লেবেল

বৃহস্পতিবার, ২ সেপ্টেম্বর, ২০২১

ধারাবাহিক রহস্য উপন্যাস (পর্ব-৪)।। আংটী রহস্যের নেপথ্যে — অনন্যা দাশ।। Ankurisha ।। E.Magazine ।। Bengali poem in literature ।।

 



ধারাবাহিক রহস্য উপন্যাস (পর্ব-৪)


আংটী রহস্যের নেপথ্যে

অনন্যা দাশ


গাড়ির সামনের আয়নাটার দিকে চিন্তিত মুখে তাকাল হ্যারি। নাহ, কালো গাড়িটা এখনও ওর পিছনে আসছে। এদিকে গাড়িতে প্যাসেঞ্জার রয়েছে তাই কিছু করতেও পারছে না সে। ঘন্টাখানেক হল কালো গাড়িটা পিছনে লেগেছে ওর। ভারি বিরক্তিকর!বারবার পিছনে দেখার জন্যে প্যাসেঞ্জার ঘাবড়ে যায়নি তো? হ্যারি আড়চোখে দেখে নিল না, লোকটা নিজের মোবাইল নিয়েই ব্যস্ত। হ্যারি মনে মনে ঠিক করল প্যাসেঞ্জার নেমে গেলে পিছনের বাছাধনকে একটু মজা দেখাবে। এমনি এমনি কি আর সে নিউ ইয়র্কের ট্যাক্সি ড্রাইভার হয়েছে! তাতে যদি পুলিশ পিছনে পড়ে তো ভালই, তখন পুলিশকে বলা যাবে যে পিছনের গাড়িটা ওকে ফলো করছে অনেকক্ষণ ধরে। আর মিনিট কুড়ি পরেই প্যাসেনজার নেমে গেল। ও দাঁড়িয়েছে বলে কালো গাড়িটাও নিরাপদ দুরত্বে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ভাড়া নেওয়া মিটে যেতে হ্যারি মনে মনে বলল, “এইবার দেখ বাছাধন বলিউডের ট্যাক্সিওয়ালারা কী ভাবে ট্যাক্সি চালায়!”বলে সে সাঁই করে পাশের একটা সরু গলিতে ঢুকে গেল। কালো গাড়িও ঢুকল ওর পিছন পিছন। তারপর ওয়ানওয়ে রাস্তায় উল্টো দিক দিয়ে ঢুকে, এটা সেটা অনেক কিছু করে লেজটাকে ছাড়াতে চেষ্টা করল হ্যারি কিন্তু কোন লাভ হল না। জোঁকের মতন আটকে রয়েছে ব্যাটা, ছাড়ছেই না!  একটা ট্রাফিক সিগনালে কিছুক্ষণ হলুদে জোর করে দাঁড়িয়ে থেকে তারপর ঝাঁ করে এগিয়ে গেল হ্যারি। কালো গাড়ি যখন যেতে গেল তখন সিগনালটা লাল হয়ে গেছে। তাও সে হ্যারির পিছু নিল। ব্যস আর যাবে কোথায়! পোঁ, পোঁ করে শব্দ করে  একটা পুলিশের গাড়ি এসে তাকে আটকালো! সেটাই চাইছিল হ্যারি!

‘হুঁ, হুঁ, বাবা! আমি নিউ ইয়র্কে ট্যাক্সি চালাই! আমার পিছু নেওয়ার চেষ্টা করলে কপালে দুঃখ আছে!’ হ্যারি মনে মনে হাসল।  ট্যাক্সিটাকে পার্ক করে হ্যারি ফোন লাগাল, “লেজটাকে আজকে যা ঘোরান ঘুরিয়েছি না, জন্মে ভুলবে না। আর আমার পিছনে আসার সাহস করবে বলে মনে হয় না!”



প্লেস্যান্ট মেডোজের সাদা বাড়িটার সামনে সবুজ ঘাসের লন। সুন্দর ছিমছাম বাগানে বসন্তের অনেক রকমের ফুল ফুটে রয়েছে। রঙিন ফুলে প্রজাপতিরা খেলে বেড়াচ্ছে। বাইরের রোদে বসে মন দিয়ে দাবা খেলছেন দুই বৃদ্ধ। 

রিসেপশান এলাকায় গিয়ে ডেনির ছবিটা দেখাতে এমি বলে মহিলা বেশ উত্তেজিত হয়ে বললেন, “কী হয়েছে বলুন তো ডেনির? এতদিন কামাই তো ও কোনদিন করে না! আমার এখানে কুড়ি বছর হল, এই পুরো সময় আমি ওকে কুড়িদিনও ছুটি নিতে দেখিনি! আর না বলে ছুটি নেওয়া তো কোনদিন না। শরীর খারাপ হলে এক-দুদিন ছুটি নিতে হয় ঠিকই কারণ এখানকার বাসিন্দাদের লেগে গেলে মুশকিল হবে কিন্তু সব সময় ফোন করে জানিয়ে দেয়। এবারে অদ্ভুত ব্যাপার! আমি ফোন করছি তাও ধরছে না! এদিকে এখানে ওর বেশ কিছু ভাল বন্ধুত্বের সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেছে। সবাই জিগ্যেস করছে ডেনি কোথায়, ডেনি কোথায়! আমরা কিছুই বলতে পারছি না!”মামা বললেন, “হ্যাঁ, সেই নিয়েই কথা বলতে এসেছি আমরা। ওর দিদি টেসা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে বলেছে ডেনি তারও ফোন ধরছে না তাই সে বেশ চিন্তিত। আমরা একটা ক্লু পেয়েছি কিন্তু সেটা কী ভাবে ডেনির সঙ্গে জড়িত সেটাই বুঝতে পারছি না। ডেনির চশমাটা আমরা সেন্টারফিল্ড গোরস্থানের কাছ থেকে পেয়েছি। এখানের কোন বাসিন্দাকে ওখানে সমাধি দেওয়া হয়েছে কী? এই ধরুন কিছুদিন আগেই যিনি মারা গেলেন, মিস্টার টাইক্স বোধহয় ওনার নাম।”   

এমি শুনে বলল, “না, না, মিস্টার টাইক্স তো চেম্বার্সবার্গের বাসিন্দা ছিলেন। ওনার স্ত্রীর পাশে ওনাকে শোওয়ানো হয়েছে, উনি নিজেই সেই রকম ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন, ওনার তেমন কেউ নেই বলে। আমি আমাদের রেকর্ডস দেখছি তবে সেন্টারফিল্ড গোরস্থানে এখানকার কাউকে ইদানীং নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বলে তো মনে পড়ছে না।”বলে উনি একটা খাতা উলটে পালটে দেখে বললেন, “না, সেরকম তো কাউকে দেখছি না।”মামা এবার জিগ্যেস করলেন, “আচ্ছা, মিস্টার টাইক্সের মৃত্যুতে ডেনি কী খুব দুঃখী হয়ে পড়েছিল?” 

এমি একটু ভেবে নিয়ে বলল, “হ্যাঁ, ভীষণ বেশি। আমরা তাতে একটু আশ্চর্যই হয়েছিলাম কারণ ওনার বয়স ছিল ৯৪ বছর। নানা রকম অসুখে ভুগছিলেন। উনি নিজেও আর বাঁচতে চাইছিলেন না তেমন। তাই ডেনির অতটা ভেঙ্গে পড়াটা একটু অস্বাভাবিকই মনে হয়েছিল আমাদের। আগে কখনও ও ওই রকম হয়নি। তবে ওরা তো ভাল বন্ধু হয়ে পড়েছিল হয়তো সেই জন্যে...” 

“কিছুদিন আগে অন্য কেউ কী মারা গিয়েছিলেন যার সঙ্গে ডেনির বন্ধুত্ব ছিল?” 

“হ্যাঁ, মার্গারেট ওয়েস্টউড। ম্যাগি বলে ডাকত সবাই ওনাকে। ওনারও বয়স হয়েছিল ৯১ বছর। তবে উনি বেশ শক্ত-সামর্থ ছিলেন ওই বয়সেও। উনিও মিস্টার টাইলারের মতন ঘুমের মধ্যেই মারা যান। সকালে আমরা দেখি উনি মৃত। কিন্তু ওনার দেহ তো পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল তাই গোরস্থানের কোন ব্যাপার নেই।”অখিলবাবুর জলতেষ্টা পেয়েছিল তাই মহিলাকে জিগ্যেস করে জলের সন্ধানে গেলেন তিনি, জিকোও ওনার সঙ্গে গেল। কিছুক্ষণ বাদে ফিরে এসে ফিসফিস করে মামাকে বলল, “মামা, ডক্টর বোম্যানকে দেখলাম মনে হল এইমাত্র। তুমি ওনাকে জিগ্যেস করবে একবার?”  

অখিলবাবু বললেন, “হ্যাঁ। আপনিই জিগ্যেস করুন। আমার অ্যাক্সেন্ট তো ওরা বুঝতে পারে না!”মামা বললেন, “আচ্ছা, একটা কথা বলুন, ডক্টর স্যানফোর্ড বোম্যান কী এখানে আসেন?” 

মহিলা এক গাল হেসে বললেন, “আসেন মানে? ডেনিকে যেমন সবাই ভালবাসে ওনাকেও সেই রকমই ভালবাসে। সবাই ওনার পথ চেয়ে থাকে। একেবারে দেবতুল্য লোক। ওনার কোন এক প্রতিবেশী এখানে ছিলেন একসময়। কিছুদিন এখানে থেকে উনি মারা যান। উনি বেঁচে থাকতে ডক্টর বোম্যান আসতেন ওনাকে দেখতে। তারপর উনি দেখেন যে আমাদের এখানে যারা থাকে তাদের অনেকেরই পরিবারবর্গ কেউ নেই। উনি তাই ওদের সঙ্গে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে যান। অনেক সময় সবার জন্যে খাবার টাবারও নিয়ে আসেন।”   

“ও, আমি তো ভেবেছিলাম উনি বাচ্চাদের ডাক্তার!”

“হ্যাঁ, তা তো বটেই! উনি এখানে তো ডাক্তার হিসেবে আসেন না। এমনি বন্ধু হিসেবে আসেন। এক বৃদ্ধা আছেন মিসেস নেলসন। ওনার স্বামী আর ছেলে দুজনেই যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছে তাই উনি একেবারে একা। এই কিছুদিন আগে ওনার জন্মদিনে কেক নিয়ে এসেছিলেন ডক্টর বোম্যান। খুব ভাল মানুষ। অথচ ওনার এই রূপটা আমরা ছাড়া আর কেউ জানতে পারে না। উনি নিজের সম্পর্কে কিছু বলতে একদম পছন্দ করেন না। এত ব্যস্ত মানুষ, কত নামকরা সার্জেন তার মধ্যেও সময় করে এখানে আসেন সেটাই আমাদের কাছে পরম সৌভাগ্যের ব্যাপার।”

ফিরে যাওয়ার সময় অখিলবাবু বললান, “কী সুন্দর শান্ত সৌম্য জায়গা! দেখে মনেই হয় না বৃদ্ধাশ্রম!”

মামা গম্ভীর মুখে বললেন, “এখানে একাকীত্বটাই প্রধান সমস্যা, অন্য কিছু নয়!”   অখিলবাবু তখন চুপ করে গেলেন বটে কিন্তু একটু পরেই আবার বলতে শুরু করলেন, “আচ্ছা ওই রকম দেবতার মতন লোককে নিয়ে আপনারা টানাটানি করছেন কেন বলুন তো? একটা বাজে কথাও কেউ বলেনি ওনাকে নিয়ে!”

“হুঁ, কিন্তু ওনার নামটা সব কিছুতে কেমন জানি জড়িয়ে পড়ছে, তাই না? এখানেও উনি রয়েছেন! সব থেকে বড় সমস্যা আংটিটা। ওই আংটির জন্যে হ্যারিকে কেউ বা কারা জ্বালাচ্ছে। ওর বাড়িতে ঢুকেছিল, ওর গাড়ির পিছনে ধাওয়া করছিল। উনি যে আংটিটা হ্যারির গাড়িতে ফেলে এসেছিলেন ভুলে সেটা মেনে নিতে ওনার এত সমস্যা হচ্ছে কেন?”

মামার কথা শুনে অখিলবাবু মাথা চুলকে এমন ভাবে বললেন, “সেটাই তো মিলিয়ান ডলারের প্রশ্ন!” যে জিকো আর কেকা হেসে গড়াগড়ি খেতে লাগল।



চলবে....

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন