পাবলো নেরুদার জন্মদিনে শ্রদ্ধার্ঘ্য
-বিমল মণ্ডল
পাবলো নেরুদার প্রকৃত নাম নেফ্তালি রিকার্দো রেইয়েস বাসওয়ালতো। ১৯০৪ সালের ১২ই জুলাই তাঁর জন্ম চিলির পাররাল শহরে। তাঁর পিতা ছিলেন রেলের কর্মচারী, মাতা স্কুল শিক্ষিকা। নেরুদার জন্মের অল্প কিছু পরেই তাঁর মা মারা যান। এর কয়েকবছর পর তাঁর বাবা চাকরিসূত্রে বদলি হয়ে টেমুকো শহরে আসেন এবং সেখানে ত্রিনিদাদ কান্দিয়া ভালভার্দেকে বিয়ে করেন। সেখানে তাঁর শৈশব এবং যৌবনের অনেকটা সময় অতিবাহিত হয়েছে। নেরুদার সঙ্গে সেখানে মেয়েদের স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা গ্যাব্রিয়েলা মিস্ত্রালের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটে। মাত্র ১৩ বছর বয়সে প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয় "লা মানানা " দৈনিক পত্রিকায়।
১৯২০ সালে পাবলো নেরুদা নামাঙ্কিত তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয় "সেলভা অস্ত্রাল" সাহিত্য পত্রিকায়। চেক কবি জান ১৮৩৪ সাল থেকে ১৮৯১ পর্যন্ত নেরুদার নামের পদবিটি পাবলো গ্রহণ করেন। ১৯২৩ সালে প্রথম তাঁর লেখা প্রথম কবিতা সংকলন প্রকাশিত হয়। ১৯২৪ সালে প্রেমের কবিতাগুচ্ছ এবং" কুড়িটি প্রেমের কবিতা একটি হতাশার"।
কবিতা লেখার পাশাপাশি নেরুদা ফরাসি ভাষা ও শিক্ষক - শিক্ষণ পদ্ধতি নিয়ে সান্তিয়াগো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। ১৯২৭সাল থেকে ১৯৩৫ সাল পর্যন্ত চিলির সরকার তাঁকে বহুদেশে সাম্মানিক কনসাল হিসেবে নিযুক্ত করেন। তখন তিনি "মাটির আবাসন " নামে একটা কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করেন। ১৯৩২ সালে নেরুদা দেশে ফিরে আসেন। তিনি দেশে ফিরে এলেও বয়ঃসন্ধি বা যৌবনের দুরন্ত অনুভবের জগৎকে আর নিজের মধ্যে খুঁজে পান না।
স্পেনের গৃহযুদ্দ এবং পরিচিত বন্ধু ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকার খুন হয়ে যাওয়ার ঘটনা কবি সত্ত্বাকে তুমুলভাবে নাড়া দিয়েছিলো। তাই তিনি রাজনৈতিক ভাবনা নিয়ে "আমার হৃদয়ে স্পেন' কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৯ ৩৭ সালে ফ্রান্সে।
১৯৪৩ সালে নেরুদা চিলিতে ফিরে আসেন। ১৯৪৫ সালে চিলি প্রজাতন্ত্রের সেনেটর নির্বাচিত হন। ১৯৪৭ সালে প্রকাশ্যে ধর্মঘটী খনি শ্রমিকদের ওপর সরকারের দমননীতির তীব্র সমালোচনা করেন। তার ফলে তাঁকে ১৯৪৯ সালে দেশ ছেড়ে চলে যেতে হয়। ১৯৪৯ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ঘুরে বেড়ান তিনি। সেই অভিজ্ঞতা নিয়ে ১৯৫৮ সালে " ভবঘুরে " নামে একটা কাব্যগ্রন্থ লেখেন। এরপরেই কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। যেমন-
১.প্রেমের একশো সনেট
২.চিলির পাথর
৩.ইসলা নিগ্রার স্মৃতিকথা (পাঁচ খণ্ডে) ইত্যাদি
নেরুদার কবিতায় রোমান্টিক সুররিয়ালিস্টিক সুর খোঁজে পাওয়া যায়। যেমন "ঘুরে বেড়ানো " কবিতায় তিনি লিখেছেন - 'আমি ক্লান্ত হয়ে গেছি একটি মানুষ হিসেবে '।রূঢ় বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে তিনি কবিতার গায়ে রোমান্টিকতা ও পরাবাস্তবের প্রতীকী ব্যঞ্জনা কবিতার নতুন মাত্রা এনে দিয়েছেন।
প্রণাম
--------------------------------
পাবলো নেরুদা
-----------------
১৯৭১ সালে নেরুদা নোবেল পুরষ্কার পান।
১৯৭২ সালে নেরুদা লিখলেন 'চারটি ফরাসি কবিতা ' এবং 'নিষ্ফলা ভূগোল ' । নেরুদা মৃত্যুর অব্যবহিত আগে তাঁর নিজের জন্য একটা "এফিটাফ " রচনা করেন তা হলো-
আর আজ হারিয়ে যাওয়া সেইসব অরণ্যের গভীরে
উৎকর্ণ সে শত্রুর পদধ্বনি শোনে, সে পালায়
অন্যদের ছেড়ে নয়, নিজের কাছ থেকে
মানুষের সীমাহীন কথাবার্তা থেকে
সর্বদা যে কলস্বর আমাদের ঘিরে রেখেছে তার কাছ থেকে
এবং সর্বোপরি জীবনের সব অর্থ থেকে ।
১৯৭৩ সালে ১১ই সেপ্টেম্বর নৌবাহিনীর বিদ্রোহ, তারপরই সেনাবাহিনীর - রাষ্ট্রপতির বোমা বর্ষিত হল, সি. আই. এ - র ঘাতকদের হাতে অ্যালেন্দে খুন হলেন। তাঁর শেষকৃত্যের দিনে অসংগঠিত শোক মিছিল সুদীর্ঘ পথ পরিক্রমা করে। সেটাই ছিলো সি. আই. এ -র মদতপুষ্ট চিলির সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে প্রথম নিঃশব্দ প্রতিবাদ।
অপেক্ষার অদম্য অভিব্যক্তিতে -সময়ের সামনে চলাতেই তাই
ভাবনা স্থবিরতা ছেড়ে চলে জীবনের বাস্তবই এমন!
নেরুদার জীবন থেকে প্রেম ও সত্যির সেই অবয়ব কুড়িয়ে-
আজকের সময়ে আছে সেই বার্তা,অপেক্ষা,সময়েই তাই-
কোভিডের অতিমারীতেও নেরুদাকে শ্রদ্ধা জানাই !
সুতরাং তাঁর এই জন্মদিনে "এসো অপেক্ষা করি " কবিতায় কয়েকটি লাইন দিয়ে জানাই বিনম্র প্রণাম ও শ্রদ্ধার্ঘ্য -
'সেই দিন আর আছে যে দিন এখনও আসেনি
যে দিন উৎপাদনের প্রস্তুতি চলছে
যেমন রুটি বা কাঠের চেয়ার কিংবা ঔষধালয়
অথবা কারখানায় উৎপাদন হয়;'
"পাবলো নেরুদা"-এর জন্মদিনে তাঁর প্রতি আমার বিনম্র শ্রদ্ধা ও প্রণাম। 🙏
উত্তরমুছুন