।। প্রতিদিন বিভাগ।।
।। জুন সংখ্যা।।
বিষয় - গল্প ( ৪০০ শব্দের মধ্যে) —১২
ঝড়
অজিত দেবনাথ
রাস্তার ধারে বসন্ত প্রামাণিকের সেই পুরনো সেলুন যেন শহরের এক প্রান্তে নির্জনে পড়ে থাকা অস্পষ্ট পথবাতি। আলো আছে, কিন্তু দৃষ্টির স্বচ্ছতা নেই। ছোট্ট এক খুপরি, সামনের দিকে ঝুঁকে-পড়া টিনের ছাউনি, আর দেয়ালে কয়েকজন অভিনেতার অস্পষ্ট ছবি— দেব, অমিতাভ বচ্চন, আর এক পাশে রজনীকান্ত। ফিকে হয়ে যাওয়া পোস্টারগুলোর মধ্যেও ছিল এক অদ্ভুত আভিজাত্য, যেন তারা বসন্তের কাঁচির কারুকার্যকে নীরবে অভিনন্দন জানায়।
উপরে হাতে আঁকা সাইনবোর্ডে লেখা, “মডার্ন হেয়ার ড্রেসার”। যদিও তাতে আধুনিকতার চেয়ে বেশি ছিল স্মৃতি ও ভালোবাসার নিবিড় ছোঁয়া । এই দোকানটাই ছিল বসন্তের একমাত্র ভরসা।এর থেকে যা উপার্জন হতো তাই দিয়ে সে কোনোরকমে সংসার চালাত।
স্ত্রী স্নিগ্ধা চলে যাওয়ার পর, একমাত্র ছেলে শৌনককে বড় করে তোলার সমস্ত দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিল। একটা পুরোনো আয়না, ধারালো কাঁচি, আর একটা ছোট পিঁড়ি—এই ছিল তার একমাত্র সম্বল।
প্রতিদিন গড়ে দশজন খদ্দের। আর বসন্তের মুখে ছিল সেই ঢেউ-খেলানো হাসি,
“কেমন ছাঁট দেবো, বাবু? আধুনিক না ক্লাসিক?”
এই সহজ প্রশ্নের মধ্যেই লুকিয়ে থাকতো তার অনাবিল আত্মপ্রত্যয় ।
কিন্তু শহরের পরিবর্তন কেবল দালানকোঠায় সীমাবদ্ধ থাকে না; তা মানুষের জীবনকে অনেক সময় নিঃশেষিত করে দেয়।
সেলুনের পেছনে হঠাৎ একদিন মাপজোক শুরু হল। তারপর ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে আকাশছোঁয়া আবাসন। কাঁচের দেয়াল, নিরাপত্তারক্ষী, এসি গাড়ি আর আধুনিকতার অদৃশ্য দেয়াল। বসন্তের কাঠের দোকানটি তাদের চোখে হয়ে উঠল “অবাঞ্ছিত দৃশ্যদূষণ”।
কিছুদিনের মধ্যেই মিউনিসিপ্যালিটির গাড়ি এল, ঘোষণা করল, “অবৈধ নির্মাণ, ভেঙে ফেলতে হবে।”
পঁচিশ বছরের আত্মনির্মিত ঘরটা আচমকাই আইনবিরুদ্ধ হয়ে উঠল। কোনো ক্ষতিপূরণ নেই, বিকল্প কোনো ব্যবস্থা নেই । শুধু আদেশ, “ভেঙে ফেলো”।
দোকান ভাঙার দিন বসন্ত চোখের জল ফেলেনি। কেবল মেঝের উপর পড়ে থাকা চুলগুলোর দিকে তাকিয়ে ছিল অনেকক্ষণ। তারপর নিঃশব্দে উঠে দাঁড়ালো।আকাশের দিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবল। তিন চার দিন পর ফুটপাতে একটা ত্রিপল টানিয়ে, চারদিকে ইট সাজিয়ে, একটা ছোট আয়না ঝুলিয়ে অস্থায়ী ঘর তৈরি করল।
এইবার সমস্ত আকাশটাই যেন তার মাথার উপর এসে দাঁড়ালো। নীল আকাশ। নড়বড়ে চেয়ার। কুচিকুচি পাথর, পিঁড়ির নিচে ইট।
তবুও, হাতে কাঁচি ধরলে সে যেন নিজের ছন্দে ফিরে আসে।
তারপর ঘনিয়ে এল সেই অভিশপ্ত সন্ধ্যা যা এক লহমায় জীবনকে পথে বসিয়ে দিল।
নিমেষে চারদিক কালো হয়ে এল। ঝড় আসার পূর্বসন্ধ্যার হাওয়া যেন থরথর করে কাঁপতে লাগল। বসন্ত তখনও এক বৃদ্ধ খদ্দেরের মাথা ছাঁটছিল। প্রথমে উড়ে গেল তার ছাতা, তারপর হঠাৎ এক প্রবল ঝাপটা—ত্রিপল ছিঁড়ে উড়ে গেল গাছের ডালে, আয়নাটা ভেঙে চুরমার হয়ে গেল , পিঁড়িটা ছিটকে পড়ল পাশের ড্রেনের জলে।
ঝড় থামলে শহর আবার ধীরে ধীরে নিজের ছন্দে ফিরে আসে। কিন্তু বসন্ত ফিরতে পারে না। সে নির্বিকার ভাবে বসে থাকে। বসে থাকে ভাঙা আয়নার সামনে, কিন্তু নিজের মুখে কোনো প্রতিবিম্ব খুঁজে পায় না।সারারাত এভাবে রাস্তায় পড়ে থাকে। ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই ছেলে এসে বাবার সামনে দাঁড়াল,
“চলো বাবা, কিছু নতুন করি। একটা ছোট্ট খাবারের দোকান, ঠেলাগাড়ির উপর।এইভাবে আর নয়।”
বসন্ত কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর ছেলের চোখের দিকে মাথা তুলে তাকাল।
সেই চোখে ছিল আলোর শিখা, যায় স্পর্শে পুরোনো বসন্ত প্রামাণিক আবার একবার জেগে ওঠে।
হ্যাঁ, একটা ঝড় সবকিছু ভেঙে দিতে পারে। সে উপলব্ধি করল, যেখানে চুল কাটা হয়, সেখানেই আবার নতুন চুল গজায়। জীবনও কখনো কখনো যেন নতুন করে গড়ে ওঠে। আবার চলতে শুরু করে। এবার না হয় ঠেলাগাড়ির উপরেই জীবনটা শুরু হোক।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন