তপন বন্দ্যোপাধ্যায়
তপন বন্দ্যোপাধ্যায়
'শাইকু সম্পর্কে দু'চার কথা'
পৃথিবীতে নানা আশ্চর্যের মধ্যে অন্যতম নরনারীর পারস্পরিক সম্পর্ক। আবহমানকাল থেকে পুরুষ ও নারী দু'জন দু'জনকে চায়। তবু সেই চাওয়া ও পাওয়ার মধ্যে দুস্তর ব্যবধান। দু'জন পুরুষের মধ্যে যেমন চরিত্রগত পার্থক্য, তেমনই দুই নারীর মধ্যেও । প্রতিটি মানুষের মানসিক গঠন , তার বৈচিত্র্য,তার জটিলতার ধরন এতোই আলাদা যে, দুটি নারীর মুখোমুখি হওয়া মানেই কোনো না কোনো ভাবেই তৈরি হতে থাকে একটি গল্প, কিংবা সৃষ্টি হয় একটুকরো কবিতা। পৃথিবীতে প্রতি মুহূর্তে এমন অসংখ্য আখ্যান বা লিরিকের উদ্ভব হয় কিন্তু তা ধরে রাখার অভাবে বিনষ্ট হয়, পরক্ষণেই। শুধু যার হাতে লেখনী থাকে তিনিই সাদা পৃষ্ঠায় মূর্ত ধরে রাখতে পারেন,সেই মুহূর্তগুলো ।
"প্রেম অবিনাশী " অর্থাৎ প্রেম ধ্বংস হতে পারে না। তাই তিন বা চার পঙক্তির মধ্যে প্রেমের অনুভূতির প্রকাশ করার জন্য "শাইকু" র আবির্ভাব ।
কবির অভিব্যক্তি
অনেক শায়ের পড়েছি। মাঝেমধ্যে মনে হয়েছে প্রেমের নানা অনুভূতি নিয়ে এরকম টুকরো লেখা লিখলে কীরকম হয়!
জাপানি হাইকু, তাও নানা সময়ে কিছু পড়েছি।
দুয়ের মিলন ঘটিয়ে এক নতুন শব্দবন্ধ তৈরি করলাম শাইকু।
'শাইকু'র ব্যুৎপত্তি
শায়ের+হাইকু= শাইকু।
শাইকু
- তপন বন্দ্যোপাধ্যায়
শাইকু ১
সমুদ্রকিনারে তুমি হেঁটে যেতে যেতে
ময়ূরপঙ্খি আঁকা আঁচল ওড়াও
তুমি কি জানো না, সখী, প্রতিটি পা-ছাপে রোজ ভালোবাসা ফেলে ফেলে যাও।
শাইকু ২
একা একা কবুতর ডানা দুটি মেলে
উধাও হতে চায় কোন দূর দেশে
আর এক কবুতরি ডানা ঝাপটিয়ে
পথ আগলালো কত ভালোবেসে।
শাইকু ৩
কে যেন সহসা হাসি-হাসি মুখে সন্ধ্যাপ্রদীপ দিয়ে
কোন পথ ধরে পলকে মিলালো সবুজ আঁচল উড়িয়ে
তাকে খুঁজে খুঁজে আমি দিশেহারা দিই অস্থির ডাক
কোথাও তো তার সাড়া পেলাম না হঠাৎ বাজল শাঁখ।
শাইকু ৪
তুমি আসবে বলেই তো
সমস্ত আকাশ জুড়ে টাঙিয়েছি নীলচে চাঁদোয়া
একটু-একটু করে বিছিয়েছি সহস্র যোজন পথ
কত বর্ণ ফুল দিয়ে ভরিয়েছি দীর্ঘ চরাচর
এসে দেখোই না
বুক ভরে জমিয়েছি কত প্রেম--এক সরোবর।
শাইকু ৫
দুটি মন বাস করে দুই দূর প্রান্তে
দুজনেই রাখে শুধু দুজনের খোঁজ
মাঝখানে থাকুক না অনন্ত মাইল
এরিয়েল বেয়ে বেয়ে ছুঁয়ে যায় রোজ।
শাইকু ৬
একগুচ্ছ ফুল তোমাকে দিলাম বসন্তের উপহার
ফুলের সঙ্গে আমি রইলাম হৃদয়ে তোমার।
শাইকু ৭
তোমার দু'চোখ যেন পূর্ণ সরোবর
শরীর ডুবিয়ে নেয় শুক্লপক্ষ চাঁদ
জলের ভিতর চাঁদ কাটে ইলিবিলি
প্রেম এমনই অমোঘ--চির-উন্মাদ।
শাইকু ৮
নীল আলো জ্বেলে রেখে কথোপকথন চলে
দুই নারী ও পুরুষ
ঘরের বাইরে ঝড়ে তোলপাড় পৃথ্বী
কারও নেই হুঁশ।
শাইকু ৯
অর্ধবৃত্তাকারে খড়হাঁস যায় উড়ে মেঘ গায়ে মেখে
কী একটা পড়ল খসে, ছুটে গিয়ে দেখি বার্তা গেছে রেখে
যাবে যদি চলে এসো, দিকচক্রবাল-ছোঁয়া বনে-বনান্তরে
এ্যাদ্দিন খুঁজেছ যাকে, তোমার জন্যই আজও অপেক্ষা করে।
শাইকু ১০
চলে যাবেই যদি
তবে এতটা পথ সঙ্গে ছিলে কেন
আমি তো অপেক্ষায় ছিলাম আসন্ধ্যাসকাল
রক্তকরবীর নীচে
তা হলে হল না কেন সমাপন মধুরেন।
শাইকু ১১
কে যেন ঘুলিয়ে দিল আমাদের প্রেমের পৃথিবী
বিন্দু বিন্দু কালো মেঘ বাড়িয়েছে অন্তর্লীন চাপ
প্রকৃতিই দিতে পারে অন্ধকারে বেরোনোর পথ
ও কাঞ্চন, মুছে দাও আমাদের সব মন খারাপ।
শাইকু ১২
হঠাৎ উদবেল হই একটি পাখির কলতানে
তার দূত হয়ে আজ শিস দেয় খোলা জানালায়
তার ঠোটে গুঁজে দিই একটি পুরুষ্ট নীল খাম
বলি, ওরে উড়ে যারে, তার ব্যগ্র হাতে দিয়ে আয়।
শাইকু ১৩
বহু পথ হাঁটা হল, কত কথা কত গান
হল কত স্বপ্নের জাল বোনা
আজ দিন শুধু জানি মুখোমুখি বসিবার
আজ আর কোথাও যাব না।
শাইকু ১৪
চৈত্রের ধুলো-ওড়া পথে শরীরে ছন্দ তুলে কবিতার মতো
ওই তুমি হেঁটে আসছ--তোমার দু'চোখ শুধু আমাকেই খোঁজে
হঠাৎ ধুলোর ঝড়, চারদিক অন্ধকার, আমি চন্দ্রাহত
ধূলিধূসরিত পথে তোমার অবয়ব আর দেখছি না কেন যে!
শাইকু ১৫
হলুদ পাপড়ি সেজে নামছিল ঝাঁকঝাঁক রোদ্দুর
কী এক গ্রহণ এসে বিশ্ব আজ অমানিশাগামী
লক্ষ বছর হেঁটে পৌঁছেছি আজ এত দূর
গ্রহণ কাটিয়ে ঠিক আবার হাঁটব তুমি-আমি।
শাইকু ১৬
পৃথিবী থমকে গেছে, আমি কিন্তু তোমাকে ভুলিনি
আঁধারে হাঁটছি তবু ফিরে তাকাইনি নিশিডাকে
তুমি আছো তাই জানি জীবন সুন্দর প্রতিদিনই
মাধ্যাকর্ষণের মতো টেনে রেখেছ আমাকে।
শাইকু ১৭
পৃথিবী চলেছে খর সময়ের পথ ধরে একা একা
থমকানো এই মানবজীবনে প্রেমের কি ঘটে চ্যুতি!
এটুকু বুঝেছি সাজানো বিশ্বে যাই থাক বিধিলেখা
জীবনের শেষ মুহূর্ত তক থাকে প্রেম-অনুভূতি।
শাইকু ১৮
ওই দূরে দেখতে পাচ্ছি
ত্রিকালদর্শী বটের ঝুরি ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছ একা
আন্দাজ করতে পারছি তোমার চোখের ইশারা
চৈত্রের মাঝামাঝি তবু পথের দুপাশে এখনও পলাশ
কৃষ্ণচূড়ারাও এখন ফুটি ফুটি
আমার তো আর অপেক্ষা করার জো নেই
পথের সমস্ত কাঁটা দুহাতে সরিয়ে
তোমার কাছে পৌঁছেই যাব ঠিক।
শাইকু ১৯
মহাকাল এসে লিখে যাচ্ছে রোজ কত বৃত্তান্ত ঘটে
কালশিটে পড়ে মানুষের মুখে ডুবে যায় হতাশায়
ও মানুষ, তুমি ঘুরে দাঁড়াবেই আসন্ন সংকটে
মানব অমৃতপুত্র, তাকে কি কখনও বেঁধে রাখা যায়!
শাইকু ২০
নোয়ার নাওয়ের মধ্যে একে একে ঢুকে গেছি সব
বাইরে প্রলয়ে আজ সারা বিশ্ব অসহায় পোড়ে
প্রলয় তো থেমে যাবে অদূর দিবসে নিশ্চিত
নাও থেকে পুনর্বার বেরিয়ে আসব জোড়ে জোড়ে।
শাইকু ২১
একটু একটু করে ভরে উঠছিল ঘোর অনিয়ম
ধরিত্রীর বুকের উপর চেপে বসছিল পাষাণভার
ক্ষতবিক্ষত হচ্ছিল আকাশের গায়ের চামড়া
শ্বাস নিতে পারছিল না বলে
এবার পাশ ফিরে শুচ্ছে পৃথিবী
একটু তো টালমাটাল হবেই সবকিছু
এবার দেখবেন একটু একটু করে কেটে যাবে সব দুর্যোগ।
শাইকু ২২
একান্ত চিত্তে যখন মগ্ন থাকি সৃষ্টির ভিতর
নিজেকে খুঁড়তে থাকি, নিরন্তর আবিষ্কার করি
আমার গভীরে থাকা অন্য এক অচেনা আমিকে
বুঝি তুমি পাশে আছো সর্বক্ষণ নিঃশব্দ পরি।
শাইকু ২৩
মেল ট্রেন চলে এল মধ্যরাতে স্টেশন দাপিয়ে
তুমি নামো ধীর পায়ে, নিঃসাড়ে বাজে শঙ্খধ্বনি
ট্রেন ছেড়ে চলে যায় প্লাটফর্মে অন্ধকার রেখে
দুজনে হাঁটতে থাকি বরাবর নৈঃশব্দ্য-সরণি।
শাইকু ২৪
ভোরের আলোর তুলি পুবাকাশে অন্ধকার মোছে
ঘুমিয়ে রয়েছ তুমি, কপালে উড়ছে চূর্ণ চুল
ভোরঘুম ভেঙে দিতে ছুঁয়ে যাচ্ছে রৌদ্রকণাগুলি
জানি ঘুম ভাঙবে না না-ছুঁলে আমার আঙ্গুল।
শাইকু ২৫
পুবাকাশে ঝুলে আছে একখণ্ড খণ্ড ত মেঘ
দেখছ উদাস হয়ে সব কাজ রেখে মুলতবি
সে-দৃশ্যে মুগ্ধ আমি--তুলিটায় রং নেই তবু
ক্যানভাসে এঁকে যাচ্ছি তোমার এক বিমূর্ত ছবি।
শাইকু ২৬
গভীর সমুদ্রে যেতে ভাসিয়ে দিয়েছি যেই নাও
উঠে আসে শূন্য ঝিনুক, মুক্তো নেই একটাও
সফেন সমুদ্র ফেলে যেই না ফিরেছি বালুতটে
শাইকু ২৭
তোমাকে দিয়েছি কত ভালোবাসা, গোপন অক্ষর
নিভৃতে ভরেছি কত বিরল ছন্দের কারুকাজে
নিবিড় ভাবনে দিই অপার্থিব, গূঢ় অনুভব
তাই তো তোমাকে দেখি প্রতিদিন কবিতার সাজে।
শাইকু ২৮
যা কিছু বলতে চাই, কিছু বলি, কিছু থাকে
অবশ্য না-বলা
না-বলা অক্ষরগুলি পরি হয়ে ঘিরে থাকে
তোমার চারপাশ
তুমি যদি কোনও দিন নির্জনে হেঁটে যাও
একা, আলাভোলা
অবশ্য শুনতে পাবে বিন্দু বিন্দু জমে ওঠা
অজস্র ফিসফাস।
শাইকু ২৯
কোথায় রয়েছ তুমি, কোন অন্তরিক্ষে
মেঘের ভেলায় চড়ে খুঁজে খুঁজে মরি
কোনও খানে নেই তবু আছো দৃশ্যমান
অনন্ত বিরাজমান এক নীলাম্বরী।
শাইকু ৩০
সেন্টার টেবিলে রাখা দু কাপ চায়ের লিকার
দুজনে দুদিকে বসে টুকটাক কথোপকথন
দুজনেই একসঙ্গে তুলে নিল হৃদয়ের তাপ
চুমুকে চুমুকে স্পর্শ করে একে অপরের মন।
শাইকু ৩১
ঝড়সমুদ্রের পথে হারিয়ে ফেলেছি কম্পাস
ধ্রুবনক্ষত্রও আজ পুরোপুরি ঢাকা চোরামেঘে
মানচিত্রও দিচ্ছে না স্বস্তির কোনো অবকাশ
তবু তুমি সঙ্গে বলে একটুও নেই উদবেগে।
শাইকু ৩২
কতদিন দূরে দূরে আছো, দেখা নেই, শুধু প্রতিদিন
বার্তাবাহকের ঠোঁট রেখে যায় খামবন্ধ চিঠি
তক্ষুনি খাম খুলে পড়ে দেখি সংবিৎবিহীন
প্রতিটি অক্ষর ফুঁড়ে তোমার হাসিটি মিটিমিটি।
শাইকু ৩৩
তোমার সঙ্গে দেখা হল কত-কত দিন পর
কিছু তো উপহার দিতে হয়, আমি কিন্তু কিছুই আনিনি
তুমি কি ভাববে বলো, আমি যে নিতান্ত নিঃস্ব
কণ্ঠে আছে শুধু গান--ছয় রাগ ছত্রিশ রাগিণী।
শাইকু ৩৪
অক্ষরের মতো ফুটে আছে পরিপার্শ্বে সুরভিত ফুল
অক্ষরসমূহ নিয়ে লিখে যাই তোমার উদ্দেশে
অন্তহীন অজস্র পঙক্তি পদাবলী সমতুল
যদি হাতে পাও দেখো সুগন্ধ বিলোবে নিঃশেষে।
শাইকু ৩৫
চাঁদ যেই মুছে যায় চুপিচুপি নিকষ আঁধারে
অনন্ত ভ্রমণে যাই একা একা বোধির ভিতর
দেখি তুমি ফুটে আছো খণ্ড খণ্ড মহাসিন্ধুপারে
একত্র করেছি যেই পূর্ণ হয়ে ভরো চরাচর।
শাইকু ৩৬
তুমি কত হাত নাড়ো, হাসি-হাসি মুখে চাও
সে ডাক তো ডাক নয়, আহ্বান
যেতে তো পারি না তাই অনুভবে ছুঁয়ে থাকি
তোমার চেতনাবিন্দু আপ্রাণ।
শাইকু ৩৭
সব নেই তবু কিছু তো আছে, কিছু থাকলেই জানি
বানিয়ে ফেলব স্বপ্নসৌধ শুধু যদি পাশে থাকো
তা হলেই আমি রাজরাজেশ্বর --উঁচিয়ে কলমখানি
লিখে যাব সব শ্রেষ্ঠ লেখাটি সুবিপুল উচ্ছ্বাসে।
শাইকু ৩৮
তোমাকে ঘিরেই তো প্রতিদিন আমার হৃদয়ে উৎসব
তোমার হাসির উপহারে ভরে ওঠে সুগন্ধে রুমাল
তোমার উপস্থিতি তাই নৈঃশব্দ্যে এত কলরব
তোমাকে গড়েই তো আমাকে পূর্ণ করেছে মহাকাল।
শাইকু ৩৯
অক্ষরে অক্ষরে মুসাবিদা করি এক দীর্ঘ লিপি
প্রতিটি অক্ষরে ভরি জন্মলালিত অনুরাগ
সেই লিপি ক্রমে আবিষ্কার করে তোমার পৃথিবী
অনুরাগ রেখে যায় চেতনা- প্রবাহে অক্ষরের দাগ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন