মাইকেল মধুসূদন দত্তঃঃ প্রসঙ্গ মৃত্যু বার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি
- দীপক বেরা
মাইকেল মধুসূদন দত্ত ছিলেন বাংলা সাহিত্যের এক প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্ব। তিনি ছিলেন চিরাচরিত বাংলা সাহিত্যের নবজাগরণের জনক। বাংলায় চতুর্দশপদী কবিতা রচনা করে তিনি বাংলা কবিতায় নবদিগন্তের সূচনা করেছিলেন। বাংলায় নাটক ও প্রহসন রচনার সূচনাও করেছিলেন সেই তিনিই।
১৮২৪ সালের ২৫শে জানুয়ারি যশোহরের কেশবপুর উপজেলায় সাগরদাঁড়ি গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত কায়স্থ পরিবারে মধুসূদন জন্মগ্রহণ করেন। বাবা রাজনারায়ণ দত্ত ছিলেন কলকাতার সদর দেওয়ানি আদালতের খ্যাতনামা উকিল। মা জাহ্নবি দেবী ছিলেন জমিদার কন্যা। মধুসূদন ছিলেন বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান।
মায়ের কাছেই শুরু হয় তাঁর লেখাপড়ার প্রথম পাঠ। মায়ের হাত ধরেই পরিচিত হন নিজধর্ম, রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণের সাথে। অচিরেই গৃহশিক্ষা শেষ করে তিনি পরবর্তী শিক্ষা শুরু করেন এক ইমাম সাহেবের কাছে।ছোটবেলা থেকেই মধুসূদন বাংলা, আরবি ও ফারসি ভাষায় দক্ষ হয়ে ওঠেন। পরবর্তী কালে তিনি তেরোটি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। মাত্র তেরো বছর বয়সে তাঁকে যশোর ছেড়ে কলকাতায় চলে আসতে হয়। কলকাতায় স্কুল শিক্ষা শেষ করে তিনি হিন্দু কলেজে ভর্তি হন। এখানেই সাহিত্যের প্রতি তাঁর প্রগাঢ় অনুরাগ জন্মায়। হৃদয়ে মাথা চাড়া দেয় বিদেশযাত্রা ও বিশ্বকবি হওয়ার অদম্য বাসনা। পিতৃপুরুষের সনাতন হিন্দু ধর্মের প্রতি তাঁর একপ্রকার অবহেলার সঞ্চার হয়। এই অবজ্ঞা ও অবহেলাই তাঁকে হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করতে উৎসাহিত করে তোলে। ১৮৪৩সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি ওল্ড মিশন চার্চে তিনি খ্রিস্টান ধর্ম এবং মাইকেল নাম গ্রহণ করেন। এই নিজ ধর্ম ও কূলত্যাগ তাঁর পক্ষে সুখকর হয়নি। আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব এমনকি বাবা-মাকেও তাঁকে হারাতে হয়েছিল। পিতার ত্যাজ্যপুত্র হওয়ার কারণে জমিদারি থাকা সত্ত্বেও চরম অর্থাভাবের মধ্য দিয়ে তাঁর জীবন কাটে।
হিন্দুধর্ম ত্যাগ করার পর আর হিন্দুস্কুলে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া কবির পক্ষে সম্ভব হয়নি। তিনি শিবপুরের বিশপস কলেজে ভর্তি হন। রাজনারায়ণ পুত্রকে ত্যাজ্যপুত্র করলেও আরও চার বছর পুত্রের ব্যয়ভার বহন করেছিলেন। পড়াশোনা শেষ করে কবি চরম আর্থিক সঙ্কটে পড়ে গিয়েছিলেন। ভাগ্যান্বেষণের জন্য তিনি মাদ্রাজ পাড়ি দেন। সেখানে তিনি একটি স্কুলে ইংরেজির শিক্ষকতার চাকরি নেন। এইখানে থাকাকালীন তিনি 'দ্য ক্যাপটিভ লেডি' নামক কাব্য রচনা করে ফেলেন। ইংরেজি সাহিত্যে আগ্রহী হলেও এই সুবিশাল সাম্রাজ্যে তিনি বিশেষ সুবিধা করতে পারেননি। ভাগ্যের খোঁজে তিনি সুদূর ফ্রান্সেও ছুটে গিয়েছিলেন। কিন্তু নিজের দেশ ও ভাষার মতো কেউ তাঁকে সেই আশ্রয় দেয়নি। শেষপর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের চর্চার মাধ্যমেই তাঁর সাহিত্যের অমৃত আস্বাদনের স্বাদ পূরণ হয়। বাংলা সাহিত্যও তাঁকে পেয়ে ধন্য হয়। একে একে খনি থেকে প্রথমবারের মতো উঠে আসে 'শর্মিষ্ঠা', 'পদ্মাবতী', 'কৃষ্ণকুমারী'র মতো নাটক। তিনিই প্রথম বাংলায় প্রহসন নাটক রচনা করলেন 'বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ', ও 'একেই কি বলে সভ্যতা'। 'পদ্মাবতী' নাটকে তিনি প্রথম অমিত্রাক্ষর ছন্দ প্রবর্তন করেন। তাঁর কাব্যগ্রন্থের মধ্যে আছে 'তিলোত্তমাসম্ভব', 'মেঘনাদ বধ', 'ব্রজাঙ্গনা' ও চতুর্দশপদী কবিতাবলি।
ব্যক্তিগত জীবনে তিনি মাদ্রাজে থাকাকালীন রেবেকা ম্যাকটিভিস নামে এক যুবতীকে বিয়ে করেছিলেন। কিন্তু সেই দাম্পত্যজীবন বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। বিবাহ-বিচ্ছেদের পর তিনি পুনরায় বিয়ে করেন সোফিয়া (মতান্তরে হেনরিয়েটা) নামক এক ফরাসি নারীকে। এই বিবাহ কবির আজীবন স্থায়ী হয়েছিল। তাঁর তিন সন্তান শর্মিষ্ঠা, মিল্টন ও নেপোলিয়ন।
ভাগ্যান্বেষণে স্ত্রী সন্তানদের দেশে রেখে তিনি ইংল্যান্ড পাড়ি দিয়েছিলেন। অভাব ও বর্ণবাদের কারণে তিনি ইংল্যান্ড ছাড়তে বাধ্য হলেন। সেখান থেকে ফ্রান্সের ভার্সাই নগরীতে যান এবং চরম অর্থাভাবেও তিনি সেখানে আইন শিক্ষা শেষ করেছিলেন। তাঁকে সেই সময়ে সাহায্য করেছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। আরও অনেকের সাথে সাহিত্যের এই কান্ডারীকে তিনি দুর্দিনে আপ্রাণ সাহায্য করেছিলেন। শেষজীবনে কবির চরম আর্থিক সঙ্কটের মধ্যে দিন কাটে। কলকাতায় কিছুদিন আইন ব্যবসার চেষ্টা করেও সফল হননি। এদিকে মধুসূদনের সমস্ত পৈতৃক সম্পত্তি আত্মীয়স্বজন দখল করে নেয়। জমিদার পুত্র হয়েও স্ত্রীর চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে তিনি অসমর্থ হয়েছিলেন। 1873 সালে কলকাতার হেনরি রোডের বাড়িতে শয্যাশায়ী স্ত্রীর পাশের কক্ষে নিদারুণ রোগ ভোগ করতে থাকেন তিনি। শেষপর্যন্ত একটি দাতব্য চিকিৎসালয়ে তিনি আশ্রয় নিয়েছিলেন। স্ত্রীর মৃত্যুর তিনদিন পর অবশেষে ১৮৭৩সালের আজকের দিনে অর্থাৎ ২৯শে জুন অত্যন্ত প্রতিভাধর এই কবির চরম উদাসীনতায় আর্থিক সঙ্কটের মধ্যে জীবনের কঠোর সংগ্রামের পরিসমাপ্তি ঘটে।
কবি যথার্থই বলেছিলেন, "আমি এক সকালে উঠে নিজেকে সফল হিসেবে পাইনি, এই কাব্যের সফলতা বহু বছরের কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমেই সম্ভব হয়েছে।"
সত্যিই জীবনের উচ্ছ্বাস, আবেগ, বিশ্বাস, ঠিক বা ভুল সব নিয়েই এক কঠোর সাধনার বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবন ছিল এই মহাকবির।
আজ, তাঁর প্রয়াণ দিবসে মহাকবিকে জানাই আমাদের শতকোটি প্রণাম।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন