লেবেল

শুক্রবার, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০২০

ছড়াগুচ্ছ ।। রতনতনু ঘাটী

 




ছড়াগুচ্ছ
রতনতনু ঘাটী

এবার পুজোর ছুটি                                   

 

হাজারিবাগের বকুল মাসির থেকে

পার্সেলে এল দু’-দু’টো নতুন জামা

পুজোয় কী দেব ভাবতে ভাবতে দেখি

নীল সোয়েটার পাঠালেন মেজোমামা।

 

পুজোয় কেউ কি সোয়েটার পরে নাকি?

মামা লিখেছেন, শীত বেশি দূরে নেই!

মালতী পিসির মেরুন রঙের শার্ট

তুলে রাখা আছে দশমীর জন্যেই।

 

ছোটকা দিয়েছে টিনটিন আঁকা জামা

স্পাইডারম্যান টি-শার্ট দিয়েছে ঠামি!

কী ভালো দেখতে! একেবারে ঝাক্কাস!

ষষ্ঠীর দিন সেটাই পরব আমি।

 

 

মা তো দিয়েছেন কমিক হিরোর বই

বাবা দিয়েছেন আর্চির মুখ আঁকা

স্যান্ডো টি-শার্ট আনকমন তো বটে

এই নিয়ে বেশ আনন্দে ডুবে থাকা।

 

আমি সাতখানা পুজোর গিফটে মেতে

হঠাৎ কী হল, বাবা বললেন ডেকে,

মেরুন জামাটা দেবেনের ছেলে নিক

কী এমন হবে এতগুলো জামা রেখে?

 

বকুল মাসির জামাটা ভুলুই নিক

সক্কালে ভুলু কাগজ কুড়োতে এলে।

নীল সোয়েটার টোটাকেই তুই দিস

টোটা আমাদের রান্নামাসির ছেলে

 

আমাদের বাড়ি দুধ দেয় রোজ দিলু

আর্চি টি-শার্ট তাকেই মানাবে শীতে

সকলে পড়বে এই ভেবে দিয়ে দিস

কমিক বইটা পাড়ার লাইব্রেরিতে।

 

 

 বকুল মাসির আর জামাখানা পাক

কাঁই-না-না-না-না বাজানো নবীন ঢাকি

স্পাইডারম্যান টি-শার্টটা তুই নিস

ওটা এক্ষুনি আলাদা করেই রাখি।

 

স্পাইডারম্যান টি-শার্টটা পরে আমি

ঘুরব ক’দিন আনন্দে লুটেপুটি!

নতুন জামায় ওদের খুশির পাশে

স্মরণীয় হবে এবার পুজোর ছুটি!






কাজের লোক


মাথায় কিছুটা লম্বা, তা হ্যাঁ চার-পাঁচ ফুটই হবে

শ্যামলা দেখতে আমাকে তবুও ডাক পড়ে উৎসবে।

লোকে কাজ দেবে ডেকে

বলবে, ‘এখন চলে যা তো দেখি! আসিস সকাল থেকে।’

কত কাজ থাকে জানো?

প্যান্ডেল বাঁধো, চাঁদোয়া টাঙাও, কলাপাতা কেটে আনো।

‘বিশখানা জালা জলে ভরে রাখ

কে কখন ডাকে, ডেকে যেন পায়এখানে দাঁড়িয়ে থাক।’

বলেই সকলে যে-যার ব্যস্ত, এদিক ওদিক ছোটে

বেড়ার ওধারে জুঁই-মালতিরা ফোটে!

আমি একধারে দাঁড়িয়ে তখন কাজের অপেক্ষায়

সকলে বলবে, ‘তোকে কাজ দিয়ে চুপ করে থাকা দায়!

জল ঢেলে দিলি ছাদনাতলায়, কলসি ভাঙলি ঘাটে?

রান্নার কাঠ কিনে আন দেখি, এক্ষুনি ছোট হাটে।’

কেউ বলে না তো, ‘খেয়েছিস কিছু?’ ডাকে না তো, ‘কাছে আয়।’

খাটতে খাটতে সকাল কখন বিকেলে গড়িয়ে যায়।

আঁধার নামলে উৎসব বাড়ি আলো ঝলমল সাজে

আমাকে তখন কারও মনে নেই, খোঁজ পড়ে না তো কাজে।

একপেট খিদে, বাড়ি যেতে যেতে ভাবি

আমার পকেটে বেজে ওঠে যদি ভাঁড়ার ঘরের চাবি?

পেটভরে শুধু রাজভোগ খাব, মানব না কোনও মানা

মায়ের জন্যে কলা পাতা মুড়ে নিয়ে যাব চারখানা।

 

উৎসব বাড়ি ফের আসে যদি, মনে পড়ে আমাকেও...

দ্বিধা না করেই তক্ষুনি চলে যেও!

ইটাচুনা গ্রামে আমাদের বাড়ি, ওখানেই বসবাস!

নামটা আমার বলাই হয়নি, ভবেশকুমার দাস



হস্টেলে যাচ্ছি

 

মাকে আমি প্রণাম করলাম, উঠোনে নামতেই

বাবা বলল, ‘জলদি হাঁটো, ট্রেনের দেরি নেই।’

আমার হাতে ভারী সুটকেস পা-টা নড়ছে না যে

মায়ের কান্না-ভেজা গলার ‘খোকা’ ডাকটা বাজে

যাচ্ছি আমি আজ মাকে ফেলে দূরের হস্টেলে

নরেন দাদুর পরামর্শ, ‘মানুষ করো ছেলে

সারা দিনই বল পেটাচ্ছে পাশ করে না ক্লাসে

দুপুরবেলা দত্তবাড়ির বাতাবি পেড়ে আসে

পাখির বাসার থেকে আনছে তিন-চারটে ডিম

ডাল ভেঙে ও সব ন্যাড়ামুড়ো করছে মহানিম।’

লোকে বলে, ‘বখে যাওয়ার কিচ্ছুটি নেই বাকি!’

আঙুল তুলে বলে, ‘এ কখনো মানুষ হবে নাকি?

ক’দিন আগে গুপ্তি পাড়ার সঙ্গে ছিল খেলা

ওরই জন্যে ভন্ডুল সেদিন সন্ধেবেলা।

বাবা-মা কেউ নজর দেয় না, রোজ যায় না স্কুলে

গ্রামের মধ্যে গুন্ডা হবে বাবা-মায়ের ভুলে!’

আমার মানুষ না হওয়াতে কার ভূমিকা কী যে

এর জন্যে দায় কি বাবার? কারণ খুঁজি নিজে।

মাকে বলল, ‘তোমার জন্যে হল এত বাঁদর।’

‘একা আমার দোষ দেখলে, তুমি দাওনি আদর?’

এই নিয়ে মা-বাবায় ক’ দিন কত ঝগড়াঝাঁটি

বাবার দু’ চোখ ভিজে ঝাপসামা  কান্নাকাটি

মায়ের স্নেহ কাঁদাচ্ছে খুব, উঁহু বুঝি বাবার!

ভাবতে গিয়ে কত যে রাত হয়েই গেল কাবার

সমস্ত জল্পনার শেষে পরশু হল ঠিক

হস্টেলে তাই যাচ্ছি চলে, ঝাপসা চারদিক।

 

সেখানে একটা ছোট্ট রুমে দশটা ছেলে থাকে

পড়ার সময় নিয়ম হল কেউ যেন না ডাকে।

ছোট্ট খাটের বিছনা থেকে যদি বা যাই পড়ে

ডাকবে না কেউ, উঠব একা ঘুম ভাঙলে ভোরে।

থালা-বাসন ধুতেও হবে, জামা কাপড় সব?

তোমার খোকা সবই পারবে সে যেন উৎসব।

মশারি পাতবে খোকন একা? চট্টিখানি কথা?

বলেছি মাকে, ‘শিখেই নেব। রেখো না ব্যাকুলতা?’

চাঁদটা উঠলে পুব আকাশে বাড়ির কথা ভেবে

কাঁদব না মা, তোমার খোকন সব সামলে নেবে।

মুখটা তোমার দেখতে পেলে দূরের মেঘলোকে

ঘুম এসেছে বলব, জলের ঝাপটা দেব চোখে।

বন্ধুরা কেউ জেনে ফেললে বলব, ‘তোরা যা তো!’

আমার কান্না গুরুদেবের চোখে পড়বে না তো!

মাছের কাঁটা ছাড়িয়ে খেতে পারবে তোমার খোকা

একটা দিন লাগবে শিখতে, ভাবছ কেন, বোকা!

আমাকে এখন থাকতে হবে দূরের হস্টেলে

বাড়ি আসব ছুটি পড়লে পরীক্ষা শেষ হলে

মা-বাবা আর নরেন দাদু, সকলকে যাই বলে,

‘তোমারা সবাই ভালো থেকো, যাচ্ছি আমি চলে!’

 

গ্রামের পথে ফিরব হেঁটে সবাই দেখবে চেয়ে

রামধনুরা দেখতে আসবে মেঘের সিঁড়ি বেয়ে

সবাই অবাক, এই ছেলেটা সেই ছেলে কী তবে?

একে নিয়ে এবার গ্রামের মুখ উজ্জ্বল হবে!

মাকে পাইনি, বাবাকেও না, বন্ধুদেরকে ছেড়ে

দু’ চোখ ঝাপসা, আমি কেমন উঠেছি আজ বেড়ে।

দুষ্টু ছেলেদেরকে এখন কতই স্বপ্ন বেচি

দেখতে দেখতে আমি কখন মানুষ হয়ে গেছি!








এ কলকাতা বিশ্বসেরা                               

অবশেষে বৃষ্টি এল কলকাতাতে

আমি এখন দাঁড়িয়ে আছি বাড়ির ছাতে।

আকাশ এমন ঝাপসা হতে জল নামল মেঘের চোখে

একলা কেমন দাঁড়িয়ে আছি, দেখুক লোকে!

ভয়ডর নেই, ভয়ের কী যে...

মায়ের নিষেধ মানব না আজ, ভিজব নিজে

সবাই বলবে বৃষ্টি হলে বানভাসি এই শহরটা কী ভীষণ যা-তা!

আমি বলব, ‘মায়ের মতো এ কলকাতা।’

 

রাস্তাঘাটে ফুটপাথ কই? সমস্তটাই জবরদখল!

ইচ্ছেমতো দোকানদানি, দোল খাচ্ছে আসল-নকল

রংবাহারি ফ্রক-জামা-প্যান্ট হুকের নীচে থাকছে ঝুলে

সাঁই সাঁই সাঁই ছুটছে গাড়ি ঈষৎ ভাঙা উড়ালপুলে

তারই নীচে আমরা কিনছি একটা-দুটো সস্তা দামে

কী যায়-আসে বড় দোকান, কী যায়-আসে ওসব নামে?

সবাই বলছে এই শহরটা হকারদেরই, রঙিন ছাতা

আমি বলব, ‘আরে ব্বাবা! গরিবলোকের এ কলকাতা!’

 

জল আসে কি ট্যাপকলে ঠিক নিয়মমতো?

স্বপ্নে দেখা কল খুললেই জল পড়াটা সত্যি হত!

তা হয় না ঠিক, তবু বলো আমরা কি কেউ চান করি না?

বৃষ্টি হলে ট্রামলাইনে খেলনা জালে মাছ ধরি না?

সবাই বলে, ‘এই যে বাপু, আর ক’টাদিন দাও না যেতে,

জলশূন্য এ শহরটা আগুন হয়ে উঠবে তেতে!’

ফুটপাথে ওই রোগা মতন গাছের ডালে লাল ফুলেরা ফুটবে যত

আমি বলব, ‘এ কলকাতা রূপসী ঠিক সিঁদুর পরা দিদির মতো!’

 

এ কলকাতায় কিচ্ছুটি নেই, প্রজাপতি, ফড়িংটড়িং, হলদে পাখি

সরু এবং মস্ত লম্বা গলির শেষে আমরা থাকি!

অসুখ হলে দৌড়ে আসে রাতবিরেতে ক্লাবের ছেলে

অবাক হই না ঝুপড়ি ঘরের শ্যামলা মেয়ে মাধ্যমিকে প্রাইজ পেলে!

উড়নচণ্ডী সেই ছেলেটা দুষ্টুমি সব সরিয়ে রেখে

অশীতিপর বৃদ্ধাকে সে, ‘ও ঠাকুমা, পয়সা নাও গো,’ বলছে ডেকে।

হারমোনিয়াম বাজিয়ে শুনি গান গাইছে গরিব ঘরের সেই মেয়েরা

আমি বলব, ‘এ কলকাতা বিশ্বসেরা!’







অমলিন ছেলেবেলা


 

তুবড়ে যাওয়া সে স্কুলবক্সটাকে

লুকিয়ে রেখেছি, যেন সে অচিন পাখি!

যখন বাড়িতে একটি লোকও নেই

নামিয়ে তখন মেঝের উপর রাখি।

 

বাক্সটা খুলি, চেনা গন্ধটা আসে

মনে পড়ছে না কোথায় কখন তাকে

পেয়েও ছিলাম, আরে এ তো ছেলেবেলা!

মনে পড়তেই হাতছানি দিয়ে ডাকে।

 

হাত বাড়িয়েছি, চারখানা জলছবি

খুবই পুরনো, হাসছে আমাকে দেখে।

জেগে উঠে বলে ছবি-আঁকা পেনসিল,

“নাম কী রে তোর? জাগালি ঘুমের থেকে?”

 

নাম বলব কি? ভেবেটেবে শেষে বলি,

“মিন্টু তো আমি, ভাল নাম ছায়ানট!”

তার পাশে ছিল কাগজের নৌকোটা

চেঁচিয়ে বলল, “গিলিগি ওকাকি পট!”

 

এ ভাষায় আমি কথা বলতাম বটে!

ভুলে গেছি কবে, ওর মনে আছে বেশ!

তপেন বলত, “এ ভাষাটা বিচ্ছিরি!”

ঝগড়াঝাঁটির হত খুব একশেষ।


 

 

আহাহা, ওই যে লালরঙা ধারাপাত

কী কঠিন ছিল, পাতাগুলো মুড়মুড়ে!

বেণু ছিঁড়েছিল সহজপাঠটা ওই

বের করে আমি আঠায় দিচ্ছি জুড়ে।

 

লাল নীল সাদা তিনখানা মারবেল

গড়ান খাচ্ছে বক্সের নীচটায়

এগুলো হারিয়ে খুড়তুতো ভাই নিতু

সেদিন তার কী কান্না, থামানো দায়!

 

মাথা ভাঙা ওই ঝরনা কলম আর

লাল লাট্টুটা পড়ে আছে চুপ করে,

মেঝের উপর এগুলো সাজাতে দেখি

পৌঁছে গিয়েছি ছেলেবেলাকার ভোরে।

 

বড় হতে-হতে কত কী হারায় জানি

একটা জিনিস হারায় না কোনো ফাঁকে

সবাই জানে না, ছেলেবেলা চিরদিন

ছেলেবেলা হয়ে অমলিন জেগে থাকে।

 

বাড়ির লোকেরা ফিরে আসবার আগে

ঝটাপটি করে তুলে রেখে দেব সব।

একলা হলেই রঙিন সে ছেলেবেলা

কিচিমিচি করে করুক না কলরব!






·         

 


·          


 



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন