অনন্যা দাশের দু'টি অণুগল্প
রূপান্তরণ
এলার সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল ডাক্তার রীডের মাধ্যমে। নিউ ইয়র্কের ক্লিনিকে নার্স ছিল সে, এখন আমাদের এই ছোট মার্কিন গ্রামে এসেছে। যে রকম সুন্দরী সেই রকম বুদ্ধিমতী। সব কাজ নিমেষের মধ্যে করে ফেলে সে। সবাই ওর কথাবার্তায় এবং কাজে মুগ্ধ।
ডাক্তার রীডের বয়স হয়েছে, উনি মজা করে বলেন, “আমার রুগিরা কেউ আমাকে চায় না! তারা সবাই এলার ভক্ত! সবার মুখে শুধু এক কথা, এলা কখন আসবে?”
ভারি ভাল লেগেছিল আমার মেয়েটাকে। সুন্দরী হলে কী হবে, এতটুকু অহঙ্কার নেই। ওর লাল টুকটুকে ঠোঁটে সব সময় হাসি লেগেই আছে! মাঝে মাঝে দেখা হলে অনেক কথা বলে সে। ছোটবেলার কথা, মা বাবার কথা, আরো কত কী।
ওর কাজ করার ক্ষমতা দেখে সবাই থ, আমিও। এতটুকু আলসেমি নেই! ও বড় শহরের কোন বড় হাসপাতালে গেলে অনেক বেশি উপায় করতে পারত।
ওকে কথাটা বলতে বলল, “জানো, আমি আগে যখন নিউ ইয়র্কে ছিলাম তখন অনেক বেশি মাইনে পেতাম কিন্তু আর ফিরে যাব না। তখন আমি প্রচন্ড কুঁড়েও ছিলাম অবশ্য। মানে যাকে বলে প্রোকাস্টিনাটার! সব কাজ পরে করার জন্যে রেখে দিতাম। একটা ভয়ানক ঘটনার জন্যে এখন কিন্তু বদলে গেছি। । আমি মনে করি ওটাই ছিল আমার ওয়েক আপ কল!”
হঠাৎ লক্ষ করলাম ওর মুখ থেকে হাসিটা মিলিয়ে গেছে! কিছু একটা মনে করে মুখটা বেশ থমথমে।
আমি একটু ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “কী হয়েছিল?” এরা অনেক সময় ব্যক্তিগত ব্যাপারে হস্তক্ষেপ পছন্দ করে না।
এলা কিন্তু বলল, “ওখানে আমি যে জায়গাটায় থাকতাম সেই পাড়াটা মোটেই ভাল ছিল না। একটা মদের আড্ডা ছিল সেখানে। সেই বারটার জন্যেই পাড়াটা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। আমি ছোট শহরে মানুষ। মা আমাকে কত বার বলেছিলেন, ‘নিউ ইয়র্কে যেও না!’ আমি শুনিনি। পরে বলেছেন, ‘তোমাদের এলাকাটা ভাল না, ওখানে থেকো না’ কিন্তু কুঁড়েমির ঠেলায় আমি আর বাড়ি বদল করিনি। মা এও বলেছেন, ‘বড় শহরে ভাল লোক খারাপ লোক সবই বেশি। ব্যাগে অন্তত একটা লঙ্কা গুঁড়োর স্প্রে রেখো।’ সেটাও কুঁড়েমির ঠ্যালায় কেনা হয়নি। একদিন রাতে যখন বাড়ি ফিরছিলাম তখন আমার উপর হামলা হল।”
আমি আঁতকে উঠলাম, “সে কী!”
“সেদিন হাসপাতাল থেকে বেরোতে একটু বেশি রাত হয়ে গিয়েছিল। ট্রেন স্টেশান থেকে হেঁটে বাড়ি ফিরছি এমন সময় চারটে লোক আমাকে ঘিরে ধরল! মাতাল হলে কী হবে তাদের গায়ে অসুরের মতন শক্তি! আমি ছাড়িয়ে পালাতে পারলাম না!”
আমি আর ভাবতে পারছিলাম না, লোকগুলো কী তাহলে ওকে...
আমার মনের কথা বুঝতে পেরে এলা বলল, “নাহ, ওরা আমাকে রেপ করতে পারেনি! পারেনি সেটা শুধুমাত্র আমার উপস্থিত বুদ্ধির জন্যে। দাঁত দিয়ে মুখ চাপা হাতটাকে কামড়াতে সেই হাতটা মুহূর্তের জন্যে সরতেই আমি হাঁউমাঁউ করে চিৎকার করে উঠেছিলাম ‘আমাকে ছুঁয়ো না আমার এড্স আছে’!”
ওরা বিশ্বাস করছে না দেখে ব্যাগ থেকে টারা কুপারের মেডিকাল রিপোর্ট টা বার করে ওদের সামনে মেলে ধরলাম।
তাতে বড়বড় করে লেখা ছিল ২৪ বছরের মহিলা এইচ আই ভি পজিটিভ। টারা মারা গিয়েছিল আগের সপ্তাহে, শরীর বেচে সংসার চালাত বেচারা! কিন্তু তার ফাইলটায় কাজ করা হয়নি। পরদিন ইন্সপেকশান তাই কাজ শেষ করতে ফাইলটাকে এনেছিলাম সাথে। ভগবান আমাকে রক্ষা করলেন মনে হয়। লোকগুলো ওটা দেখেই সুরসুর করে পালাল। ভীষণ ভয় ঢুকে গিয়েছিল মনে বলে অনেকদিন থেরাপি চলেছিল। তারপর থেকে আমি আর কোনদিন কুঁড়েমি করিনি। মার কথা শুনে বাড়ি বদল, শহর বদল সব করেছি। এখন আমার ব্যাগে আর কিছু থাকুক না থাকুক একটা লঙ্কাগুঁড়োর স্প্রে সব সময় থাকে!”
মরূদ্যান
থেলমা আজ একটু দেরি করে কাজে ঢোকার মুখেই ওর টিম লিডার বেলিন্ডার সাথে দেখে হয়ে গেল! থেলমা কিছুদিন হল নার্স হয়ে একটা হাসপাতালে ঢুকেছে। ওর বস বেলিন্ডা থেলমাকে দু চক্ষে দেখতে পারে না। নার্সিং পড়া শেষ করে চাকরি পেতে কী আনন্দই না হয়েছিল থেলমার। সে মনে করেছিল কত লোকের সেবা করতে পারবে কিন্তু বেলিন্ডা তার সে সব স্বপ্ন ঘুচিয়ে দিয়েছে। পদে পদে ওর কাজের দোষ ধরে, রেগে কথা বলে। দুবার ডাক্তারদের কাছেও নালিশ করেছে ওর নামে। থেলমার মনে দৃঢ় ধারণা যে ওর গায়ের রঙের জন্যেই বেলিন্ডার ওই রকম আচরণ। ঘানার মেয়ে থেলমা মার্কিন মুলুকে চাকরি করতে এসেছে। ওর গায়ের রঙ মিশমিশে কালো আর বেলিন্ডার রঙ ধবধবে সাদা, চুল সোনালি। তিরিশ বছর হল এই হাসপাতালে চাকরি করছে, অভিজ্ঞতার শেষ নেই। অন্য কোন নার্সের সাথে কিন্তু ওর ব্যবহার ওই রকম নয় কারণ থেলমাই ওদের ইউনিটের একমাত্র কৃষ্ণাঙ্গ!
ওকে দেখেই বেলিন্ডা চেঁচিয়ে উঠল, “কোথায় ছিলে তুমি? তোমার পেশেন্টকে ঘরে দেওয়া হয়ে গেছে! তোমাকে বলেছি না সকাল আটটার মধ্যে আসতে! তোমার কী দায়িত্বজ্ঞান বলে কিছু নেই?”
থেলমা কোন রকমে ইউনিফর্মটা চাপিয়ে ছুটে গেল রুগির ঘরে।
পেশেন্ট একজন বয়স্ক মানুষ। কোমরের ব্যথায় কাতর, হিপ রিপ্লেসমেন্ট অপারেশান হওয়ার কথা। ঘরে ঢুকে হাসি মুখে ‘গুড মর্নিং’ বলল থেলমা। ওমা ওকে দেখেই লোকটা তারস্বরে চেঁচাতে লাগল!
থেলমা ঘাবড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী হল? লাগছে? আমি তোমার নার্স, আমার নাম থেলমা।”
লোকটা গম্ভীর স্বরে বলল, “আমার ঘর থেকে বেরিয়ে যাও! আমি চাই না কোন কালো মহিলা বা পুরুষ আমাকে স্পর্শ করুক!”
ওর কথা শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেল থেলমা! ওর ২৮ বছরের জীবনে কেউ ওকে মুখের ওপর ওই রকম কথা বলেনি! এই লোকটা মনে হয় দাস প্রথা উঠে যাওয়ার আগের সময় থেকে এসেছে!
লোকটা চেঁচাচ্ছে, “যাও তোমার সুপারভাইজারকে ডেকে নিয়ে এসো! তুমি আমার গায়ে খবরদার হাত দেবে না!”
থেলমা ঘাবড়ে গিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে বেলিন্ডাকে ডাকতে গিয়ে দেখল চেঁচামেচি শুনে সে নিজেই ওখানে এসে হাজির।
“কী হয়েছে? পেশেন্ট এত চেঁচাচ্ছে কেন? এসো আমার সঙ্গে!” বলে বেলিন্ডা রুগির ঘরে ঢুকল।
থেলমা অসহায় ভাবে পিছন পিছন গেল।
“সুপরভাত! শুনলাম আপনি চেঁচাচ্ছিলেন। কী হয়েছে জানলে আমরা প্রতিকারের ব্যবস্থা করব।”
লোকটা বলল, “যাক, সুবুদ্ধি হয়েছে তাহলে! ওই মেয়েটা আমার গায়ে হাত দেবে না!”
“কেন জানতে পারি?”
“আমি চাই না কোন কালো লোক আমাকে স্পর্শ করুক!”
বেলিন্ডার মুখ ভাবলেশহীন। কী ভাবছে বোঝা যাচ্ছে না, বলল, “আমাদের এখানে সব ধরনের লোকই কাজ করে। বেশ কিছু ভালো অ্যাফ্রো ডাক্তারও আছেন।”
“না, না, খবরদার! ওরা কেউ আমার কাছে আসতে পারবে না! আপনি দয়া করা সেটা দরজার বাইরে লিখে দিন!”
বেলিন্ডার চোওয়াল শক্ত হল, “আমি সে রকম কিছুই করব না মিস্টার জেনকিন্স! আমি আপনার আত্মীয়দের ফোন করে জানিয়ে দিচ্ছি। আপনি এখান থেকে যেতে পারেন! আমরা আপনার মতন অন্ধ গোঁড়াদের চিকিৎসা এখানে করি না! বিদায়!”
থেলমার চোখ দিয়ে জল গড়াতে লাগল।
ঘরের বাইরে গিয়ে বেলিন্ডা বলল, “তুমি ভাবছিলে আমি ওই পাগলের প্রলাপ শুনব? মোটেই না! আর শোনো মেয়ে তোমার গায়ের রঙ লাল, নীল না কালো তাতে আমার কিছু যায় আসে না! আমার টিমের সব নার্সদের কাজ সব থেকে ভালো হতে হবে! যতদিন না তারা তাদের কাজে পার্ফেক্ট হচ্ছে তারা আমার কাছে বকুনি খাবেই! তবে তোমার পার্ফেক্ট হতে আর বেশি দিন নেই। যাই গিয়ে পাগলটার আত্মীয়দের ফোন করি। ডাইভারসিটি অফিসকেও জানাতে হবে শেষে কোন গন্ডগোল না বাধায় লোকটা।”
থেলমা অবাক হয়ে বেলিন্ডার হন হন করে হেঁটে যাওয়া দেখল। চারিদিকের আলো যেন আরো বেশি উজ্জ্বল মনে হল ওর।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন