লেবেল

শুক্রবার, ২১ মে, ২০২১

ভারতের নবজাগরণের পিতাঃপ্রসঙ্গ রামমোহন রায় ।। শ্রদ্ধা ও স্মরণে— বিমল মণ্ডল।। Ankurisha ।।E.Magazine ।।Bengali poem in literature ।।

 




ভারতের  নবজাগরণের পিতাঃপ্রসঙ্গ রামমোহন রায় 

শ্রদ্ধা ও স্মরণে— বিমল মণ্ডল 

"সত্যকে স্বীকার করে রামমোহন তাঁহার দেশবাসীর নিকটে তখন যে নিন্দা ও অসম্মান পেয়েছিলেন, সেই নিন্দা ও অপমানই তাঁর মহত্ত্ব বিশেষ ভাবে প্রকাশ করে। তিনি যে নিন্দা লাভ করেছিলেন সেই নিন্দাই তাঁর গৌরবের মুকুট।”-রবীন্দ্রনাথ


নবজাগরণের অগ্রদূত' রাজা রামমোহন রায়ের।   তিনি প্রথম ভারতীয় ধর্মীয়-সামাজিক পুনর্গঠন আন্দোলন ব্রাহ্মসমাজের প্রতিষ্ঠাতা এবং বাঙালি দার্শনিক।আঠারো এবং উনিশ শতকে বাংলার মাটিতে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষা- এসব ক্ষেত্রে যে যে পরিবর্তন এসেছে তার জন্য পুরো কৃতিত্ব রাজা রামমোহন রায়ের।  জন্ম ১৭৭২ সালের ২২ মে৷আজ তাঁর ২৪৯ তম জন্মদিন।  এই দিনটি আপামর বাঙালির পাশাপাশি গোটা দেশের কাছেই একটা উল্লেখযোগ্য দিন ৷ এই দিনেই হুগলি জেলার রাধানগর গ্রামে জন্ম নেন রাজা রামমোহন রায়৷ সারাজীবন অন্ধবিশ্বাস ও গোঁড়ামি থেকে সমাজকে মুক্ত করার লড়াই চালিয়ে গিয়েছেন তিনি। বাংলার নবজাগরণের পথিকৃৎ রাজা রামমোহন রায়কেই বলা হয় ভারতের প্রথম আধুনিক পুরুষ ; ‘আধুনিক ভারতের জনক’ এবং ‘ভারতের নবজাগরণের পিতা’ হিসাবেও অভিহিত করা হয়। 



খুব অল্প বয়সেই বাবার সঙ্গে ধর্মবিশ্বাস নিয়ে মতের মিল না হওয়ায় তিনি ঘর ছাড়েন। দীর্ঘ ভ্রমণ করেন হিমালয় এবং তিব্বতে। বাড়ি ফিরে আসার পর তাঁর বাবা-মা সন্তানের ‘মতিগতি’ বদলানোর লক্ষ্যে তাঁর বিয়ে দিয়ে দেন। যদিও, তাতে রামমোহন রায়কে কোনওভাবে আটকানো যায়নি। হিন্দুধর্মের একদম গভীরে গিয়ে সেই ধর্মের নেতিবাচক দিকগুলো তুলে ধরে ধর্মব্যবসায়ীদের প্রশ্নের মুখে ফেলাই ছিল তাঁর মূল লক্ষ্য।সেই সময়ে বাংলায় নেমে এসেছিল কুসংস্কার, ধর্মান্ধতা এবং অশিক্ষার কালো অন্ধকারে ৷ এই অন্ধকার দূর করতেই অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন তিনি। তাঁর সেই কঠিন লড়াইয়ের ফলেই সতীদাহ প্রথার মতো ঘৃণ্য সামাজিক প্রথার অবসান হয়। ১৮১৪ সালে তিনি কলকাতায় আসেন ও ধর্ম সংস্কারে আত্মনিয়োগ করেন। কলকাতায় ১৬ বছরের সংগ্রাম ও সংস্কার রামমোহনের কর্মযুগ বলা যেতে পারে। নবযুগের অগ্রদূত রামমোহন সামাজিক কুসংস্কার, ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে হাতে তুলে নেন রণ-শৃঙ্গ।ফলে স্বাভাবিকভাবে তার অনেক শক্রর সৃষ্টি হয়। একবার তিনি মধু দিয়ে রুটি খেতে খেতে বালক মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে বলছিলেন-বেরাদর (পারস্য শব্দ ভাই), আমি মধু ও রুটি খাচ্ছি, কিন্তু লোকে বলে আমি গরুর মাংস ভোজন করে থাকি। সামাজিক কুৎসা, জীবনের উপর আক্রমণ সবকিছুই সইতে হয়েছে রামমোহনকে।

সমাজ সংস্কার, প্রচলিত সামাজিক ও ধর্মীয় রীতি-নীতির অবস্থান নেওয়ার ফলে রামমোহন কম যন্ত্রণা সহ্য করতে হয় নাই। সমাজের মানুষের পাশাপাশি আত্মীয়-স্বজনের বিরুদ্ধেও তাঁকে সংগ্রাম করতে হয়। রামমোহনের পুত্র রাধাপ্রসাদের বিয়ের সময় তার বিরুদ্ধ দল বিয়ে ভাঙার অনেক চেষ্টা করে। এমনকি রামমোহনকে এক ঘরে করে রাখার আয়োজন করা হয়। যদিও তারা ব্যর্থ হয়েছিল। কিন্তু তার বিরোধী পক্ষরাও দমিবার পাত্র ছিল না। তার বিরোধী পক্ষরা রামমোহনের বাড়ির কাছে এসে সকালে মুরগির ডাক ডাকত, বাড়ির ভেতরে গরুর হাড় ফেলে যেত। এমনকি তার বিরুদ্ধে গানও রচনা করে সমাজের প্রতিক্রিয়াশীল শক্ররা।যেমন—

সুরাই মেলের কুল
(বেটার) বাড়ি খানাকুল,
বেটা সর্বনাশের মূল।
ওঁ তৎসৎ বলে বেটা
বানিয়েছে স্কুল।
ও সে জেতের দফা
করলে রফা, মজালে তিন কুল।''


প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজনের এতো অত্যাচার সহ্য করার পরও রামমোহনের কোন লেখায় কারো প্রতি কোন বিদ্বেষ দেখা যায়নি। কারণ তিনি ছিলেন খুবই ধৈর্যশীল একজন মানুষ। ছেলেরা দল বেঁধে রামমোহনকে খেপাইত। কলকাতায় যখন ব্রাহ্মসভায় উপাসনা করতে যেতেন তখন লোকে তার গাড়িতে ঢিল ছুড়ত। তাই বেশির ভাগ সময় গাড়ির জানালা বন্ধ করে রাখতে বাধ্য হতেন। শুধু তাই নয়; তার বিরোধী পক্ষ তাঁর প্রাণনাশের চেষ্টা পর্যন্ত করছে। এই জন্যে রামমোহন তাঁর সঙ্গে কিরিচ ও পিস্তল সঙ্গে নিয়ে বের হতেন। কিন্তু এর পরও কারো বিরুদ্ধে তার কোন অভিযোগ ছিল না। অসহিঞ্চু নীতিতে ছিল তাঁর আস্থা।



রামমোহন কলকাতায় চিন্তাশীল ও সংস্কার প্রয়াসী বিশিষ্ট জনদের নিয়ে একটি সমমনা-সভা গঠন করলেন। সেখানে বেদান্ত শাস্ত্র ও ধর্মের ব্যাখ্যা ও বিচার সম্পর্কে আলোচনা হতো এবং একেশ্বরবাদের পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন হতো। শহরের শিক্ষিত গণ্য-মান্য ব্যক্তিরা সভায় উপস্থিত হতো। তাদের মধ্যে ছিলেন জোড়াসাঁকোর প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর, পাথুরিয়াঘাটার  প্রসন্ন কুমার ঠাকুর, টাকীর কালীনাথ ও বৈকুণ্ঠনাথ মুন্সী, বৃন্দাবন মিত্র, কাশীনাথ মল্লিক, ভূকৈলাসের রাজা কালীশঙ্কর ঘোষাল, তেলিনিপাড়ায় অন্নদাপ্রসাদ ব্যানার্জি, হরিনারায়ণ তীর্থস্বামী এবং বৈদ্যনাথ ব্যানার্জি উল্লেখযোগ্য। এছাড়া  ব্রজমোহন মজুমদার, হলধর বসু, রাজনারায়ণ সেন, চন্দ্রশেখর দেব, তারাচাঁদ চক্রবর্তী প্রমুখ তাঁর সাহচর্য লাভ করেন।এছাড়া নিজের মত প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করার জন্যে ১৮১৫ সালে তিনি ‘আত্মীয় সভা’ প্রতিষ্ঠা করেন। সপ্তাহে একদিন আত্মীয় সভা অনুষ্ঠিত হতে তাতে বেদান্তানুযায়ী এক ব্রহ্মের উপাসনা এবং পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার কথা বলা হতো। সভায় বেদ পাঠের পর ব্রহ্ম সঙ্গীত গাওয়া হতো। সভা সকলের জন্যে উন্মুক্ত ছিল না। শুধু রামমোহনের কয়েক জন বন্ধু তাতে যোগদান করতে পারতেন। সে সময় নিন্দুকেরা আত্মীয় সভার বিরুদ্ধে গুজব রটায় যে, আত্মীয় সভায় গো মাংস খাওয়া হয়। ফলে অনেক বন্ধু রামমোহনকে ত্যাগ করে। পরবর্তীতে ১৮১৯ সালে আত্মীয় সভা বিহারীলাল চৌবের বাড়িতে স্থানান্তরিত করা হয়।

১৮১৫ সালে রামমোহনের সকল বিচারের ভিত্তিস্বরূপ সর্বপ্রথম বেদান্ত গ্রন্থ বা বেদান্তসূত্র  বাংলা ভাষায় প্রকাশিত হয়। বেদান্তসূত্র অতি বিস্তৃত ও কঠিন গ্রন্থ ছিল তাই বাধ্য হয়ে সার সংকলন বেদান্তসার নামে আরেকটি গ্রন্থ তিনি রচনা করেন। সময়টা ছিল বাংলা গদ্যরচনার শৈশবকাল। যদিও ১৮০১ সালে কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ স্থাপিত হয়। সেখানে ইংরেজ সিবিলিয়ানদের বাংলা শেখানোর জন্যে কলেজের কয়েকজন পণ্ডিত কয়েকটি বাংলা গ্রন্থ রচনা করেন। যা একেবারে সংস্কৃত-ঘেঁষা সন্ধি সমাজ বিবর্জিত সংস্কৃত বই বলা যায়। রামমোহনের পূর্বে এটাই ছিল বাংলা গদ্য রচনা। রামমোহন সংস্কৃত বহুল বাংলাকে সহজ-সরল করলেন। লোকে যাতে বাংলা পড়তে পারে তার জন্যে তিনি বেদান্ত-গ্রন্থে গদ্য  পড়ার  একটা নিয়ম লিখে দেন। 

১৮১৬ সালে রামমোহনের গ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদ দেখে ইংরেজ পাদ্রীরা অবাক হোন। তারা রামমোহনের পরিচয় সেসময় ইউরোপে প্রচার করেন। যে বেদ শূদ্র সম্প্রদায় উচ্চারণ করলে জিহ্বা কেটে দেওয়ার রীতি ছিল সেই বেদ-কে সাধারণ মানুষের কাছে উন্মুক্ত করে দেন রামমোহন। আমরা এই ক্ষেত্রে স্মরণ করতে পারি-রাজা রবি ভার্মার কথা। দেবতার মন্দিরে শূদ্রদের জায়গা ছিল না। মন্দিরের দেবতাকে ছবির মাধ্যমে সকল মানুষের কাছে পৌঁছে দেন রাজা রবি ভার্মা। সর্বসাধারণের জন্যে বেদ ছড়িয়ে দেওয়ার ফলে রামমোহনের বিরুদ্ধে হিন্দু সমাজে চাঞ্চল্য ও উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। বিভিন্ন মাধ্যমে শুরু হয় নির্যাতন। তাই তো ইংরেজি বেদান্ত গ্রন্থের ভূমিকায় রামমোহন রায় লিখেন- ‘’আমি ব্রাহ্মণ বংশে জন্মগ্রহণ করে বিবেক ও সরলতার আদেশে যে পথ অবলম্বন করেছি তাতে আমার প্রবল কুসংস্কারাচ্ছন্ন আত্মীয়গণের তিরস্কার ও নিন্দার পাত্র হতে হল। কিন্তু ইহা যতোই হোক না কেন, আমি এই বিশ্বাসে ধীরভাবে সমস্ত সহ্য করতে পারি যে, একদিন আসবে, যখন আমার এই সামান্য চেষ্টা লোকে ন্যায় দৃষ্টিতে দেখবে। হয়তো কৃতজ্ঞতার সাথে স্বীকার করবেন। লোকে যাই বলুক না কেন, অন্তত: এই সুখ হতে আমাকে কেউ বঞ্চিত করতে পারবে না। আমার আন্তরিক অভিপ্রায় সেই পুরুষের নিকট গ্রাহ্য, যিনি গোপনে দর্শন করে প্রকাশ্যে পুরস্কৃত করবেন।” রামমোহনের ভবিষ্যৎ বাণী ব্যর্থ হয় নাই।

রামমোহনের বই ও বইয়ের অনুবাদের ফলে দেশে বিদেশে রামমোহনের নাম ছড়িয়ে পড়তে থাকে। লন্ডন, ফ্রান্স, আমেরিকায়ও রামমোহন খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। সেই সাথে ভারতে রামমোহনের বিরুদ্ধে দেশে তীব্র প্রতিবাদ শুরু হয়। ১৮১৩ সালে মাদ্রাজ গভর্নমেন্ট কলেজের প্রধান ইংরেজি শিক্ষক শঙ্কর শাস্ত্রী মাদ্রাজ কুরিয়ার পত্রিকায় রামমোহনের বিরুদ্ধে প্রতিমা পূজার সমর্থন করে একটি চিঠি লেখেন। তার উত্তরে রামমোহন A Defence of Hiduism বা হিন্দুধর্মের সমর্থন নামে একটি প্রতিবাদ গ্রন্থ রচনা করেন। সেই বইতে শঙ্কর শাস্ত্রী’র চিঠিরা পুনর্মুদ্রণ করা হয়। এছাড়া রামমোহনের বিরুদ্ধে আরো বহু গ্রন্থ রচনা করে তাঁর বিপরীত পক্ষ। যেমন: পণ্ডিত মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার রচিত- বেদান্তচন্দ্রিকা। রামমোহন প্রতিটি বই কিংবা লেখার বিপরীতে গ্রন্থ রচনা করেন এবং বিপক্ষের যুক্তি খণ্ডন করেন। এমনকি বিদ্যালঙ্কার যখন কদর্য ভাষায় রামমোহনকে আক্রমণ করেন তখনও রামমোহন তাঁর লেখার উদারতা ও মহানুভবতার পরিচয় দেন।




রামমোহন রায়ের  আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল বাইরের দেশে ভ্রমণ এবং সেখানে যা কাজ হচ্ছে, সেগুলোর সাথে বাংলার মানুষদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া। তিনি জানতেন যে, শিক্ষা ছাড়া এই দেশের মানুষ কখনও উন্নতি করতে পারবে না। আবার উন্নত দেশের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হলে তাদের মতো করে ভাবতে হবে, তাদের কাজগুলো বুঝতে হবে, তাদের সংস্কৃতির সাথে নিজেদেরকে মানিয়ে নিতে হবে। রাজা রামমোহন রায়ের পশ্চিমা দেশের সংস্কৃতি নিয়ে এবং তাদের সেখানে প্রতিনিয়ত তৈরি হওয়া জ্ঞান নিয়ে আমূল আগ্রহ ছিল।

সেই সময়ে বিজ্ঞানে চলছিল নিউটন পরবর্তী যুগ এবং শিল্প-কারখানা সৃষ্টির একটি রেনেসাঁ যুগ। তখন পশ্চিমারা নিজেদেরকে জ্ঞান-বিজ্ঞানে উন্নত করার চেষ্টা করছে। রাজা রামমোহন রায়ের মনে হয়েছিল, পশ্চিমে বিশেষ করে ইউরোপে জ্ঞান-বিজ্ঞানে যা হচ্ছে, তা কখনোই ফেলে দেয়ার মতো না এবং এসবকে কোনোভাবেই উপেক্ষা করা যাবে না। এজন্য তিনি দেশে ফিরে নিজেদের পড়াশোনার মধ্যে ইংরেজি ভাষা অন্তর্ভুক্ত করার উপর জোর দেন এবং সমাজের মানুষদেরকে বোঝান যে নিজেদের দেশকে উন্নতির শিখরে নিতে হলে অবশ্যই সংস্কৃত ভাষার পাশাপাশি ইংরেজি ভাষাটাও রপ্ত করতে হবে। সে সময়ের চিত্র যদি আমরা এখন পর্যালোচনা করি, তাহলে দেখা যাবে জ্ঞান-বিজ্ঞানের দিক দিয়ে বাংলা ও ভারতীয় উপমহাদেশ এবং ইউরোপের মধ্যে সেসময় কী পরিমাণ পার্থক্যের সৃষ্টি হয়েছিলো, যেটা তখন রামমোহন রায় বুঝতে পেরেছিলেন।নিউটনের সময়ে ইউরোপের জ্ঞান-বিজ্ঞানের যে উন্নতি সাধন হয়, সেটার পেছনে সেই দেশের অভিজাত শ্রেণির মানুষদেরও গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল। রয়্যাল সোসাইটি এবং এর মতো আরও কিছু প্রতিষ্ঠান বিজ্ঞানের নতুন নতুন আবিষ্কারকে প্রচার করেছিলো এবং বিজ্ঞানীদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলো। অন্যদিকে বাংলার মাটিতে এমন কাজ করার কেউ ছিল না। ইংরেজদেরও একধরনের অনিচ্ছা ছিল এই দেশের মানুষদের উন্নত করার প্রতি। এখানকার মানুষদের খাটিয়ে নিয়ে তারা নিজেদের দেশের আর্থিক সচ্ছলতা বৃদ্ধি করছিলো। জ্ঞান-বিজ্ঞানে ক্রমেই যে দুই দেশের মধ্যে বৈষম্য তৈরি হচ্ছে, রামমোহন রায় তা আগেই বুঝতে পেরেছিলেন। তাই যখন ইংরেজরা কলকাতায় সংস্কৃত কলেজ তৈরি করার কথা বলে, তখন তিনি প্রচণ্ডভাবে সেটার বিরোধিতা করেন। সেখানে তিনি প্রস্তাব করেন শুধু সংস্কৃতি নয়, সেখানে বিজ্ঞান, ইতিহাস, অর্থনীতি, ভূগোল এসব বিষয়ও পড়াতে হবে। তার ধারণা ছিল পশ্চিমাদের জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হলে এবং তাদের নিত্য-নতুন আবিষ্কার এবং ধারণাগুলোকে বুঝতে হলে উপমহাদেশ তথা বাংলার ছেলেমেয়েদেরকেও এসব বিষয়ে পূর্ণ জ্ঞান দিতে হবে, যাতে তারা নিজ দেশকে উন্নত করতে পারে এবং অন্যান্য উন্নত দেশগুলোর সাথে যেন প্রতিযোগিতা করতে পারে। তার এমন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ধারণা আমাদের দেশের সমাজে এক নতুন বিপ্লবের সূচনা করেছিলো।



অনেকেই মনে করেন, রাজা রামমোহন রায় পশ্চিমাদের অন্ধভাবে অনুসরণ করতেন, কিন্তু আদৌ ব্যাপারটি এরকম ছিল না। তিনি বিভিন্ন সময়ে হিন্দু সম্প্রদায় যখন খ্রিস্টান সম্প্রদায় কর্তৃক সমালোচিত হতো, তখন কড়া ভাষায় সেগুলোর প্রতিবাদ করতেন। ঠিকভাবে প্রতিবাদ করার জন্যই তিনি গ্রিক এবং হিব্রু ভাষা শিখেছিলেন। এছাড়া তিনি বাংলার মানুষদের স্বাধীন চিন্তাধারার পক্ষে ছিলেন। সেজন্য ব্রাহ্ম সমাজ নামক একটি ধর্মীয় সংঘও গড়ে তোলেন, যেখানে স্বাধীন চিন্তাধারার বিষয়ে আলোচনা করা হতো এবং তাদের বিশ্বাস সমাজে চারদিকে ছড়িয়ে দেয়া হতো। এমনকি তিনি যখন দিল্লির সম্রাটের পক্ষ থেকে ১৮৩০ সালে ইংল্যান্ডে বক্তৃতা দিতে যান, তখন তার কথা এবং আলোচনার মাধ্যমে ভারতীয় উপমহাদেশ যে জ্ঞান-বিজ্ঞান সমৃদ্ধ দেশ, তা পুরোপুরি প্রকাশ পায়। ১৮৩৩ সালের সেপ্টেম্বরের ২৭ তারিখে বাংলার এই মহান পণ্ডিত এবং সমাজ-সংস্কারক ইংল্যান্ডে মৃত্যুবরণ করেন।



আজকের দিনে দাঁড়িয়েও, নারীকে পুরুষের সমান স্থানটি পাওয়ার জন্য, নিজের অধিকারের জন্য, দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করে যেতে হয়। কিন্তু, আজ থেকে প্রায় ২০০ বছর আগে, সতীদাহের মতো ভয়ঙ্কর একটি প্রথা কুরে কুরে খেয়ে নিয়েছিল সমাজকে, সেই সময়ে, রামমোহন রায়ের মতো মানুষই প্রথম রুখে দাঁড়ান এর বিরূদ্ধে। কোনও মহিলার স্বামীর মৃত্যুর পর, স্বামীর চিতাতেই সেই মহিলাকে জীবন্ত জ্বালিয়ে দেওয়া হত।রামমোহন রায় অবিরামভাবে সারা জীবন সামাজিক কিছু রীতিনীতির বিরুদ্ধে কথা বলেছিলেন। তাদের মধ্যে একটি হচ্ছে জাত বা সমাজের স্তরবিন্যাস ও জাতি বিদ্বেষ এবং আরেকটি সতীদাহ প্রথা। তার সময়ে এই দুই রীতির প্রভাবে সমাজে বিশৃঙ্খলা ও সামাজিক মূল্যবোধ এবং চেতনাবোধের অভাব দেখা দেয়। শক্ত হাতে তিনি তা দমন করেন।

তিনি মহিলাদের সমান অধিকারের দাবিতে প্রথম আন্দোলন শুরু করেন। এই আন্দোলনের অংশ হিসাবেই ছিল মহিলাদের সম্পত্তির অধিকার এবং পুনর্বিবাহের অধিকারের কথাও।



ভারতের নবজাগরণের এই প্রাণপুরুষকে ওনার ২৪৯তম  জন্মবার্ষিকীতে জানাই সশ্রদ্ধ প্রণাম।







    





1 টি মন্তব্য:

  1. অসাধারণ লিখেছেন ভাই , জবাব নেই জবাব নেই, অনেক কিছু জানতে পারলাম , চালিয়ে যান , আমি রইলাম পিছে ,মার একটু টান ।

    উত্তরমুছুন