লেবেল

শনিবার, ২২ জানুয়ারী, ২০২২

আজ ২৩শে জানুয়ারি ২০২২, নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর ১২৬তম জন্মদিবসে অঙ্কুরীশা-য় শ্রদ্ধার্ঘ্য। শ্রদ্ধা ও স্মরণে -তপন তরফদার।। Ankurisha।। E.Magazine।। Bengali poem in literature।।




গুরুদেবের সান্নিধ্যে নেতাজী

তপন  তরফদার    

 

           সমগ্র পূর্ব -এশিয়ারসমগ্র বিশ্বে বাংলার গর্ব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরনেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু এই দুজনের বয়সের ফারাক ৩৬ বৎসরের রবীন্দ্রনাথের জন্ম ১২৬৮ বঙ্গাব্দের ২৫শে বৈশাখ১৮৬১  খ্রিস্টাব্দের ৭ই মে। সুভাষ চন্দ্রের জন্মদিন তেইশে জানুয়ারি  ১৮৯৭ সালে। দুজনেই ভারতবাসীর তথা বাঙালির গৌরব। রবীন্দ্রনাথ সরাসরি রাজনীতিতে যোগদান না করলেও সর্বদা অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন, উচিত কথা বলতে কখনো পিছপা হননি। এমনকি মহাত্ম্যা গান্ধীকেও রেয়াত  করেননি। সুভাষ বসু দেশ মাতৃকাকে স্বাধীন করার জন্য জীবনের সমস্ত বৈভবকে হেলায় সরিয়ে রেখে জীবন উৎসর্গ করেছেন। রবীন্দ্রনাথ, সুভাষের সমর্থনে এগিয়ে এসেছেন, সমব্যথী হয়েছেন, প্রেরণা যুগিয়েছেন এবং আনন্দিত হয়ে গর্ব প্রকাশ করেছেন।

       “যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলরে” ওদিকে “ কদম কদম বাড়ায়ে যা খুশি কা গীত গায়ে  যা” ান দুটির মধ্যে  বেশ  আত্মিক মিল খুঁজে পাই  আমরা। ওই যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে আমাদেরকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রেরণা দেয়

        আমাদের স্মরণে রাখতে হবে ১৯২৪ সালে সুভাষচন্দ্র তাঁর কয়েক জন বন্ধুকে নিয়ে শান্তিনিকেতনে যান রবীন্দ্রনাথের থেকে স্বদেশ সেবার আশীর্বাদ পাওয়ার জন্য রবীন্দ্রনাথ আশীর্বাদ করে বলেন গ্রামে গ্রামে সংগঠন গড়ে  মানুষের সেবা করতে যথার্থ মর্মবাণী বুঝতে পারেন সুভাষচন্দ্র  

     আমরা দেখি কারারুদ্ধ অবস্থায় রবীন্দ্রনাথের বাণীতেই  প্রেরণা পেয়েছেন সুভাষচন্দ্র সংগ্রহ  করেছেন মননের শক্তি ১৯২৫সালের ১২ই আগষ্ট মান্দালয় জেল হতে সুভাষচন্দ্র, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে চিঠিতে লেখেন-“ দেশবন্ধুর অকাল মৃত্যুতে আমি বিষাদ গ্রস্ত। বদ্ধ দুয়ারের গরাদের মাঝে আছাড় খেয়ে হৃদয়টি ক্ষতবিক্ষত...বাইরের হতাশা শূন্যতা  এবং বাইরের দায়িত্ব এখন আর মন যেন চায় না এখানে না এলে বোধহয় বুঝতাম না যে সোনার বাংলাকে কত ভালোবাসি। সোনার  বাংলা তোমায় আমি ভালোবাসি। আমার মনে হয় রবিবাবু  কারারুদ্ধ অবস্থানের কল্পনা করেই  গানটি লিখেছিলেন আমরা অনুভব করতে পারি কারাগারের শত কষ্টেও দেশবন্ধুর মৃত্যু সংবাদের  মধ্যেও রবীন্দ্রনাথ তাঁর মনে বিচরণ করতপ্রেরণা  যোগাতো

         ১৯৩১সালের ৭ই এপ্রিল মেদিনীপুর জেলা শাসক পেডি এবং ২৭জুলাই আলিপুরের জেলা ও সেসন  জজ  মিস্টারগালিক বিপ্লবীদের গুলিতে নিহত হওয়ার বদলা নেয় ব্রিটিশ সরকার। বিপ্লবী বিমল দাশগুপ্ত অত্যাচারী জেলাশাসক পাডি সাহেবর  নিধনকারী সাব্যস্ত করে ষোলই সেপ্টেম্বর রাত্রিতে হিজলী জেলে নির্মমভাবে গুলি চালিয়ে  হত্যা এবং শতাধিক বিপ্লবীদের আহত করে। সুভাষচন্দ্র নিজে আসেন  খড়্গপুরে দেহগুলি নেওয়ার জন্য এবং মনুমেন্ট ময়দানে প্রতিবাদ সভার আয়োজন করেন গুলি চালানোর ঘটনায় বিশ্বকবি ক্ষুব্ধ তা  তাঁর কবিতায় বহিঃপ্রকাশ করেন অসুস্থতা সত্ত্বেও  কবিগুরু সুভাষচন্দ্রের অনুরোধে সভায় উপস্থিত হন বলেন, এত বড় জনসভায় যোগ দেয়া আমার শরীরের পক্ষে ক্ষতিকর। মনের পক্ষে ক্ষতিকর। কিন্তু ডাক  যখন পড়ল থাকতে পারলুম না।“

             ১৯৩৬ সালের ১১ই এপ্রিল বিভিন্ন শহরে রোমভিয়েনা, আয়ারল্যান্ড সহ জার্মান শহরবাসীর উচ্ছাসিত  সংবর্ধনা ও নেতা হিসেবে মান্যতাপেয়ে  ভারতের বোম্বাই ডকে ( বর্তমানে মুম্বাইজাহাজ ভেড়ার সঙ্গে সঙ্গেই গ্রেফতার করা হয় সুভাষকে। এই অন্যায় গ্রেফতারির বিরুদ্ধে  ১৯৩৬ সালের ১০ই মে  সারা ভারতবর্ষে সুভাষ দিবস হিসাবে আন্দোলন করা হয় সুভাষচন্দ্রর মুক্তির দাবিতে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে প্রশ্ন উঠল সুভাষচন্দ্র কে কেন দীর্ঘদিন ধরে বিনা বিচারে আটক রাখা হবে রবীন্দ্রনাথ  বললেন বিনা বিচারে যারা দন্ড ভোগ করছে অপরিমিত কাল ধরে তাদের মধ্যে দেশের যে বেদনা আছে তার চেয়ে অনেক বড় দেশের অসম্মান। বিচার পাওয়ার অধিকার সবার আছে। মনুষ্যত্বের সম্মান থেকে আমরা বঞ্চিত। কেন আমরা বিশ্বের গোচরে  নেই আমাদের কি কোনো মূল্য নেই। এই দেশ ব্যাপী অভিসম্পাতের আক্রমণ হতে যদি কোনদিন নিজেদেরকে  রক্ষা করতে পারি তাহলেই আমাদের প্রত্যেক অন্যায়ের প্রতিবাদ প্রতিধ্বনিত হবে দেশে-বিদেশে

           ১৯৩৯ সালের জানুয়ারি মাসে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনের আম্রকুঞ্জে কংগ্রেসের সভাপতি সবার প্রিয় সুভাষচন্দ্র কে সম্বর্ধনা জানান। কবি বলেন, “ কল্যাণীয় শ্রীমান সুভাষচন্দ্র স্বদেশের চিত্তে নতুন প্রাণ সঞ্চার করবার পুণ্যব্রত তুমি গ্রহণ করেছ। সেই কথা স্মরণ করে তোমার নামে তাসের দেশ নাটিকা উৎসর্গ করলাম আজ তরুণ বাংলা তথা ভারতের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক সুভাষচন্দ্র আজ র্নিভিক প্রাণে সংগ্রামের মন্ত্র দিতেছেন ১৯৩৯ সালেই কংগ্রেসের সভাপতি পদের জন্য যে জটিলতা দেখা যায় তা সমাধানের জন্য রবীন্দ্রনাথ গান্ধীজিকে লিখলেন -  প্রিয় মহাত্মাজী বিগত কংগ্রেস অধিবেশনে অশোভন জেদের বশবর্তি হয়ে কিছু রূঢ় প্রকৃতির মানুষ বাংলাকে গভীর ভাবে আঘাত দিয়েছে আপনার করুণা ভরা দুটি হাতের স্পর্শে সত্বর এই ক্ষতের উপশম করুন এবং ক্ষত যাতে মারাত্মক হয়ে না ওঠে তার প্রতিবিধান করুন গান্ধীজী চিঠি পেয়ে না ধরি মাছ না ছুঁই পানি নীতি গ্রহণ করেন। দোসরা এপ্রিল গান্ধী লিখলেন প্রিয় গুরুদেব আপনার স্নেহপূর্ণ পত্র পেয়েছি। .... সমস্যার সমাধান কঠিন আমি সুভাষ কে এ বিষয়ে যা কিছু বলবার বলেছি অচলাবস্থা দূর করবার জন্য অন্য পথ দেখছি না। চিঠি পাওয়ার পরও রবীন্দ্রনাথ গান্ধীজিকে টেলিগ্রাম পাঠান কিন্তু চাকা ঘুরল না, সুভাষচন্দ্র সভাপতির পদ পরিত্যাগ করলেন রবীন্দ্রনাথ মনে মনে দুঃখ পেলও  সুভাষচন্দ্রকে এই  অনুতাপের আঘাত থেকে রক্ষা করে শুভেচ্ছার অভিনন্দন জানিয়ে লিখলেন, “ অত্যন্ত বিরক্তিকর অবস্থার মধ্যে পড়িয়াও  তুমি যে ধৈর্য ও মর্যাদার পরিচয় দিয়েছো তাতেই তোমার নেতৃত্বের প্রতি আমার শ্রদ্ধা ও বিশ্বাসের উদ্রেক হয়েছে। আত্মসম্মান রক্ষার জন্য বাংলাকে এখনো সম্পূর্ণরূপে ভীরুতা ও ভদ্রতাবোধ অব্যাহত রাখিতে হইবে তাহা হইলে আপাতদৃষ্টিতে যাহা তোমার পরাজয় বলিয়া মনে হইতেছে তাহা চিরন্তন জয়ে পরিণত হইবে কংগ্রেসের সভাপতি পদের বিষয়টি রবীন্দ্রনাথ খুব গুরুত্ব সহকারে অনুধাবন করে ছিলেন। উনি পুরী থেকে ফিরে ১৯৩৯ সালের মে মাসে লিখলেন “সুভাষচন্দ্র বাঙালি আমি বাংলাদেশের হয়ে তোমাকে দেশনায়কের পদে বরণ করি তোমার রাষ্ট্রিক সাধনার আরাধনায তোমাকে দূর হতে দেখেছি সেই আলো-আঁধারের অস্পষ্ট কালে  তোমার সম্বন্ধে কঠিন সন্দেহ  জেগেছিল মনে তোমাকে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করতে দ্বিধা অনুভব করেছি কখনো কখনো দেখেছি তোমার ভ্রম, দুর্বলতা তা নিয়ে মন পীড়িত হয়েছে। আজ তুমি যে আলোকে প্রকাশিত তাকে সংশোধন আবিলতা আর নেই বাঙালির সম্মিলিত ইচ্ছা...তোমার ব্যক্তি স্বরুপকে আশ্রয় করে আর্বিভূত হোক সমগ্র দেশের  আত্ম স্বরূপ আমি জ্ঞানত  তোমাকে আমি  বাংলাদেশের রাষ্ট্রনেতা পদে বরণ করি।“

          কবিগুরুর ১৯৩৯ সালের আগস্ট মাসে সুভাষচন্দ্রের পরিকল্পিত মহাজাতির সদন এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন সুভাষচন্দ্র কবিকে সম্বর্ধনা  জানিয়ে বলেন, - “গুরুদেব আপনি শাশ্বত কন্ঠে আপনার সুপ্রতিষ্ঠিত বিশ্ব মানবতার  আশা-আকাঙ্ক্ষাকে রূপ দিয়েছেন। আপনি চিরকাল মৃত্যুঞ্জয়ী যৌবন শক্তির বাণী শুনিয়ে আসছেন। আপনি চিরকাল  শুধু   কাব্যের রচয়িতা নন আপনার জীবনের কাব্য এবং শিল্পকলা রূপ পরিগ্রহ করেছে আপনি শুধু ভারতবর্ষের কবি নন, আপনি বিশ্বকবি। আপনার পবিত্র করতলের দ্বারা মহাজাতি সদনের ভিত্তি স্থাপন হলো। যে সমগ্র কল্যাণ  প্রচেষ্টার   ফলে ব্যক্তি ও জাতি মুক্ত জীবনের আস্বাদ পাবে এবং ব্যক্তির ও জাতির সর্বাঙ্গীণ উন্নতি সাধিত হবে।  গৃহ  তাই জীবন কেন্দ্র হয়ে মহাজাতি সদন নাম সার্থক করে তুলুক এই আশীর্বাদ করুন ভারতকে স্বাধীন এবং মহাজাতির সাধনাকে সকল রকমের সাফল্যমন্ডিত ও জয়যুক্ত করে তুলি

       সুভাষচন্দ্র রবীন্দ্রনাথকে কতটা শ্রদ্ধা করতেনভালোবাসতেনভরসা রাখতেন তার আরো প্রমাণ, “ জনগণ মনো অধিনায়কো তে বিশ্বাস করে  বিদেশে ফৌজ স্থাপন করেও মান্যতা দেন জাতীয় সংগীতের

      রবীন্দ্রনাথ চিরতরে পৃথিবী ছেড়ে যান ১৯৪১ সালের ৭ই আগস্ট। ওই সনেই নেতাজির অন্তর্ধান। দুই  ভারত পূজারী, মানবতার পূজারীর একইসাথে ভারতের,বিশ্বচরাচরের মঙ্গলকামনায় রত থাকেন। রবীন্দ্রনাথ অমৃতধাম থেকে। নেতাজী  লোক চক্ষুর আড়ালে থেকে  ভারতের তথা মানবের মঙ্গল সাধনায়

     েতাজীকে নিয়ে বতর্মানের নেতারা প্রমাণ করতে ব্যস্ত তারা কত নেতাজী ভক্ত কিন্তু  সাধারণ মানুষের আকাঙ্ক্ষা নেতাজী প্রদর্শিত পথে সমাজের সবাই যেন সানন্দে ভারতবর্ষে সুখে শান্তিতে বসবাস করতে পারে


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন