লেবেল

বৃহস্পতিবার, ৬ আগস্ট, ২০২০

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।। ২২শে শ্রাবণ প্রয়াণ দিবসে -রবি- স্মরণ ।। Ankurisha ।। E.Magazine ।।Bengali poem in literature ।।



রবীন্দ্রনাথের কৃষিভাবনা, গ্রাম উন্নয়ন চিন্তা ও সমবায় পরিকল্পনা ও অন্যান্য

তু ল সী দা স  মাইতি


"আমাদের দেশে,আমাদের পল্লীতে পল্লীতে ধন-উৎপাদন ও পরিচালনার কাজে সমবায় নীতির জয় হোক,এই আমি কামনা করি। কারণ, এই নীতিতে যে সহযোগিতা আছে তাতে সহযোগীদের ইচ্ছাকে চিন্তাকে তিরস্কৃত করা হয় না বলে মানবপ্রকৃতিকে স্বীকার করা হয়। "
রাশিয়ার চিঠি'তে রবীন্দ্রনাথ এমনটাই লিখেছিলেন। প্রসঙ্গটির অবতারণা করে আমরা বিশ্বকবির একটি অনন্য ভাবনার অভিমুখে প্রবেশ করতে চাই। পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্য সাধকের দারিদ্র্যপীড়িত মাবব জীবনের ক্রমমুক্তির পথের নিরন্তর সন্ধানের দিকটি আলোচনার বাইরেই থেকে যায়। সমগ্র জীবনব্যাপী তিনি দেখেছিলেন দেশের বিশেষ করে পল্লীবাংলার কৃষক সহ প্রান্তিক মানুষেরা কষ্ট পায়। সংহত ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি এই মানুষগুলির শ্রমে ঘামে যুক্ত হয়নি বলেই এত দুর্ভোগ। 'দেশের অধিকাংশ জুড়েই তো গ্রাম'। আর এই গ্রামের অধিকাংশ মানুষ চাষের উপর নির্ভরশীল। পল্লীবাসীই নিপীড়নে ডুবে আছে-  এই বোধ কবিকে পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় ভাবনা প্রতি কর্মমুখী করে তোলে।

রবীন্দ্রনাথ তাঁর সাহিত্য জগতের মধ্যগগনে যখন উজ্জ্বল তখন দেশের সর্বত্র ব্রিটিশ আন্দোলনে ছড়িয়ে পড়েছে। মানুষ ভাবতে চাইছে এ দেশ তাদের। মুক্তিপিপাসু মানুষ নতুন দিনের অপেক্ষায় মরিয়া। রবীন্দ্রনাথ বুঝেছিলেন ব্রিটিশদের চলে যাবার সময় এসেছে। নতুন ভারত গড়ার প্রত্যয় তেমন ভাবে গড়ে উঠছে না। এই অবস্থানেই রবীন্দ্রনাথ সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উদ্যোগে নিজের জমিদারিতে শুরু করলেন "আত্মশাসনের শক্তিতে সম্পূর্ণ উদ্বোধিত করে তোলার বিপুল কর্মযজ্ঞ।' গ্রামের অর্থনীতি শিক্ষ ও স্বাস্থ্যের প্রতি দৃষ্টি দিলেন। অনেকদিন ধরেই তিনি নিজের জমিদারির মানুষকে দেখেছেন ও চিনেছেন বলে সুবিধে হলো  কাজে।কৃষি সংস্কার, জল সংস্কার ও নতুন বৈজ্ঞানিক অর্থনীতির রূপায়ণ এইভাবে কাজের সূচনা।  আজিতকুমার চক্রবর্তীকে এক চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন- "আমি গ্রামে গ্রামে যথার্থভাবে স্বরাজ স্থাপন করতে চাই- সমস্ত দেশে যা হওয়া উচিত ঠিক তারই ছোটো প্রতিকৃতি। খুব শক্ত কাজ অথচ না হলে নয়,"। কৃষিই প্রধান সম্পদ তাই তাকে নিয়েই তৈরি হলো নতুন ভাবনা।পল্লী অর্থনীতি পিছিয়ে যাচ্ছে দেখে  তাকে চাঙ্গা করার কাজে উৎসাহ দিলেন চাষীদের। দেশ বিদেশ থেকে ভুট্টা ও ধানের বীজ আনালেন। শুরু হলো চাষ। দ্বিজেন্দ্রলাল রায় এর উদ্যোগে শিলাইদহে আলুচাষ এবং অক্ষয় মৈত্রেয়র উদ্যোগে রেশমচাষ শুরু করেন। তাছাড়া কপি,পাটনাই মটর, কাঁকুড়, তরমুজ আখ ইত্যাদি। শক্ত মাটিতে ফল আনারস, লেবু কাঁঠাল পেঁপে ইত্যাদি। শুধু কি ফসল, সঙ্গে পশুপালন করার উৎসাহ দিলেন এবং কার্যকরী করার চেষ্টা করলেন। গোপালন, হাঁস মুরগির চাষ।
 রবীন্দ্রনাথ এখানেই থেমে থাকলেন না কৃষিবিজ্ঞান ও গোষ্ঠবিজ্ঞানে পারদর্শী করে তোলা এবং এখনকার কৃষি ও পশুপালনে সেই বিদ্যাকে কাজে লাগানোর অভিপ্রায়েই তিনি ছেলে রথীন্দ্রনাথ ও বন্ধু শ্রীশ চন্দ্র মজুমদারের পুত্র সন্তোষচন্দ্রকে পড়তে পাঠান আমেরিকার ইলিয়ন  বিশ্ববিদ্যালয়ে। একবছর পর তাঁর কনিষ্ঠ জামাতা নগেন্দ্রনাথ কেও  কৃষিবিদ্যা পড়তে পাঠান বিদেশে। উদেশ্য কি ছিল এ বিষয়ে জানতে পারি  নগেন্দ্রনাথকে লেখা কবির চিঠিতে-
"তোমরা দুর্ভিক্ষপীড়িত প্রজার অন্নগ্রাসের অংশ  নিয়ে বিদেশে কৃষি শিখতে গেছো।  ফিরে  এসে এই হতভাগ্যদের অন্নগ্রাস কিছু পরিমাণ যদি বাড়িয়ে দিতে পার, তাহলে এই ক্ষতিপূরণ হয়ে মনে সান্ত্বনা পাবো।"

তাদের ফিরে আসার পর শিলাইদহ এবং শ্রীনিকেতন তাঁদের প্রয়োগক্ষেত্র হয়ে ওঠে। নতুন নতুন কৃষি ভাবনা, কৃষি যন্ত্রপাতি, কৃষিবীজ, মাটি পরীক্ষাকেন্দ্রএবং গবেষণাগার তৈরির প্রচেষ্টা হল। জানা যায়, শিলাইদহে ট্রাক্টরএর উপযুক্ত চালক না পাওয়ায় রবীন্দ্রনাথ নিজেই চালকের ভূমিকা গ্রহণ করেন। সঙ্গে পাম্পের জল ব্যবহার শুরু হয়।  বলাবাহুল্য, কবির এই কর্মক্রিয়া স্থানীয় কৃষকদের মধ্যে প্রবল উত্তেজনা ও উৎসাহের সঞ্চার করে। কবির এই উদ্যোগ আধুনিক কৃষি ব্যবস্থার নতুন পথে যাত্রার সূচনা।

রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন, এদেশে কৃষকদের জন্য সমবায় নীতির যথার্থ প্রয়োগ না করলে দেশের তথা গ্রামবাংলার উন্নয়ন সম্ভব নয়। রাশিয়া ও ইউরোপ ভ্রমণের পর সমবায় সম্পর্কে এক বৃহৎ ধারণা গড়ে ওঠে কবির মনে। তিনি একজায়গায় লিখেছেন, "আমি তাদের (চাষিদের) ডেকে বললুম, তোমরা সমস্ত জমি একসঙ্গে চাষ করো; সকলের যা সম্বল আছে, সামর্থ্য আছে তা একত্র করো; তাহলে অনায়াসে ট্রাক্টর দিয়ে তোমাদের জমি চাষ করা চলবে। সকলে একত্রে কাজ করলে জমির তারতোময়ে কিছু যায় আসে না; যা লাভ হবে তা তোমরা ভাগ করে নিতে পারবে, তোমাদের সমস্ত ফসল গ্রামে একজায়গায় রাখবে, সেখান থেকে মহাজনরা উপযুক্ত মূল্য দিয়ে কিনে নিয়ে যাবে।"
মহাজনদের গ্রাস থেকে মুক্তির জন্যই তিনি ১৯০৫ সালে তৈরি করেন একটি সমবায় কৃষি ব্যংক। চাষীদের অল্পসুদে টাকা ধার দেওয়াই ছিল উদ্দেশ্য। নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর তিনি ওই ব্যংক- এ প্রায় এক লক্ষ কুড়ি হাজার টাকা বিনিয়োগ করেন। কৃষি  ব্যংক এর পাশাপাশি ফসল সঞ্চয়ের জন্য 'ধর্মর্গোলা'ও স্থাপন করেন।  স্বল্পমূলধনে নানান গবাদি পশুপালনের সাথে ,সুচিবয়ন শিল্প ,ছাতা শিল্প বয়ন শিল্প,পটারি শিল্প ইত্যাদির কাজ চলে। 
সমবায় ভাবনা ও কৃষি অর্থনীতির উন্নয়নের স্বার্থেই তিনি 'মণ্ডলীপ্রথা'র প্রচলন করেন। তাকে বলা বলা হয় পঞ্চায়েত ভাবন্যার প্রথম সূচনা। গ্রামে গ্রামে নির্দিষ্ট দিনে দিনে সভা চালু হলো। শ্রীনিকেতন সহ রবীন্দ্রনাথের বহু কর্মপ্রচেষ্টার সাথে   যুক্ত হতে ভারতে আসেন বিদেশি এলমহার্স্ট। তার প্রেরণা ও সহযোগিতায় গ্রামীন  তো তিনি   নতুন মাত্রা পায়।  

স্বাধীনতা অর্জনের সময় রবীন্দ্রনাথ বেঁচে ছিলেন না। কিন্তু তার এই কৃষিউন্নয়নপরিকল্পনা ও সমবায়নীতির স্বপ্ন পরবর্তী দেশ ও গ্রামীণ আর্থ সামাজিক রূপান্তরের  ক্ষেত্রকে প্রভাবিত করেছিল তা অনায়াসে অনুমেয়। তাঁর বর্ষামঙ্গল হলকর্ষণ অনুষ্ঠান এর তাৎপর্যও সেই অর্থেই  অনেক খানি।






গরীবের জন্য সমবায়ের ভালো মন্দ
গৌ ত ম হা জ রা  

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৩২৫ বঙ্গাব্দের 'ভান্ডার' পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় লিখেছিলেন, ',সকল দেশেই গরিব বেশি, ধনী কম। আমাদের দেশে টাকার অভাব আছে এ কথা বলিলে সবটা বলা হয় না। আসল কথা ভরসার অভাব, .... বিধাতা কিংবা মানুষ যদি বাহির হইতে দয়া করেন তবেই আমরা রক্ষা পাইব। এই জন্যেই আমাদের দেশে সকলের চেয়ে দরকার হাতে ভিক্ষা তুলিয়া দেওয়া নয়, মনে ভরসা দেওয়া'।

রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন এই বাংলাদেশের প্রত‍্যন্ত পল্লীপ্রান্ত পযর্ন্ত সমবায়ের সুদূরপ্রসারী সম্ভাবনার বাতা' ছড়িয়ে দেওয়া। ভারতবর্ষে সব'প্রথম সমবায় আন্দোলন প্রবতি'ত হয়েছিল ১৯০৪ সালে। যা ১৯১২  সালে এদেশে ব‍্যাপকভাবে প্রসারের চেষ্টা করা হয়। এবং সেই আন্দোলন একদিন মহীরূহ হয়ে ছড়িয়ে পড়ে চতু'দিকে। সমবায় নীতির ওপর  জনমত এবং পরিচালন ব‍্যবস্থার দৃষ্টিভঙ্গীও গড়ে ওঠে।

বতর্মান সময় এক বিশেষ সংকটময় সময়। গত কয়েকমাস ধরে মানুষ এক উদ্বেগজনক অবস্থার মধ্যে অবস্থান করছেন। কী শহরে, কী গ্ৰাম গ্ৰামান্তরে প্রত‍্যেকের মনেই এক অজানা আতঙ্ক যেন গ্ৰাস করে আছে। কিভাবে এর পরিত্রাণ পাওয়া যাবে? কেউ কিছুই বলতে পারছেন না। দেখছি, দিনের পর দিন লকডাউন বাড়ছে অথচ আক্রান্ত ও মৃত্যুমিছিল অব‍্যাহত। এহেন অবস্থায় মানুষ নিরুপায়, নিঃসহায়। তবুও মানুষ কিন্তু পিছিয়ে নেই। যেমন এগিয়ে এসেছেন স্বেচ্ছাসেবি সংস্থা, তেমনি সরকার সমবায়ের মাধ্যমে‌। কিন্তু তা সত্বেও কোথায় যেন এক বিশৃঙ্খলতা । রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, একে অপরের পরিপূরক হোক। তিনি সমবায় আন্দোলনের ওপর জোর দিয়েছিলেন যাতে সমবায়ের মাধ্যমে গরীব ও নিরন্ন মানুষ খাদ্য, চিকিৎসা ও অথ' সাহায্য পান। গরীবের মায় সকলের জন্যেই তো সমবায়। তাই সমবায়ী মানুষদের রবীন্দ্রনাথের পথাদশে' এগিয়ে এসে সঠিক ও সৎভাবে যদি সমবায় মাধ্যমে বিলি বন্টন করা বা সাহায্যের হাত বাড়ানো হত তাহলে নিরীহ মানুষেরা কেন বিপন্নতার স্বীকার হবেন? রবীন্দ্রনাথ তার চিন্তাধারাকে বাস্তাবায়িত করতে চেয়েছিলেন সমবায় চিন্তা ভাবনার সুসংহত প্রকাশ, মূল্যবোধ ও আদশে' অনুপ্রেরণা সৃষ্ট জনচেতনা। তিনি দেখতে চেয়েছিলেন বাংলার ঘরে ঘরে সে আন্দোলন পৌঁছাক, শহরেও তার বিজয় নিশানা উড়ুক।

বতর্মান সময়ে বোধ হয় এই সচেতনতার ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। ব‍্যাপকভাবে সমবায় মাধ্যমে যেভাবে প্রচেষ্টা চালানো দরকার সেখানে খামতিও দেখা যাচ্ছে। কি পরিচালন ক্ষেত্রে,কি বন্টন ক্ষেত্রে। কাজের ক্ষেত্রে দোষ ত্রুটি থাকবেই, তবুও সকল ঘাটতি পূরণ করে গরীব আত'  মানুষদের পাশে দাঁড়িয়ে সমবায়ের মাধ্যমে সফলতার প্রমাণ দেওয়ার সময় এখনই।






 আমার অনুভবে  সমবায় ও রবীন্দ্রনাথ 
স্ব প ন বি শ্বা স  

সমবায় হলো সমমনা মানুষের স্বেচ্ছা- সেবামূলক একটি স্বশাসিত সংগঠন,যা নিজেদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য অংশীদারির ভিত্তিতে, গণতান্ত্রিকভাবে ব্যবসা পরিচালনা করে।
আমরা প্রত্যেকে কোন না কোন পেশার সাথে যুক্ত। সেই পেশায় এককভাবে কাজ করতে যদি অসুবিধা হয়,তবে সে পেশাযুক্ত লোকেরা একত্রিত হয়ে যখন কোন কাজ করে এবং সমস্যা থেকে মুক্তি পায়,তখন ঐ সম্মিলিত প্রয়াসকে সমবায় বলতে পারি।
উদাহরণ হিসেবে,গুজরাতের আমূল,দিল্লির মাদার ডেয়ারির নাম করতে পারি।তামিলনাড়ুর 94% দোকান সমবায় দ্বারা চালিত।মহারাষ্ট্রে সবজির গ্রীনব্যাঙ্ক সফল সমবায়ের উদাহরন।

              সমবায়ের আন্দোলনের ইতিহাস কিন্তু নতুন নয়।ইউরোপে শিল্প বিপ্লবের পর হাজার হাজার শ্রমিক চাকরিচ্যুত হয়ে কঠিন সমস্যার মুখোমুখি হন।এ সময় 1844 সালে, ইংল্যান্ডের রচডেল নামক গ্রামে 28 জন তাঁতি 28 পাউন্ড পুঁজি নিয়ে ভাগ্য পরিবর্তনের লক্ষ্যে সর্বপ্রথম সমবায় সমিতি গড়ে তোলেন।তারপর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এ আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে।

            বৃটিশ উপনিবেশের পরে মহাজনী নাগপাশে আবদ্ধ, ঋণভারে জর্জরিত নিঃস্ব বাংলার কৃষকের দুঃখকে  রবীন্দ্রনাথ হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করেছেন।তিনি জানতেন, দারিদ্র্যের মূল কারন হলো মানুষের আত্মবিশ্বাসের অভাব,যা তাদের সর্বদাই সরকারের মুখাপেক্ষী করে তোলে।তাই ঐক্যের মাধ্যমে দরিদ্র মানুষের আত্মশক্তি জাগিয়ে তোলার লক্ষ্যে তিনি বারে বারে সমবায়ের কথা বলেছেন তার বিভিন্ন প্রবন্ধের মাধ্যমে। তিনি সমবায় নীতিকে মনুষ্যেত্বর মূল নীতি বলেছেন।তিনি বিশ্বাস করতেন,মানুষ সহযোগিতার জোরেই মানুষ হয়েছে ;সভ্যতা শব্দের অর্থই হচ্ছে একত্র সমাবেশ,যেখানে সকলের তরে সকলে আমরা,প্রত্যেকে আমরা পরের তরে।
রবীন্দ্রনাথ যা বিশ্বাস করতেন,তা কাজেও করে দেখিয়েছেন। নোবেল প্রাইজের এক লক্ষ আট হাজার টাকা দিয়ে পতিসরে কৃষি ব্যাঙ্ক গঠন করেছেন এবং উৎসাহ দিয়েছেন কৃষক,তাঁতশিল্পী ও মৃৎশিল্পীদের জন্য সমবায় গঠনে। শ্রীনিকেতনে সমবায় স্থাপন করে কৃষকদের ঋণদানের ব্যবস্থা করেছেন । কৃষি মজুরদের জন্য ধর্মগোলা ও লেবার ব্যাঙ্ক গঠন করেছেন।

           সমবায় সবার জন্য উন্মুক্ত একটি ব্যবস্থা।দারিদ্র দূরীকরণে এর বিকল্প নেই।ধনীদের ঋণ দেয় সবাই,সেখানে গরীবের ঋণদানে সমবায় একমাত্র সরল ও বিশ্বস্ত সংস্থা।আলাদা সিকিওরিটি গচ্ছিত রাখারও প্রয়োজন হয় না। সমবায় সহজে গঠন করা যায়। এটি একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা।এখানে লভ্যাংশের সমবন্টন করা হয়।সরকারী সাহায্যও মেলে।
অসুবিধা, সমবায়ের মূলধন সীমিত এবং অপর্যাপ্ত।পরিচালনায় প্রায়শ:ই দক্ষতার অভাব।প্রায়শ:ই ঋণের বেশির ভাগ টাকা মুষ্টিমেয় প্রভাবশালী সদস্যরা বেনামে হস্তগত করেন।অনেক সমবায় সমিতি  বিভিন্ন প্রলোভনের মাধ্যমে জনগণের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করেন এবং রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় অনৈতিক উপায়ে তা আত্মসাৎ করেন।ফলে,জনমানসে সমবায় সম্পর্কে সংশয়ের সৃষ্টি হয়।

            নতুন আর্থিক নীতির পরিস্থিতিতে ভারতে সমবায়ের ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।আজ রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ প্রায় নিশ্চিহ্ন হতে চলেছে।ব্যক্তিউদ্যোগ মুনাফা ছেড়ে উন্নয়নের ভাবনা ভাববেন না,বলাই বাহুল্য।এ অবস্থায় প্রতিবন্ধকতাগুলি কাটিয়ে সমবায়কে আঁকড়ে ধরে আমাদের বাঁচতে হবে।মনে রাখতে হবে,একতাই সর্বহারার একমাত্র শক্তি।








গরীবের জন্য সমবায়ের ভালো মন্দ 
সু বী র  ঘো ষ 


এই পৃথিবীতে গরীবের জন্য প্রায় কিছুই নেই। ধনীর জন্য অনেক কিছু। গরীবের অর্থ নেই ; তাই খাদ্য বাসস্থান স্বাস্থ্য শিক্ষা ব্যবসা বিনোদন কিছুই নেই । ধনী একক উদ্যোগে বিনিয়োগ করে নিজ নিজ উদ্যোগ চালিয়ে লভ্যাংশ   অর্জন করে নিতে পারে। গরীবের এই দুঃসহ অবস্থা থেকে মুক্তির  উপায়ের এক নাম " সমবায় "। সমবায় যেহেতু একটি সম্মিলিত প্রয়াস তাই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মাত্রায় পুঁজি শ্রম বুদ্ধি  ও দায়িত্ব নিয়োগ করে প্রভূত সুফল লাভ সম্ভব। আমাদের দেশে বহু পূর্বেই সমবায়ের ভাবনাটি  ভেবেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর মতে --" পরস্পরের  মিলিয়া যে মানুষ সেই মানুষই পুরা, একলা-মানুষ টুকরা মাত্র। " রবীন্দ্রনাথ ইউরোপে অনেক স্থানেই সমবায়ভিত্তিক কৃষি ও শিল্পের উদ্যোগ দেখেছিলেন। যেমন ডেনমার্কে সমবায় ভিত্তিতে দুগ্ধজাত দ্রব্যের ব্যবসা খুবই জমে উঠেছিল। রবীন্দ্রনাথের মতে--"অনেক মানুষ  একজোট হইয়া জীবিকানির্বাহ করিবার যে উপায় তাহাকেই য়ুরোপে আজকাল কোঅপারেটিভ -প্রণালী এবং বাংলায়"সমবায় " নাম দেওয়া হইয়াছে। এই কোঅপারেটিভ-প্রণালীই আমাদের দেশকে দারিদ্র্য হইতে বাঁচাইবার একমাত্র উপায় "। 
পিঁপড়ে ও হাতি। শারীরিক আকারে দুই বিপরীত মেরুতে অবস্থান। কিন্তু এক জায়গায় উভয়েই সমান। সেটি হল তাদের সমবায়চেতনা। পিঁপড়ে ও হাতি উভয়েই নিজেদের সম্মিলিত শক্তিতে বিশ্বাস করে। সমবায়ের নীতিই হল সকলের সম্মিলিত কর্মশ্রমকে একত্র করে অর্থশক্তিকে সকলের জন্য সুলভ করা। কোনো এক বিশেষ ব্যক্তির হাতে পুঁজি থাকলে সে সেই পুঁজি খাটিয়ে যে মুনাফালাভে সক্ষম হবে তা সে নিজের হাতে রাখবে এবং নিজের প্রয়োজনে ব্যয় করবে। সে শ্রমের নির্দিষ্ট মজুরিরও কমে কাজ হাসিল করার চেষ্টা করবে যাতে তার মুনাফার ভাগ বেশি থাকে। সমবায়ে সে সুযোগ নেই । তবে সমবায়ের মূল ভিত্তি সততা ও বিশ্বাস। এই দুই গুণবত্তায় ফাটল ধরলে একে অপরকে প্রতারণা করার চেষ্টা করবে। এবং সমবায়ে ঘুণ ধরবে। ধনী ব্যক্তি তার ধনের আকর্ষণে সমবায়কে ভাঙার চেষ্টা করবে যাতে বিনিয়োগ তার হাতেই থাকে। 
রবীন্দ্রনাথ ডেনমার্কের দুগ্ধ জাত দ্রব্যের সমবায়ের কথা লিখে গেছেন। ব্রিটিশ ভারতে সমবায় উন্নয়নের সুযোগ ছিল না। রবীন্দ্রনাথ দেখে যেতে পারেননি ১৯৪৬ সালে গুজরাটের আনন্দে দুগ্ধজাত দ্রব্যের সমবায় আমুল আজ সমগ্র দেশের একটি গর্বের সংস্থা । সেরকমভাবে ইফকো,কৃভকো,লিজ্জতপাঁপড়,এনসিডিসি,নাফেড ইত্যাদি সমবায়ভিত্তিক সংস্থাগুলিও ভারতে ভালোভাবে প্রতিষ্ঠিত। এ ছাড়া আমাদের দেশে কোঅপারেটিভ ব্যাঙ্ক, কোঅপারেটিভ ক্রেডিট সোসাইটি এবং কোঅপারেটিভ হাউসিংও বেশ সাদরে গৃহীত হয়েছে। 
শেষ করি রবীন্দ্রনাথের উক্তি স্মরণ করে---"ধনী আপন টাকার জোরে নির্ধনের শক্তিকে সস্তা দামে কিনিয়া লইতে চায় ; ইহাতে করিয়া টাকা এবং ক্ষমতা কেবল এক-এক জায়গাতেই  বড়ো হইয়া উঠে। কিন্তু সমবায়-প্রণালীতে চাতুুরী কিংবা বিশেষ একটা সুযোগে পরস্পর  পরস্পরকে  জিতিয়া বড়ো হইতে  চাহিবে না। মিলিয়া বড়ো হইবে। "



আমার অনুভবে সমবায় ও রবীন্দ্রনাথ   

দী প ক বে রা  


বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একজন নিরেট কবি এবং মানবিক মূল্যবোধের ধারক ও বাহক কিন্তু তৎকালীন ভারতবর্ষের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে তাঁর ভাবনাগুলো ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও কালোত্তীর্ণ। প্রচণ্ড দারিদ্র্য, অজ্ঞতা, অশিক্ষা, কুসংস্কার, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, দুর্বৃত্ত মহাজন কর্তৃক কৃষক শোষণের মত নৈমিত্তিক সমস্যাগুলো পল্লীর একটি শ্রেণিকে বৈষম্যের বেড়াজালে আকীর্ণ করে। তিনি জমিদারির দায়িত্বপ্রাপ্তির পর পল্লীর এই শ্রেণির মানুষের জীবনযাত্রা গভীরভাবে অবলোকন করার প্রয়াস পান এবং তাদের মানবেতর জীবনযাপন পর্যবেক্ষণ করে তাঁর কবিমন বেদনায় সিক্ত হয়।
     তখন থেকেই এইসব হতদরিদ্র কৃষক ও মানুষদের দারিদ্র্যমুক্তির উদ্দেশ্যে গঠনমূলক কিছু কাজ করার জন্য তাঁর দরদী মন ক্রমশ বিচলিত হয়ে ওঠে। 


ভারতবর্ষের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে রবীন্দ্রনাথ অনুভব করেছিলেন সরকারের রাজস্ব আয়ের যৎসামান্যই প্রজার হিতসাধনের জন্য উদ্বৃত্ত থাকে। রাজশক্তির কাছে প্রজার এই যে অসাম্য তা কমিয়ে আনতেই তিনি সমবায় ভাবনার ওপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন। সাধারণ অর্থে সমবায় বলতে বোঝায় একটি সমাজের কিছু ব্যক্তি একত্রিত হয়ে কোনও অর্থনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনা করা। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের সমবায় ভাবনা ব্যাপক ও বিশেষ কিছু ধারণা বহন করে। সুতরাং এই কারণেই তাঁর সমবায় ভাবনা অন্যান্য ভাবনার তুলনায় অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। চরম দুঃখ-দুর্দশার মধ্যে প্রজাসাধারণের আয়-রোজগার করবার উপায়, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসুবিধা, সর্বোপরি সমাজের বিদ্যমান অসাম্যের বিরুদ্ধে জয়ী হতে হলে একত্রিত হওয়ার কোনও বিকল্প নেই। এই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, "এমন একটা সময় ছিল যখন ধনীর ধনের ওপর সমাজের দাবি ছিল। ধনী তার ধনের কল্যাণধর্মী ব্যবহার করেছে, সামাজিক দায়বদ্ধতা ছিল। আজ সমাজনীতির পরিবর্তন হয়েছে। ধনের ভোগ এখন ব্যক্তিগত। রাষ্ট্রের বা সমাজের ধন এখন লোকহিতে নিযুক্ত নয়, ফলে লোকসাধারণ আপন হিতসাধনে অক্ষম। আজ ধনীরা শহরে এসে ধন ভোগ করছে, ফলে গ্রামের সাধারণ লোকেরা আপন ভাগ্যের কার্পণ্য নিয়ে হাহাকার করছে। তাদের ভেতরে যে লুকোনো শক্তি আছে, আত্মশক্তি উদ্বোধনের মাধ্যমে তাদের যে নিজেদের বাঁচবার উপায় আছে, সেই বিশ্বাস তারা যেন হারিয়ে ফেলেছে।" সেজন্যে রবীন্দ্রনাথ আত্মশক্তি অর্জনের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। লোকসাধারণের ঐক্যের কথা বলেছেন। সংঘবদ্ধ হতে বলেছেন। 'সমবায়' গঠনের কথা বলেছেন।
    সমবায় প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, "একলা মানুষ টুকরা মাত্র। মানুষ যদি মিলতে না পারে তাহলে তাদের ভরসার পরিবেশ তৈরি হবে না"। আর এই ভরসাই যে মানুষের জীবনের একটা মস্তবড় সম্পদ সেই কথাটি রবীন্দ্রনাথ খুব স্পষ্ট করে বলেছেন। সমবায় মানেই মানুষের ঐক্য। এই ঐক্যের কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেছেন, "একা একা অন্ন ভক্ষণ করা যায়, তাতে হয়তো পেট ভরে। কিন্তু পাঁচজন মিলে খেলে পেটও ভরে, আনন্দও মেলে এবং আত্মরক্ষাও পাওয়া যায়"। সেজন্যে তিনি ধন-অর্জনে সকলের অংশগ্রহণের ওপর এতটা জোর দিয়েছেন। সমবায় প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ আরও বলেছেন, "আমাদের প্রত্যেকের মধ্যেই যে অন্তর্নিহিত শক্তি আছে, ধন আছে এই সহজ কথাটি বুঝলে এবং কাজে খাটালে তবেই আমরা দারিদ্র্য থেকে বাঁচব"।
     দল বেঁধে থাকা, দল বেঁধে কাজ করাই মানুষের ধর্ম। এই ধর্ম থেকে বিচ্চুত হলেই মানুষ লোভ, ক্রোধ, মোহের মত রিপুর শিকারে পরিণত হয়। ধনীর ধনে দারিদ্র্য হরণের ক্ষমতা যে নেই সেই কথাটাই তাঁর সমবায় ভাবনার মূলে রয়েছে। লোকসাধারণের ধন-উৎপাদনের ক্ষমতার্জনের মাধ্যমেই যে দারিদ্র্য বিমোচন করা সম্ভব, সে কথা তিনি বারবার বলেছেন। 
     গ্রামের সমাজবদ্ধ ও আত্মীয়তার সম্পর্কের মূল্যবোধ কে পায়ে ঠেলে যেভাবে নগরগুলো গড়ে উঠছে সেই আশঙ্কার কথাও তিনি বলেছেন। "ভারতবর্ষে সমবায়ের বিশিষ্টতা" প্রবন্ধে তিনি বলেছেন, "যে ব্যাপক ব্যবস্থায় আমাদের দেশের জনসাধারণ কে সকলরকমে মানুষ করে রেখেছিল আজ তাতে ব্যাঘাত ঘটছে। দেশের সর্বত্র প্রাণের রস সহজে সঞ্চারিত হবার পথগুলো আজ অবরুদ্ধ। আমার মনে হয়, যতদিন পর্যন্ত এই সমস্যার সমাধান না হয় ততদিন আমাদের রাষ্ট্রীয় উন্নয়নের চেষ্টা ভিত্তিহীন, আমাদের মঙ্গল সুদূরপরাহত"।
     রবীন্দ্রনাথ মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন, ভারতবর্ষের শক্তিশালী উন্নয়নের ভিত্তি হল পল্লীর পুনর্জাগরণ। কেননা দেশের সিংহভাগ মানুষই বাস করে গ্রামে। তাই গ্রামবাংলার মানুষের ঐক্য ও আত্মবিশ্বাস কে জাগিয়ে তুলতে হবে। তিনি বলেছেন, "আমাদের সকলের কর্মশ্রম কে মিলিত করে অর্থশক্তিকে সর্বসাধারণের জন্য লাভ করা। একেই বলে সমবায়নীতি।" 
     তিনি মনে করতেন, ধনসম্পদ কোনও একক ব্যক্তি বা সম্প্রদায়ের কাছে গচ্ছিত থাকবে না, সর্বসাধারণের শক্তি সম্মিলিত হয়ে সে ধন হবে সমবায়ের মাধ্যমে জনগণের সম্পদ। পল্লীর আধুনিকীকরণ ও আত্মনির্ভরশীল করে গড়ে তোলার জন্য তিনি কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্ক, সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায়, সেচ সমবায়, মৎস্যচাষ সমবায়, তন্তুবায় সমবায়, সমবায় ভাণ্ডার, ধর্মগোলা ইত্যাদি বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নিয়েছিলেন। তাঁর সমবায় ভাবনাটি অর্থনীতিতে Cooperative Society - কেই বোঝায় না, ভাবনাটির দ্বারা Economy of Large Scale Production Concept - কেও নির্দেশ করে। এককথায় কেবল ঐক্যবদ্ধতা দিয়েই নয়, একটি আদর্শ সমবায় গড়ে তুলতে হলে সততা ও মানসিক সংঘবদ্ধতা থাকতে হবে। 
তাঁর যৌথ খামার ধারণাটির ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে তাঁর সমবায় ভাবনাটি। 
      রবীন্দ্রনাথ সমবায়কে দেখেছিলেন গ্রামের পুনরুজ্জীবনের চাবিকাঠি হিসেবে। মণ্ডলীপ্রথার মাধ্যমে সমবায়ের ভিত্তিতে তিনি গড়াই নদীর তীরে জানিপুর, গোহাটা, পান্টিতে সুতা কাটা এবং বিভিন্ন গ্রামে তাঁতশিল্পের প্রসার ঘটাতে পেরেছিলেন। তাছাড়া স্বাস্থ্য পরিচর্যার কর্মসূচিও গ্রহণ করা হয় মণ্ডলীপ্রথার মাধ্যমে। 
     শ্রীনিকেতনে দুই ধরণের সমবায় জনপ্রিয় হয়েছে। 1922 সালে এল্মহার্স্টে শান্তিনিকেতনের কয়েকজন ছাত্র ও কর্মীসহ "সুরুল গ্রামোন্নয়ন কেন্দ্র" স্থাপন করেন। তার আগে শান্তিনিকেতনে 1921 সালে "শান্তিনিকেতন বিশ্বভারতী সমিতি" এবং তার অঙ্গস্বরূপ "শান্তিনিকেতন কর্মসমিতি" ও "সুরুল কৃষিসমিতি" নামে দুটি পৃথক সমিতি গঠন করেন। এইভাবে রবীন্দ্রনাথ গরিব প্রান্তিক কৃষক ও আদিবাসীদের সমবায় প্রীতির মাধ্যমে আত্মনির্ভরশীল করে গড়ে তোলার নানাবিধ চেষ্টা ও পরিকল্পনা করেছিলেন। 


দারিদ্র্য প্রতিটি সমাজের অবয়বে অঙ্কিত এক দুষ্ট ক্ষত। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অর্থনীতিবিদ দারিদ্র্য থেকে মুক্তির নানা দাওয়াই দিয়েছেন, কিন্তু কোনও সমাজই দারিদ্র্যমুক্ত হয় নি। ভাগ্যের হাতে মার খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ক্রমশ বেড়ে চলেছে, কারণ দরিদ্রের উপার্জনের পথ থাকে রুদ্ধ। তারা তাই দারিদ্র্যকে নিয়তি বলে মেনে নিয়ে দারিদ্র্যের দাসত্ব করে চলেছে। দারিদ্র্যমুক্তির ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথের ভাবনা ছিল সুদূরপ্রসারী, প্রযুক্তিনির্ভর ও যুগান্তকারী। সামগ্রিক আর্থ-সামাজিক কাঠামো নিয়ে তৎকালীন মানুষ যা ভাবতে পারেনি তিনি তখনই তার বাস্তবায়ন ঘটিয়েছেন। গতানুগতিক কৃষিব্যবস্থার বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে এসে উন্নত যান্ত্রিক চাষপদ্ধতি ব্যবহার করে উৎপাদন ও আয় বাড়িয়ে দারিদ্র্য থেকে মুক্তির পথ কৃষকদের বাতলে দেন। উন্নত কৃষিব্যবস্থা প্রবর্তনের পাশাপাশি তিনি শ্রীনিকেতনে বাটিক, সিরামিক ও চামড়াজাত পণ্য উৎপাদনের মাধ্যমে কৃষকদের আর্থিকভাবে সহায়তা করেন। এছাড়াও ধানভানা কল, আখচাষ, তাঁতশিল্প, রেশমশিল্প, আখমাড়াই কল, হাঁস-মুরগির খামার, বেত ও বাঁশশিল্প, ছাতা তৈরি, ভুট্টাচাষ, আলুচাষ ইত্যাদি বিভিন্ন বিকল্প মাধ্যমে উপার্জনের পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। এভাবেই তিনি হতদরিদ্র মানুষের দারিদ্র্য বিমোচনের বিভিন্ন রকম চেষ্টা করেছেন। একমাত্র সৎ, দৃঢ়চেতা মানুষই পারে মানুষের ভেতরের আত্মবিশ্বাসকে জাগিয়ে তুলতে, যিনি হবেন সমাজ প্রবর্তক ও পরিবর্তক এবং তাঁর দ্বারাই সমাজ ও রাষ্ট্র হবে চিরদারিদ্র্যমুক্ত। যুগে যুগে সমাজে এমন প্রতিনিধি ছিল তাঁর প্রত্যাশা। 



পল্লী উন্নয়ন ভাবনার একটি অংশ হল জমিদার কবি রবীন্দ্রনাথের ক্ষুদ্রঋণ ভাবনা। তিনি মনেপ্রাণে ধারণ করেছিলেন যে কৃষিপ্রধান এদেশে কৃষির উন্নয়ন ব্যতীত সামগ্রিক সমাজকাঠামোর উন্নয়ন সম্ভব নয়। পৈতৃক জমিদারি ভাগাভাগির পর তাঁর ভাগে পড়ে পতিসরের কালিগ্রাম পরগণার জমিদারি দেখভালের দায়িত্ব, যেখানকার আশি ভাগ প্রজা ছিল মুসলিম এবং তারা কৃষিজীবি। একফসলী জমি ছিল অনুর্বর। উপর্যুপরি যে বছর বন্যা বা ক্ষরা হত সে বছর কৃষকদের দুঃখের অন্ত থাকত না। পাশাপাশি জমির খাজনা মেটাতে মহাজনের দারস্থ হতে হত। কৃষকদের জীবনে নেমে আসত চরম বিপর্যয়। প্রজাদরদী জমিদার কবি কৃষকদের এই দুঃখ-দুর্দশা অবলোকন করে পতিসরে একটি কৃষিব্যাঙ্ক স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিলেন। কৃষকদের ঋণজর্জরিত জীবনের নাগপাশ থেকে মুক্তিদানের জন্য তিনি কৃষিব্যাঙ্ক স্থাপন করলেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর নোবেল পুরস্কারের সম্পূর্ণ অর্থ দিয়ে কৃষিব্যাঙ্কটি স্থাপন করেছিলেন। 1937 সালে "বিশ্বভারতী সমবায় ব্যাঙ্ক" প্রতিষ্ঠিত হয়। 

রবীন্দ্রনাথ একজন শুদ্ধ কবি হয়েও মানবসমাজের এমন কোনও দিক নেই যেদিকে তাঁর ভাবনার স্পর্শ পায়নি। তিনি একদিকে যেমন ছিলেন দার্শনিক ভাববাদী অপরদিকে ছিলেন জীবনবাদী। আধ্যাত্মবাদের সঙ্গে জীবনবাদের সমন্বিত রূপের মাঝে নিহিত রয়েছে তাঁর ভাবনাগুলোর প্রকাশ অর্থাৎ সমাজের কল্যাণে গৃহীত বিভিন্ন ক্ষেত্রভিত্তিক পদক্ষেপ। দরিদ্র কৃষকদের প্রতি, মানুষের প্রতি, জীবের প্রতি তাঁর গভীর মমত্ববোধ, সমাজের প্রতি কর্তব্যবোধ তাঁর জীবনাদর্শের মূল বক্তব্য। বাঙালি সংস্কৃতির রূপকার রবীন্দ্রনাথ আমাদের চিরকালের অহংকার। এই উপমহাদেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে তাঁর জীবনাদর্শ আমাদের এক পরম নির্ভরতা। সেদিক থেকে বিবেচনা করলে আমাদের সমাজে রবীন্দ্রনাথের গ্রহণযোগ্যতা ও প্রাসঙ্গিকতা ইতিবাচক। 
     আজও আমরা সবাই দারিদ্র্য ও বঞ্চনা থেকে মুক্তির পথ সন্ধান করছি। রবীন্দ্রনাথ তাঁর 'সমবায়নীতি - ১' প্রবন্ধে বলেছেন, "দারিদ্র্যের ভয় আসলে ভূতের ভয়। ছাড়া ছাড়া থাকার জন্য মানুষের এই ভয়"। একত্রিত হতে পারলে, ভরসার পরিবেশ তৈরি করতে পারলে এই ভয় যে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব তা সহজেই বোধগম্য। 
     কোনও কোনও মহলের বিতর্ক, বিরোধিতা সত্বেও রবীন্দ্রনাথের জীবনদর্শন, গরীবদের জন্য তাঁর সমবায় ভাবনা এবং তাঁর আর্থ-সামাজিক ভাবনার প্রতিফলন আজও আমাদের সমাজে সমান প্রাসঙ্গিক ও চিরন্তন। 





আমার অনুভবে  রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সমবায় ভাবনা 
- পা র্থ সা র থি চ ক্র ব র্তী 

রবীন্দ্রনাথ শুধু বাংলাভাষার কবি বা ভারতীয় কবি হিসেবে বন্দিত নন । বরং নোবেলজয়ের মধ্য দিয়ে বিশ্বকবির খ্যাতি লাভ করেন ।সাহিত্যে সৃজনশীলতার প্রশ্নে তার সুনামের কোন আলোচনাই যথেষ্ট নয় । পাশপাশি তিনি সাধারণ মানুষের, দরিদ্র মানুষের জীবনধারার  মানোন্নয়নের জন্য গভীরভাবে ভাবতেন ।এই উন্নয়নের সোপান হিসেবে অর্থিক ও সামাজিক উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে গভীর চিন্তাভাবনা  বারবার ফুটে উঠেছে তাঁর রচনায় ।

