একটি ধর্ষিতা মেয়ে'র কাহিনি
সন্দীপ রায়
সেই মেয়েটি, হ্যাঁ সেই মেয়েটির
নিথর দেহ পড়েছিল পচা খালের পাশে ,
নোংরা জল থেকে তোলা হল দেহ
সারা গায়ে ডুমো-ডুমো মাছির গুঞ্জন ।
ভিড়ের মধ্যে কেউ কেউ শিউরে ওঠে
কেউ-বা নাকে রুমাল চেপে-
শুকনো পাতার দল হাওয়ায় উড়ে
জমা হয়েছে বুকের কাছে
মেয়েটির শরীরের শেষ আচ্ছাদন,
ওলম্পটের দল শেষ বস্ত্রটিও কেড়ে নিয়েছে,
যারা শুধু খোলসের আড়ালটুকু বোঝে ।
আম জনতা একবার নগ্ন মেয়েটিকে দেখেই
চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছে
শত চোখও মেয়েটিকে শনাক্ত করতে পারছে না ,
শুধু এক পাগল ভিড়ের মধ্যে খিলখিল হাসছিল ,
এই মুহূর্তে হাসিটা অনর্থক হলেও
আমার মনে হচ্ছিল পাগলাটাই ঠিক ।
আমারা ভীরু, কাপুরুষ--আমাদের ক্ষমতা সীমিত
বড় জোর একটা শোক মিছিল,সেমিনার -
মোমবাতি জ্বালিয়ে পথে হাঁটতে পারি
সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে টিভির পর্দায় চোখ-
সঞ্চালকের আঙ্গুল উচিয়ে তর্জন-গর্জন
জ্ঞানী-গুনী মানুষের সারগর্ভ উপদেশ -
অজান্তেই কয়েক ফোঁটা চোখের জল-
এর বেশি আর কী করতে পারি!
অথচ এই আমরা বুক বাজিয়ে বলতে পারিনা
আমারাও সেই ঘাতক দলেরই একজন ,
পথে-ঘাটে কত মেয়েকে কটূক্তি করেছি
অন্ধকার রাস্তায় হাত ধরে টেনেছি
গাঢ় অন্ধকারে আরও সাহসী হয়েছি ,
আর এখন,এই নারকীয় পরিবেশে
চিনতে না পারার ভান করছি
নাগরিক জীবনের যত ধুলো ময়লা
এক ফুঁয়ে গা থেকে ঝেড়ে
এখন ন্যাকা সেজে ট্রাউজার টি সার্টের ভদ্রলোক !
কেন,কেন ধিক্কার জাগে না মনে
কেন বিবেক জাগ্রত হয়না আমাদের ?
নারী দিবসে মঞ্চ সাজানো এই হাতেই নারী নিগ্রহ!
আবার এই মুখেই নারীবাদী শ্লোগান, ছিঃ!
মেয়েটিকে সাদা কাপড়ে মুড়ে ভ্যানে তোলা হল এরপর লাশকাটা ঘরে লাশ হয়ে
টেবিলে চিৎ হয়ে শুয়ে থাকবে সারারাত ,
ধারাল ছুরির ফলা সারা শরীর তন্নতন্ন করে খুঁজবে
কোথায় লুকিয়ে আছে চির নিদ্রার কারণ ।
অথচ এই দেহপল্লবে কত নামীদামি প্রসাধন
শরীরী জেল্লা - পাঁচজনের থেকে আলাদা ...
হায় পৃথিবী, হায় রে চিল শকুনের দল-
নারী কি ভাগাড়ের মৃত জীব-জন্তু!
ইচ্ছে মত ছিঁড়ে খুঁড়ে খাবে ?
আমার একহাত মোটর সাইকেলের হ্যান্ডেলে
অন্য হাতে মোবাইল ফোন
এই মুহূর্তের ব্যস্ততম নাগরিক ,
ঘন ঘন চোখ মেয়েটির দিকে -
স্মৃতির অতলে খুঁজে দেখি, কোথায় যেন দেখেছি।
আমার শরীর পাক দিচ্ছে, গা দোলাচ্ছে
মাথার উপর আকাশ দুলছে
পা জড়িয়ে যাচ্ছে মাটির গভীরে
অথচ এই হাতেই নারী নিগ্রহ, নারীমেধ যজ্ঞ--
দশ আঙ্গুল খেলে বেড়িয়েছে
মেয়েলি শরীরের ঘর-বারান্দা
ছুঁয়েছি গোপন কক্ষ ,
তারপর ,সুখ সাগরে অজানার অন্ধকারে।
এই সেই হাত -মায়ের হাত ধরা হাত
এই সেই হাত- বোনের সাথে খেলা খেলা হাত
কৈশোরের প্রথম প্রেমের আলতো ছোঁয়া হাত
বয়সের ডালে-ডালে শিমূল পলাশের পাপড়ি ছড়াতেই
অসংখ্য মৌমাছি ,প্রজাপতির নিঃশব্দ আনাগোনা-
অগণন হাতের ভিড়ে কোন্ হাত ঘেঁটেছে শরীরী ফসল
সেই স্মৃতি,স্মৃতির অতলেই স্থির
কতগুলো যন্ত্রণার দাউ-দাউ আগুন আমার চারপাশে
চাপা গুঞ্জন কানের দু'পাশে
ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেলছে স্মৃতির ঝাঁপি
কানের কাছে মেয়েলি ফিসফাস:
আমাকে চিনতে পারছো, আমি সেই মেয়ে
যার পালকের আড়ালে তাল-তাল মাংসপিণ্ড নয় - এক মন আছে
তাকে তুমি খুঁজে পেলে না !
হায় পুরুষ!আমার নাড়ি ছেঁড়া সেই পুরুষ
যার জন্ম দিয়ে আমি হয়েছি অনন্যা ।
আমি চিৎকার করে বলি,
তোমরা সত্যি করে বলতো,
কেউ কি চিনতে পারছো না মেয়েটিকে?
নাকি নিজেকে অপরাধী বলতে ভয় পাচ্ছ ?
নীরব দর্শক নীরবই থেকে যায়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন