ও আচ্ছা। মেয়েটা কতদিন হল আপনার সঙ্গে রয়েছে?”
“তিন মাস!”
“ও আচ্ছা। আপনার ফোন থেকে ন’টা নাগাদ পলাশের কাছে একটা ফোন গিয়েছিল এবং আমাদের বিশ্বাস সেই জন্যেই ও বাইরে বের হয় এবং দুর্ঘটনার শিকার হয়! আপনি শিওর ওকে ফোন করেননি আপনি?”
“১০০ ভাগ! আমি তখন জ্বরে কাতর! হয়তো টেপা হয়ে গিয়েছিল কোন ভাবে।”
“ঠিক আছে। আমি আজ আসছি। আমার কার্ড রইল। আপনার রুমমেট ফিরলে ওকে ফোন করতে বললেন একটা। আর আপনার অন্য কিছু মনে পড়লে ফোন করবেন। শুভ রাত্রি!”
রোহন কুমার চলে যাওয়ার পর আমি আমার ফোনটা চেক করে দেখলাম। কল রেকর্ড দেখালো সত্যিই পলাশের ফোনে কল হয়েছিল রবিবার দিন রাতে। আমি আর ভাবতে পারছিলাম না। আগের দিনের রাঁধা চিকেন কারি দিয়ে ভাত খেয়ে শুয়ে পড়লাম। খুব ক্লান্ত লাগছিল। জ্বর থেকে উঠেছি বলেই হয়তো। মনে হচ্ছিল যেন শরীর থেকে সব কিছু নিংড়ে বার করে নেওয়া হয়েছে! পরদিন আবার ল্যাবে প্রচুর কাজ। সেই ঘুমিয়ে পড়াটাই আমার কাল হল কারণ ঐশীর সঙ্গে আমার আর দেখা হল না সেদিন।
আরও পড়ুন 👇👇
https://wwwankurisha.blogspot.com/2021/06/ankurisha-emagazine-bengali-poem-in_55.html
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন