প্রেমের কবিতা - ৪৬
তপনজ্যোতি মাজি
বৃষ্টিলেখা ও দশ দিগন্ত
[ এক]
আকাশকে বর্ণময় প্রান্তর মনে হলো অপরাহ্ন বেলায়।
মনে হলো নিখোঁজ হওয়ার হাতছানি দিচ্ছে নীলবর্ন
ভাসমান পাহাড়। বাউন্ডুলে মেঘ পরেছে শ্বেত করবীর
মুকুট। বৃষ্টিরা আর ঋতুমতী নয় , কিছুটা খেয়ালী।
[ দুই ]
কিছু কিছু শব্দবন্ধ থেকে সন্ন্যাস নিয়েছে উচ্চারণ। কার
নাম ওষ্ঠের উঠোনে শালিকের মতো ঘুরে বেড়ায়? কার
নাম? তাকে কেন মনে হলো বর্ণকুসুম! তাকে কেন মনে
হলো বন্ধু আকাশ! তাকে কেন মনে হলো তপস্বিনী নদী,
দক্ষিণবাহিনী!
[ তিন ]
সে যখন কথা বলেছিল তখন শব্দরা ঘরে ফেরা হাঁস।
সরোবরের পর সরোবর পার হয়ে যেভাবে ফিরে আসে
শীতের বাতাস , সেভাবেই তার স্পর্শে শব্দরা হেমন্তের
সোনা রঙ ধান। শঙ্খ ধ্বনি। মগ্ন অধ্যয়ন । রাতের আকাশ
দেখা। কথা বলা পূর্বজন্মের দুঃখী মানুষের সঙ্গে সংগোপনে,
একা ।
[ চার ]
সে কি অধ্যায় শেষ করা কবিতার আলোচনা? কফি হাউসের
সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে সিগারেটের শেষ ধোঁয়া শূন্য বাতাসে।
সে কি নতুন কেনা বইয়ের প্রচ্ছদ? নাকি ফেরিঘাটে বৃষ্টি ভেজা
প্রেমিকার হাত হাতে নিতে স্রোত দেখা? সে কি কিছু ভাবতে না
পারার বন্ধ্যা সময়ের নিরুদ্দেশ অক্ষর?
[ পাঁচ ]
আবার বৃষ্টি এসেছে খেয়ালী ইচ্ছায়। মেঘে মেঘে যন্ত্র সংগীতের
ধ্বনি। রাস্তায় ছিল যারা ভিজেছে গাছের মতো । আশ্রয়হীন।
বিদ্যুৎ চলে গেছে দূরে নিরুদ্দেশে। এ সময় তার কথা মনে হলো।
জীবনের ভবিষ্য নির্ধারণ করে কে? ঈশ্বর না অন্য কোনও শক্তি!
অমিত বিক্রম কিন্তু শান্ত ও অগোচর। এই প্রশ্নের কোনও উত্তর
হলো না কোনদিন।
[ ছয় ]
অস্তিত্বে বিশ্বাসই কি আস্তিক্যবাদ ? পরম নাস্তিকও তো বস্তুবাদী।
তবুও বিভাজন রেখা স্পষ্ট করে ধর্মবাদীরা। ধর্ম কি কেবলই
প্রাতিষ্ঠানিক? কবির ধর্ম কি? কবি কি অভিশপ্ত প্রেমিক? জলের
কল্লোল বলে যায় কেউ কেউ মৃত্যুর জন্যে বাঁচে। মৃত্যু কি জন্ম
নির্ধারিত সত্য? প্রশ্ন কি বিজ্ঞান? প্রশ্ন কি দর্শন? চাঁদ ডুবে গেলে
তার হাত ছোঁব , এই প্রতীক্ষায় একটি জীবন কেটে গেল। তবু
প্রেম অবিচল।
[ সাত ]
ক্রমশ নিরাসক্ত হয় মন। ক্রমশ উদাসীন হয় সমগ্র বর্ণমালা। কে
যেন বললো সে জেগে আছে। কথা বলছে নক্ষত্রের সঙ্গে। কথা
তো বৃষ্টি বিন্দুর মতো মিশে যায় জলে কিংবা ভূমির শরীরে। তবুও
লেখা পথ ধরে মেধার উন্মেষ। তবুও হৃদয় ছুঁয়ে যায় সংগীত ও
কণ্ঠস্বর। কবিতার আলো ছায়া পথ। সাঁকোর ওপর দাঁড়িয়ে একা
রাত্রি। রাত্রি না শ্রেষ্ঠ রমণী?
[ আট ]
বিভিন্নতার সূত্র দিয়ে সহমতে পৌঁছতে হয়। সকলে কি বোঝে সে
কথা? কেবল উদ্গীরণ হচ্ছে বিষ বাষ্প। কেবল বিচ্ছিন্নতার সুড়ঙ্গ
দীর্ঘতর হচ্ছে মনে ও মতবাদে। বই আছে পাঠক নেই। তর্ক আছে
সহিষ্ণুতা নেই। মেধা মুছে দিতে চায় মূর্খতা। তবুও একটি একটি
দীপ জ্বেলে অন্ধকার সরাতে হবে সমন্বয়ে। বিশ্বাস , শ্রদ্ধা ও সহমত
একক নয় পারস্পরিক।
[ নয় ]
বৃষ্টি, বিদ্যুৎ ও জ্যোৎস্না দিয়ে রাতের শয্যা পেতেছে উন্মাদ। দারুন
রোমাঞ্চিত এই রাত্রি যাপন! অক্ষরে অক্ষরে সৃষ্টি ও ধ্বংসের ইঙ্গিত।
কথায় কথায় বিস্ফোরণ ও প্রেম। অন্তর্জলি যাত্রার খই পড়ে আছে
শবানুগমনের পথে। এই পথে ভূমিষ্ঠ সন্তান প্রসূতিসদন থেকে ঘরে
আসছে মায়ের কোলে। এই আবহমানতার ছবি আঁকছেন শিল্পী
আকাশ ক্যানভাসে। এই আবহমানতার কথা পংক্তিতে পংক্তিতে
অক্ষরঋদ্ধ করছেন কবি মধ্যরাতে।
[ দশ ]
দশ দিগন্ত জুড়ে বৃষ্টি এলো। বৃষ্টি পড়ছে ছাদে। বৃষ্টি পড়ছে পথে
ও প্রবাসে। বৃষ্টি পড়ছে সবুজ শস্যের অভিমানী শরীরে। বৃষ্টি পড়ছে
কাঁচের জানালায়। কি লিখছে বৃষ্টি বিশুদ্ধ বাংলা হরপে? কি লিখছে
বৃষ্টি পাতায় পাতায়? জীবনের কথা? জীবনযুদ্ধের কথা? প্রণয় ও
বিশ্বাসের কথা? শিল্পী , কবি , বিজ্ঞানী, কৃষক, শ্রমিক এবং স্বয়ং ঈশ্বর
ও ঘুম ভাঙা চোখে শ্ৰেষ্ঠ রমণী দেখছেন বৃষ্টিলেখা জলছবি জানালার
কাঁচে দৈব অক্ষরের মতো ভাস্বর বিদ্যুৎ চমকে।
__________________________________
খুব ভালো লাগলো
উত্তরমুছুন