রবিবাসরীয় বিভাগ-৩৭
আজকের গল্প
একটি অসোয়াস্তিজনক গল্প
বৈদ্যনাথ চক্রবর্তী
ক'দিন ধরে রাতে ঠিক ঘুম আসছিল না তৎপুরুষের। তৎপুরুষ কোনো সমাসের নাম ঠিকই, তবে এই নাম এই গল্পের নায়কের। এই নাম তাকে কেউ দেয়নি। সে নিজের নাম নিজেই দিয়েছে। তার মাতৃ-পিতৃদত্ত নাম রামচন্দ্র দাস। যখন তাকে মাতৃ-পিতৃহীন হতে হল, পৈতৃক ভিটেয় যখন সে সম্পূর্ণ একা, শুধু ভিটে-সম্বল তাকে পিতৃ-প্রদত্ত পয়সা কড়ি খাটিয়ে একটি ছোটখাটো ব্যবসায় নামতে হয়েছিল। তখন তার বয়স সবে একুশ। সেই ব্যবসা এখন অনেকটাই বেড়েছে। ইতিমধ্যে সে সংসারীও হয়েছে। এখন তার বয়স ছত্রিশ বছর। স্ত্রী আশা, ঊনত্রিশ, পুত্র গৌরাঙ্গ আট, আর, কন্যা চন্দনা পাঁচ। বাড়িঘরদোরও অনেকটাই ভালো হয়েছে আগের তুলনায়। এখন তার দোতলা বাড়ি, সুন্দর, সাজানো-গোছানো।
রামচন্দ্র একদিন শুনলো রাস্তায় একটা ধর্মীয় মিছিল যাচ্ছে। অংশগ্রহণকারীরা উচ্চস্বরে 'রামনাম কেবলম্' আওয়াজ তুলে চারিদিকে শোরগোল ফেলে দিয়েছে। তখনও সে কিছু ভাবেনি। আরেকদিন ভোররাতে ঘুমের মধ্যে শুনলো : 'রামনাম সৎ হ্যায়'---তখনও সে কিছু ভাবেনি। এবার যেদিন শুনলো 'জয় শ্রীরাম'---মিছিলকারীদের হাতে তরোয়াল ইত্যাদি নানা অস্ত্র, তখন সে নিজের নাম পাল্টে নেওয়াটাই উচিত কাজ হবে বলে মনে করল। অনেক চিন্তা-ভাবনা করে সে পদবি বর্জন করে কেবল 'তৎপুরুষ' নামটাই স্থির করলো। কেন এমন নাম ? এই পৃথিবীতে তার জন্ম, আরও সকলের মতোই, আকস্মিক। তাই, নির্দিষ্ট নামবাচক বিশেষ্য-ঘটিত নাম তার হতে পারে না। যুক্তি এই যে তার জন্ম তাঁর ইচ্ছায়, সেই 'তিনি', অর্থাৎ, 'তৎ'---তাঁরই সন্তান সে, এবং, সে একজন পুরুষ---তাই তার নাম হওয়া উচিত 'তৎপুরুষ'। স্ত্রী, পুত্র, কন্যার নামগুলিও সে পাল্টে যথাক্রমে কর্মধারা ('কর্মধারয়' থেকে), দ্বন্দ্ব ও দ্বিগু রাখতে চেয়েছিল ; কিন্তু, তারা কেউই এই নামবদল ও পদবি-বর্জনের প্রস্তাবে রাজি হয়নি। সে তখন নিজের নাম পাল্টানোই মনস্থ করলো---পরিবারের কারও কোনোরকম ওজর-আপত্তিতে কান দিল না। 'এফিডেবিট' করে ও সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দিয়ে সে সর্বত্র ঐ নামে পরিচিত হল।
তৎপুরুষেরা যে পল্লীতে বসবাস করত, সেখানে তথাকথিত ভদ্দরলোকেদের সব নানা কিসিমের জেল্লাদার বাড়ি ; কিন্তু, তার নিজের বাড়ির সামনেই ছিল এক মোদোমাতালের ছাপড়া ঘর, দরমার বেড়া দিয়ে ঘেরা, ভাঙাচোরা টালির ছাউনি। ঐ ঘরে নিত্যই একঘেঁয়ে অশান্তি। চিৎকার-হৈ চৈ-গোলমাল-গালাগালি-ভাঙচুরের বন্যা বয়ে যেত। বিশেষত, ঐ পরিবারের কর্তা রাঘব মান্না যখন চোলাই গিলে ঘরে ফিরে ওর বৌ খুল্লনার কাছে টাকা চেয়ে ও না পেয়ে তাকে রাম পেটান পেটাতো, আর, ফাটা বাসনের গলায় খুল্লনা মড়াকান্না কাঁদতে কাঁদতে রাঘবকে শাপশাপান্ত করত, তখন, তৎপুরুষ ভাবতো জগতে কী আর কোনো জায়গা নেই, যেখানে এই অসহনীয় পরিবারটি ঘর বানিয়ে চলে যেতে পারে ! সেটা ছিল তার অবাস্তব ভাবনা, কেননা, খুল্লনা বাড়ি-বাড়ি ঝি-গিরি করে পেট চালাতো, আর, ঐ পরিবারের অন্য সদস্যরা ঠ্যাঙের ওপর ঠ্যাং তুলে চারবেলা গণ্ডেপিণ্ডে গিলতো, আর, বাপ রাঘবের মতো ছেলে যাদবও চোলাই ধরে নিয়েছিল। চোলাই গিলে ঘরে ফিরে সেও গাঁক গাঁক করে চেঁচাতো। তৎপুরুষ আড়ালে চেহারায় দশাসই রাঘবের নাম দিয়েছিল 'গোদা', আর, তার বেকার ছেলে যাদবের নাম দিয়েছিল 'গোঁয়ার'। এই গোদা ও গোঁয়ার তৎপুরুষ ও তার পরিবারের সকলের রাতের ঘুম হারাম করে দিত, প্রায় নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা ছিল এটা।
এখন ঘটনা এই যে কী খেয়ালে খুল্লনা একটি লটারির টিকিট কেটেছিল। আর, লাগবি তো লাগ, সেই টিকিটে পাঁচ লাখ টাকা বেঁধে যাওয়ায় রাঘব আর যাদব তো মহা ফুর্তিতে মাছ-মাংস-বিরিয়ানি-সন্দেশ-রসগোল্লার বন্যা বইয়ে দিলো। আর, দামি বিলাইতি মদ ও কষা মাংস দিয়ে, পিকনিক চলতে লাগলো রোজ। টাকা ফুরিয়ে যায়-যায় অবস্থা দেখে খুল্লনা এবার বেপরোয়া খরচের রাশ টেনে ধরলো। এবার সে কড়া হল। সে ঘোষণা করে দিলো যে আর টালি-দরমার বেড়ার ঘরে সে থাকবে না। এবার পাকা দালানকোঠা চাই। গোদা-গোঁয়ারের এতদিনে চৈতন্যোদয় হল। তাই তো, সকলের পাকা বাড়ি, আর, ওরাই ভাঙা বাড়িতে থাকে। মিস্ত্রি-মজুর এল। দরাদরি করার পর চুক্তি হল যে সাড়ে চার লাখ টাকায় তারা বাড়ি বানিয়ে দেবে। মাস আষ্টেক সময় লাগবে, তার মধ্যেই বাড়ি হয়ে যাবে। ঘরভাড়া করে খুল্লনা-গোদা-গোঁয়ারেরা পাশের গলিতে চলে গেল। একটু একটু করে রোজই গোদাদের বাড়ি তৈরি হতে থাকলো। তৎপুরুষ রোজই লক্ষ্য রাখে কতটুকু এগোল ওদের বাড়ি বানানোর কাজ। বাড়ি হচ্ছে। আর গোলমাল নেই। পরম শান্তিতে তৎপুরুষের ঘুম হওয়ার কথা ; কিন্তু, এখানেই তার অসোয়াস্তি। কীসের অসোয়াস্তি ? এখন তার আর ঘুম আসে না। ঐ চিৎকার-হৈ চৈ-গোলমাল-গালাগালি-ভাঙচুর তো আর নেই। গোদা তাও মাঝে মধ্যে এসে বাড়ি কতটুকু এগোল, দেখে যায়, কিন্তু, গোঁয়ার আর আসে না। দুই বাপ-ব্যাটাই এখন সংসার ধর্মে মন দিয়েছে---শোনা গেল এরকমই। বাপ এক জায়গায় রাত পাহারার কাজ পেয়েছে। ছেলে লোকাল ট্রেনে হকারি শুরু করেছে। ওদের ঘরে নাকি এখন কোনো অশান্তি নেই। হৈ চৈ নেই বলে তৎপুরুষের চোখে আর ঘুম নেই। অনভ্যস্ত শান্তি আর তার সহ্য হচ্ছে না। সে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে কবে খুল্লনারা এসে ঐ নতুন বাড়িতে উঠবে, আর, আগের মতো একইরকম চিৎকার করে গালাগালি করতে করতে বাসনপত্র ভাঙচুর করবে। হয়ত সেই দিন তার চোখে শান্তির ঘুম নেমে আসবে।
তার ঘুমের অসুখের কথা শুনে ডাক্তারবাবু বললেন : আপনার এই আশা ফলবান হবে না। কারণ, ওরা এবার পাকা দালানকোঠার দৌলতে আর আগের মতো হৈ চৈ করবে না। ওরাও ভদ্দরলোক বনে যাবে।
মানুষের কিছুতেই শান্তি নেই।
উত্তরমুছুনশুরুটা দূর্দান্ত ছিল। মাঝখানে একটু হোঁচট খেলাম। শেষটা ভালোই হল। শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন রইলো।
উত্তরমুছুন