তদানীন্তন কৃষকদের ও গরীবদের জীবনযাত্রার মান ছিল খুব নীম্ন । রবীন্দ্রনাথ এসব হতভাগ্যদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য দারিদ্র্য  দূরীকরণ , অশীক্ষা   ও কুসংস্কার দূর করা, সামন্তবাদী মহাজন প্রথা বিলোপ করার মাধ্যমে প্রান্তীক মানুষের জীবনকে  অন্ধকার থেকে প্রদীপের আলোয় নিয়ে আসার জন্য " সমবায় ভাবনা "র বিকাশ ঘটানোর প্রস্তাব করেন। সমবায় বলতে " কিছু ব্যক্তি একত্রিত হয়ে কোন অর্থনৈতিক কর্ম পরিচালনা করা "কে বোঝায় । রবীন্দ্রনাথের " সমবায় " ভাবনা অবশ্য ব্যাপক ধারনা বহন করে ।কাজেই এই ধারনা অনেক বেশি বিস্তৃত এবং গভীর ।কেউ কেউ বলেন, তাঁর সমবায় ভাবনার সাথে রুশ এবং আয়ারল্যান্ড এর সমবায় ভাবনার মিল খুঁজে পাওয়া যায় । এই ধারনা তত্বগতভাবে ও কর্মপ্রক্রীয়াগত দিক দিয়ে প্রচলিত ধারণার থেকে কিছুটা ভিন্ন ।তাঁর ভাবনার মূল স্তম্ভ ছিল  ' মানসিক সংঘবদ্ধতা "।তিনি শ্রম ও অর্থ একত্রিত করার পাশপাশি মানসিক ঐক্যের উপরে বেশি জোর দিয়েছিলেন ।
তাঁর ভাষায় " অনেক গরীব এক জায়গায় আপন সামর্থ্য মিলাইতে পরিলে সেই মিলনই মূলধন " ।রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সমবায় ভাবনা এভাবেই বিকশিত হতে চেয়েছে।
একা ব্যক্তি দুর্বল ও  অসম্পূর্ণ ।আর একজন অসম্পূর্ণ মানুষ একা এমন কিছু করতে পারেন না যা দশজন মিলে করা সম্ভব।তাই একটি সামাজিক পুঁজি ( social capital)গড়ে তুলতে চেয়েছেন ।আর তার মাধ্যমে তিনি " সমবায় খামার " গড়ে তোলার উপরে গুরত্ব আরোপ করেন।তিনি দৃঢ়বিশ্বাসী ছিলেন যে,সমবায় ই একমাত্র পথ যার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের দারিদ্র্য দূর করা সম্ভব হতে পারে ।তিনি বারবার বিভিন্ন জায়গায় বলেছেন, সকলের কর্মশ্রমকে একত্রিত করে দরিদ্রের সম্মিলিত অর্থশক্তি অর্জন করতে হবে ।সমবায়ের মাধ্যমেই তা করা যেতে পারে ।সমবায় ই পারে দুর্বলকে সেই শক্তি প্রদান করতে ।তাঁর ধারণার  এই সমবায় ব্যবস্থায় কোন আমলাতান্ত্রিক  নিয়ন্ত্রণ তিনি চান নি।বরং তিনি সব অংশগ্রহনকারীদের সম্পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে সওয়াল করেছেন ।তিনি চাইতেন ধনসম্পত্তি সমবায়ের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হবে আর তা হবে জনগনের সম্পদ।তার জন্য তিনি সমবায় ব্যাঙ্ক, সমবায় গোষ্ঠী গড়ে তোলার পরামর্শ দিয়েছিলেন ।রবীন্দ্রনাথের সমবায় ভাবনা নিছক '  cooperative society 'বোঝায় না, বরং ' economy of large scale production concept' কেই বোঝায়। সততা ও মানসিক সংঘবদ্ধতার মাধ্যমেই তিনি তাঁর স্বপ্নের সমবায় গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন।
সমবায়ের মাধ্যমে দারিদ্র্য ঘোচানোর জন্য কৃষকদের ছোট ছোট জমিকে একত্র করে যান্ত্রিক চাষপদ্ধতির মাধ্যমে চাষ করতে বলেছেন।তা তাদের অত্মনির্ভর হতে সাহায্য করবে । আত্মবিশ্বাস এনে দেবে ।রবীন্দ্রনাথ মানুষের অভ্যন্তরীণ শক্তিকে জাগিয়ে তুলে মানসিক বিপ্লবের মাধ্যমে দারিদ্র্য দূর করার কথা বলেছেন।আধুনিক  যন্ত্র ব্যবহার করে শ্রম ও অর্থ সাশ্রয় করতে বলেছেন। তাঁর  " রাশিয়ার চিঠি " তে দেখা যায় তিনি সমবায়ের মাধ্যমে জমি একত্র করে আধুনিক চাষপদ্ধতির প্রয়োগ করে উৎপাদন বাড়িয়ে অর্থিক অগ্রগতি ঘটাতে চেয়েছিলেন । পুঁজিবাদের আগ্রাসন থেকে দরিদ্রদের পরিত্রাণের উপায় হিসেবে সমবায় পদ্ধতিকে বর্ণনা করেছেন ।একমাত্র সমবায়নীতি ই আত্মসম্মানবোধ ও আত্মবিশ্বাস এনে দিতে পারে । কেননা সমবায়ের মধ্যে নিহিত আছে অংশীদারীত্ব, পারস্পরিক নির্ভরশীলতা ও  সহযোগিতা ।




তথ্যসূত্র: ১।রবীন্দ্র রচনাবলী, সমবায়নীতি-১। বিশ্বভারতী





৪টি মন্তব্য:

  1. খুব ভালো সংখ্যা হয়েছে। বিষয় নির্বাচন সুন্দর।

    উত্তরমুছুন
  2. অঙ্কুরিশার এই সংখ্যাটি অতি উচ্চমানের l মূল্যবান লেখা দিয়ে ভরানো l বহু প্রথিতযশা লেখক কলম ধরেছেন l এই মণি মুক্তোগুলো তিলতিল করে সাজিয়ে সম্পাদক মহাশয় অপূর্ব সুন্দর মালা গেঁথেছেন l সম্পাদক মহাশয়কে অনেক অনেক শুভেচ্ছা, ভালোবাসা ও অভিনন্দন l

    উত্তরমুছুন