ধারাবাহিক রহস্য উপন্যাস /পর্ব-২
অষ্টভুজ রহস্য
অলোক চট্টোপাধ্যায়
এই ঘটনার পর বলরাম আর তার বৌএরও নাকি কয়েকবার এ জাতীয় অভিজ্ঞতা হয়েছে। তারা শেষে ও বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। সুজয় নিজেও এর মধ্যে কয়েক বার রাতে ও বাড়িতে থেকেছিল। প্রত্যক্ষ কিছু না দেখলেও তারও মনে হয়েছে ব্যাখ্যাতীত কিছু রয়েছে ওখানে। পরে যখন বাড়িটা সারানোর চেষ্টা করেছে তখন নানা অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে একের পর এক।
আসলে বিজয়বাবু একসময়ে ভেবেছিলেন ঐ বাড়িটা সংস্কার করে দাদু-দিদিমার নামে একটা স্কুল করবেন। সুজয় আর অজয়ও তাতে রাজি। আমেরিকা থেকে বেশ কয়েকবার মোটা টাকা পাঠিয়েছিলেন বিজয়বাবু। কিন্তু কিছুতেই কিছু করা যায়নি। নতুন তৈরি দেওয়াল দুদিন বাদে আপনা থেকে ভেঙে পড়ে গেছে। দুপুরে ঢালাই করা ছাত হুড়মুড় করে পড়ে গেছে রাত্রে। যেসব মিস্ত্রি ওখানে থেকে কাজ করত তারা রাতে নানা রকম অপার্থিব শব্দ শুনত। কি সব ছায়ামুর্তিও দেখেছে নাকি কেউ কেউ । বিজয়বাবু এসব বিশ্বাস করেন না তবু তাকে না জানিয়েই সুজয় নাকি কিসব পুজো আচ্চাও করিয়েছিল, তবে তাতে কোনো লাভ হয়নি। শেষ পর্যন্ত কাজ ফেলে মিস্ত্রিরা চলে গেছে। বেশ কয়েকবার এরকম হবার পর সুজয়ও একসময়ে হাল ছেড়ে দিয়েছে। দাদাকে আর টাকা পাঠাতে বারণ করেছে।
গাড়িটা খারাপ হতে বেশ বিরক্ত হয়ে উঠেছিলেন বিজয়বাবু। আধঘন্টায় হয়ে যাবে বলার পর আরো সময় লাগবে শুনে ধৈর্য্যচ্যুতি হয়ে গেল তার। আসলে সেই পুরোনো বাড়িটা দেখতে পাবেন ভেবে মনেমনেই বেশ উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলেন তিনি। তার মধ্যে এই বিপদ। ঠিক এই সময়ে হঠাৎই একটা বাস এসে হাজির। গাড়ি সারানোর দোকানের পাশেই স্টপেজ। কন্ডাক্টার চ্যাঁচাচ্ছিল – জয়চন্দ্রপুর – ফুলবেড়িয়া – কদমফুলি – হাসানগাঁ। কি মনে হল, বিজয়বাবু কন্ডাক্টারকে ডেকেজিগ্যেস করলেন – এটা কদমফুলি যাবে?
উত্তরে জানা গেল, যাবে, তবে বাবুবাজারের মোড় থেকে ভেতরে ঢুকবে না। সোজা বেরিয়ে যাবে হাসানগাঁ। বাবুবাজার থেকে রিকশা নেয়ে যেতে হবে কদমফুলি।
হঠাৎ কি মনে হল, বিজয়বাবু নীলমনিকে ডেকে বললেন –আমি এই বাসটায় রওনা হয়ে যাচ্ছি। গাড়ি ঠিক হলে তুমি সোজা ওখানে চলে এসো। যদি দেরি হয়ে যায়, বাড়ির সামনে আমি না থাকি, বাবুবাজারের বাস স্ট্যান্ডে চলে আসবে। আর ফোন করে নেবে।
নীলমনি শুনে হাঁউমাউ করে উঠল। - একলা এই বাসে কোথায় যাবেন আপনি? আর একটু অপেক্ষা করুন, গাড়ি এক্ষুনি ঠিক হয়ে যাবে –।
-সেটা তো গত একঘন্টা থেকে শুনছি। বিজয়বাবুর এতক্ষনের চাপা বিরক্তিটা এবার প্রায় ধমকের সুরেই বেরিয়ে এসেছিল। বলেই অবশ্য খারাপ লাগল তার। সাধারণত এরকম উঁচু গলায় কারো সঙ্গে কথা বলেননা তিনি। পরক্ষণেই নরম গলায় বললেন –আসলে বাসে রওনা হলে আলো থাকতে থাকতে পৌঁছে যাব। তুমি চলে এসো, তাহলেই হবে।
-কিন্তু স্যার আমার সাহেব শুনলে আমায় খুব বকবেন। আর তাছাড়া আপনি তো সেখানকার পথঘাটও চেনেন না। বাড়িতে যাবেন কিভাবে? আপনি যাবেন না স্যার-
বিজয়বাবু এবের আলতোভাবে তার পিঠ চাপড়ে দিয়ে ভরসা দিয়ে বললেন – তোমার সাহেবকে আমি বলে দেব। তোমায় বকবে না। আর বাড়ির রাস্তা? এখন নিশ্চয়ই ওখানে রিকশাকে বললে ঠিক পৌঁছে দেবে।
ওদিকে বাসের কন্ডাক্টার অধৈর্য্য হয়ে উঠছিল। নীলমনিকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে টপ করে বাসে উঠে পড়েছিলেন বিজয়বাবু। বাসও ছেড়ে দিয়েছিল প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই।
তবে বাসে উঠেই তিনি বুঝতে পারলেন কাজটা খুব একটা ঠিক করেননি। বহু দিন বাসে ওঠেননি তিনি। এ দেশে এলেও ভাইদের গাড়িতেই যাতায়াত করেন অথবা ভাড়া করা গাড়িতে। বিদেশে তো নিজেরই দুটো গাড়ি আছে। কাজেই বাসে শেষ কবে চড়েছেন মনেও নেই। তার ওপর গ্রামের রাস্তায় চলা লড়ঝড়ে বাস। কন্ডাক্টার অবশ্য তাকে বেশ খাতির করে, ড্রাইভারের ঠিক পেছনের সিটে বসা একজন দেহাতি লোককে পেছন দিকে পাঠিয়ে দিয়ে তাকে বসিয়ে দিয়েছিল। গল্পও করতে লাগল সমানে। বিজয়বাবু তাকে বলেছিলেন আগে ফুলবেড়িয়া অবধিই বাস যেত। সেখান থেকে কাঠের ব্রিজ পেরিয়ে কদমফুলি ছিল দশ মিনিটের হাঁটা পথ। কন্ডাক্টার জানাল, কিছুদিন আগে অবধি তাই ছিল বটে, তবে এখন ফুলবেড়িয়া ছাড়িয়ে আরো আধ কিলোমিটার গিয়ে পাকা ব্রিজ হয়ে গেছে। নতুন রাস্তা বিদ্যাধরির খাল পেরিয়ে চলে গেছে হাসান গাঁ পর্যন্ত। পুরোনো কাঠের পুল আর নেই, কাজেই কদমফুলি যাবার জন্যে নতুন রাস্তা ধরে পাকা ব্রিজ পেরিয়ে বাবুবাজার অবধি গিয়ে রিকশা করে বেশ কিছুটা ফিরে আসতে হয়। তবে তার আগে একটা কাঁচা রাস্তা ব্রিজের পরেই বাঁদিকে নেমে গেছে। সেটা দিয়ে গেলে কদমফুলি খুব কাছে পড়ে। তবে সে পথে এখনো রিকশা চলাচল শুরু হয়নি। কাজেই বাবুবাজারে নামা ছাড়া উপায় নেই। তবে খুব তাড়াতাড়িই সেটাও পাকা হয়ে যাবে সে আশ্বাসও দিল সে।
ইতিমধ্যেই ফোন এসে গেল সুজয়ের। বেশ রাগারাগিই করল সে, এভাবে বাসে উঠে রওনা হবার জন্যে। গ্রামের রুটের বাস। কতক্ষনে পৌঁছোবে ঠিক নেই। বারবার বলল, অন্ধকার হয়ে গেলে কোনোমতেই যেন তিনি বাড়ির দিকে যাবার চেষ্টা না করেন। সেরকম দেরি হলে যেন বাসস্ট্যান্ডেই নীলমনির জন্য অপেক্ষা করেন। বাধ্য হয়ে বিজয়বাবু তাকে কথা দিলেন বটে, তবে তিনি মনে মনে ঠিকই করে ফেললেন যে এত কষ্ট করে এতদুর এসে বাড়িটা একবার চোখের দেখা না দেখে ফিরবেন না।
একসময়ে ফুলবেড়িয়া এসে গেল। বাসের জানলা দিয়ে পুরোনো জায়গা গুলো খোঁজার চেষ্টা করতে লাগলেন বিজয়বাবু। একসময়ের বড়সড় গ্রামটা এখন আধা শহর। দাদুর দুটো তেলের ঘানি ছিল এখানে। সব আমুল বদলে গেছে। এখানকার স্কুলে পড়ার সময়ে বন্ধুদের সঙ্গে সাইকেলে চেপে এ অঞ্চলটা চষে বেড়িয়েছেন। এখন সেই স্কুলের পথটাও ঠিক চিনতে পারলেন না। পুরোনো কাঠের ব্রিজের রাস্তাটাও কন্ডাক্টার বলে না দিলে চিনতে পারতেন না। অবাক চোখে চারদিক দেখতে লাগলেন তিনি। এত পাকাবাড়ি উঠে গেছে ! অবশ্য বাইশটা বছরও তো নেহাৎ কম সময় না।
ফুলবেড়িয়ার থেকে আধকিলোমিটার এগিয়ে রাস্তাটাই বাঁ দিকে বেঁকে উঠে গেছে নতুন কংক্রিটের ব্রিজে। নিচে বিদ্যাধরির খাল। সেখান থেকে সোজা দক্ষিণে চলে গেছে রাস্তা। বাস যখন বাবুবাজারে পৌঁছোলো তখন ঘড়িতে সাড়ে পাঁচটা। অন্ধকার নামছে। বড়জোর আর আধঘন্টা শেষ বিকেলের আবছা আলো থাকবে। বিজয়বাবু চিন্তায় পড়লেন। পথঘাট সবই বদলে গেছে। দাদুর বাড়ি ছিল পুরোনো কাঠের ব্রিজের থেকে নেমেই ডানহাতি রাস্তায়। সেই রাস্তাটাই তো আর নেই। এখন উপায়?
কয়েকটা সাইকেল রিকশা দাঁড়িয়ে ছিল সামনেই। তাদের ভেতর থেকে অল্প বয়সী একজন এগিয়ে এসে জিগ্যেস করল – কোথায় যাবেন স্যার?
-কদমফুলি, পুব পাড়া। বিজয়বাবু বললেন। - চৌধুরি বাড়ি চেনো?ছেলেটা চেনেনা। বিজয়বাবু স্মৃতি হাতড়ে বলতে লাগলেন – মনোহরের মুদিখানা? কাঠের ব্রিজ থেকে নেমেই। তার থেকে একটু এগিয়েই গেনুর সেলুন। শিতলা মিষ্টান্ন ভান্ডার? নাঃ কিচ্ছু চেনেনা ছেলেটা।তবে এসব শুনে বয়স্ক একজন এগিয়ে এল। ফলবাগানের চৌধুরিদের কথা বলছেন কি? তা, চৌধুরি কত্তা গত হয়েছেন তো সেই কবে। সে বাড়িও তো তারপর থেকে খালিই পড়ে থাকে। যাবেন কার কাছে ?
বিজয়বাবু একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। যাক, কেউ তো চিনতে পেরেছে! বাড়িটাতে পৌঁছোনো যাবে অন্তত। - ঠিক কারো কাছে যাব বলে আসিনি। এমনিই বাড়িটা একবার দেখতে এসেছি। বললেন তিনি। -ছেলেবেলায় থাকতাম ওখানে। অনেকদিন বাদে এদিকে এসে ইচ্ছে হল একটু বাড়িটা দেখেই যাই। সে জন্যেই - । এতগুলো কথা বলে বিজয়বাবু নিজেই অবাক হয়ে গেলেন। একজন রিকশাওয়ালাকে এত কৈফিয়ত দেওয়াটা তার নিজের কাছেই অদ্ভুত লাগল।
বয়স্ক মানুষটি অবশ্য কম বয়সিকে পথটা বুঝিয়ে দিল। - তুই ওনাকে মনসাতলার দিক দিয়ে নিয়ে যা। হনুমান মন্দিরের বাঁদিকের রাস্তাটা নিবি। গোপালের চায়ের দোকানে একবার শুধিয়ে নিস। ওদিকে তো ঘরবাড়ি বেশি নেই। তারপর বিজয়বাবুকে আশ্বস্ত করল – যান বাবু। ও বুঝে গেছে। ঠিক পৌঁছে দেবে।
চলবে...
--------------------------------------------------------------------------------
প্রতি সপ্তাহে বুধবার অঙ্কুরীশা-র পাতায় ক্লিক করে এই ধারাবাহিক উপন্যাসটি পড়ে নিন।
https://wwwankurisha.blogspot.com/2020/11/blog-post_3.html.. (১ম পর্ব)
মতামত জানান।
ankurishapatrika@gmail.com
--------------------------------------------------------------------------------
Waiting for the next episode
উত্তরমুছুনজারুল ভাবে এগিয়ে চলেছে....
উত্তরমুছুনবেশ ভালো লাগলো দ্বিতীয় পর্বটাও।