ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণনের জন্মদিন উপলক্ষে আমরা ভারতবাসী এই দিনটিকে তাঁকে এবং সমগ্র শিক্ষক জাতিকে শ্রদ্ধা জানিয়ে থাকি। আসলে শিক্ষা আনে চেতনা। সেই চেতনার আলোকে রাধাকৃষ্ণনের মতো মহান শিক্ষক কে স্মরণ করে এগিয়ে যাব। এগিয়ে আসবেন সেইসব শিক্ষক যাঁরা এখনো ছাত্র তৈরির কাজে ব্রতী আছেন। তাঁরাই এই দিবসে প্রণম্য।
শিক্ষক দিবসে এই প্রার্থনা করি ছাত্র শিক্ষক মিলিত প্রয়াসে নিশ্চিত একদিন নতুন সূর্য উঠবে।
একজন আদর্শ শিক্ষক ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণনের জন্মদিন ৫ই সেপ্টেম্বর।আর এই দিনটি ভারতে শিক্ষক দিবস রূপে পালিত হয়। আজ ৫ই সেপ্টেম্বর।আজ এই শিক্ষক দিবসে কবিতাঞ্জলি দিয়ে তাঁর চরণে জানাই বিনম্র প্রণাম ও শ্রদ্ধাঞ্জলি।
প্রথম যেদিন গেলাম স্কুলে
আদর করে কোলে তুলে
নিলেন আমায় যিনি,
আজও কয়েক দশক পরে
তাঁকে যে খুব মনে পড়ে
তাঁর কাছে তে ঋণী।
স্কুলের সীমানা পার করে
কলেজে আমি, কান ধরে
তখনও তাঁর শাসন!
দু’চোখে আঁধার ভবিষ্যৎ
তিনি দেখালেন সঠিক পথ,
বুকে তে তাঁর আসন।
হতে হতে ঘোর সংসারী
চুল উঠে যায় পাকে দাড়ি
জীবন যুদ্ধে কাবু!
এখনো কাছে ডেকে নেন
ঘুরে দাঁড়ানোর শিক্ষা দেন,
প্রণাম অজিত বাবু।
এক একজন শিক্ষক এক একটা বৃক্ষ
প্রতিটি ছাত্রজীবন গড়ে ওঠে এই বৃক্ষ ছায়ায়
অন্কুর থেকে ফুলে ফলে মায়া মমতায়।
সমুদ্র পাড়ে লাইট হাউসের মত
অতন্দ্র প্রহরী না হলে,দূরবর্তী ভবিষ্যৎ অন্ধকার ।
আমার শিক্ষক এখন এক রূপকথা—
একদিন সুকোমল মনের দুয়ার খুলেছিল
তাঁর রূপকথার নীতিশিক্ষায়,চিন্তার ধারাপাতে।
ধীরে ধীরে চারাগাছটি মহীরুহ হয়
নিঃশব্দ সূর্যের নানা আলোর অবগাহনে।
আমাদের ছিল ইস্কুল বাড়ি
সামনে দাঁড়িয়ে কত সারি সারি
আকাশমণি বা সোনাঝুরি গাছ
বর্ষার জল গরমের আঁচ।
সামনের মাঠে কত কলরব
মাটির মায়ায় গূঢ় অনুভব
পাঁচ তারিখের সেপ্টেম্বর
প্রতীক্ষাতে থেকে একটি বছর।
গুরুকে প্রণামে অমৃতের সুখ
ছাত্রদলের উজ্জ্বল মুখ
নিজ হাতে গড়া কত উপহার
মায়াবন্ধনে স্মৃতি উপচার ।
হে গুরু, তোমার অসীম করুণা
তুমি না থাকলে শুরুই হত না
এই জীবনের পথে নামা ওঠা
সংসার-মাঝে ফুল হয়ে ফোটা।
অনন্ত অন্বয়
রাখহরি পাল
মোটা ফ্রেমের বাইফোকালে আমরা যথারীতি
পিতার বয়স দ্বিগুন হলে পুত্র ধরি এক্স
নৌকা ছোটে স্রোতের যখন বিপ্রকর্ষ গতি
সময় মাপতে স্যারের আঙুল দূরন্ত এক্সপ্রেস।
সিঁড়ির পাশে সাত নম্বর, গণিত স্যারের ক্লাস
ভাঙতে ভাঙতে গড়তে শেখান সাঁতরে ওঠা নদী
উল্টোমুখী ট্রেনের ক্ষেত্রে লব্ধি বেগে প্লাস
বিয়োগ করি একই দিকে ছুটতে থাকি যদি।
আমরা ছুটি স্যারের সাথে দৌড়াতে দৌড়াতে
উন্নতি কোণ, ছায়ার দৈর্ঘ্যে পাহাড় মাপি ট্যানে
নৌকা ছোটে ট্রেনও ছোটে সমান্তরাল পথে
পাহাড় ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা রয় আলোর সন্ধানে।
আর্য ভারত গুরু শিষ্যের মধুর রসায়ন
গুরুগৃহে প্রদীপ জ্বেলে ভুল করেনি তা
সেই ধারাতে সঞ্চারিত আজো জ্ঞানাঞ্জন
প্রাচীন, মধ্য, কি আধূনিক হয় নি অন্যথা।
১৯.
স্যার শব্দটা শুনলে, ব্ল্যাকবোর্ডে চক খসখস
গম্ভীর গলাখাঁকারি লিকলিকে বেত গোঁফ কালো ফ্রেম
তার পেছনে গভীর জ্বলজ্বলে চোখ...
প্রাইমারি স্কুলে সাদা ধুতি পরা স্যার বেশ মনে পড়ে
অতীত কুয়াশা ঘেরা সাদা স্কুলবাড়ি নইলে মানায় নাকি !
তারা গরীব মাষ্টার হয়ে জীবন শুরুর পর, টিকে
ছিলেন বুনো রমানাথের উত্তরাধিকারী হয়ে ।
হাইস্কুলে উঠে ঈষৎ মস্করা – অঙ্কের খেয়ালি স্যার
একবার চোখে দেখে জ্যামিতির ভুল দেগে দেন
জীবন বিজ্ঞানের জটিল সব টার্ম, কাব্য রস
ইতিহাসের কাহিনী, ইংরাজিতে গালমন্দ, ম্যাপ মুছে যায় ।
উচ্চতে দু’চার টানে কটু স্বাদ রসায়নে ফিজিক্স সমুদ্র
প্রাইভেট পড়া কোচিং সেন্টার পেরিয়ে কার টানে ভাসে তরী..
কে ভেড়াবে কুলে স্যার আপনারা ছাড়া !
কলেজে এসে বেয়াড়া, পাস ক্লাস কাটো, খোলা হাওয়া আস্কারা
দু’চারটে কোর্স পেরিয়ে আসার পরে স্বপ্ন দেখি
সেইসব ভয়ঙ্কর পরীক্ষা এবং উতরে যাওয়ার খিদে,
কিছু ডিগ্রি নিয়ে নানা ঘাটে জল খাওয়ার পর
অক্ষমতা বোঝানোর কোনও শিক্ষক পেলাম না এ জীবনে
রিইউনিয়ানে গিয়ে আর কী করব, নিজে পড়াতে বসলে
হারিয়ে ফেলছি হাতে লেখা নোট মূল্যবান কথাদের !
২৫.
তিনি 'উত্তরসাধক'
তুলসীদাস মাইতি
কে শেখে কে বা শেখায়!
নদী- পাহাড়- ঝর্ণা কিংবা চড়ুই পাখি,কাঠ ঠোকরার ঠোঁট-এসবই আমায় পড়িয়েছে রাত্রিদিন।
মাটি কতটা বৃষ্টি শুষে নিলে লাঙ্গল চলে মাঠে
কব্জিতে কত মাত্রার টানে প্রতিকূলেও নৌকো চলে এসব গণিত আমি শিখিনি। প্রকৃত জানার কাছে নত হওয়াও হয়নি শেখা।
অসুখের রাতে মায়ের হাত মাথায় থাকলে যন্ত্রনা
কীভাবে কমে!
বাবার হাত ধরে মাইলের পর মাইল হেঁটে যেতে যেতে
ছেলে শিখে নেয় সংখ্যার হিসেব আর পথের বিবিধ বাঁকের গভীরতা।
সীমান্তে যুদ্ধ, আধপোড়া দেশে আধছাওয়া ঘরে ভয় পাহারা দেয়। তাজা তরুণ বাজি রেখে যায় তুচ্ছ জীবন- এ প্রেম শিখিয়েছে কারা?
বইছুট বালিকারা বাঁশি শুনে নয়, কঠিন তর্জনীর ধমকে
ছুটে যায় ঝকঝকে বাসনের স্তুপে। শূন্য থালায় দেখে নেয় ঘামে ভেজা মুখ!
এভাবেই বেঁচে থাকার স্রোত।
তবুও নদীর মতো পাঠশালা চলে। বয়ে যায় বিদ্যাধৌত জল। পাঠক্রমের সিঁড়ি বেয়ে সভ্যতা উঠে যায়।
শত শত বছর ধরে বর্ণপরিচয়ের গান শিখি, শিখি নব-ধারাপাত।
এসবের অনেকটাই তো শেখান প্রকৃতি- সংসার মাতৃ-পিতৃ বৃক্ষের ছায়া। আর পাশে দাঁড়িয়ে আছেন আর একজন যিনি, তিনি তো বাকিটা শেখান।
'উত্তরসাধক',শিক্ষক।
২৬.
জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়
দৃশ্যপটের রঙিন ছবি কে যে সাজায় কে যে ভাঙে
আমরা ভাবি সবকিছু ঠিক,বদল কোথায় যায় না দেখা
ঝড়-বাদলে মেঘলা দিনের ফাঁকে ফাঁকেই শিমুল রাঙে
হঠাৎ দেখি শীতের পরেই প্রবল বানের সফেদ রেখা।
কখন এসে ফাগুন বলে,আর দেরি নয় ভাগো ভাগো
শীতের বেলা শেষ হয়েছে আমার পালা পড়েছে ভাই
আচম্বিতে নতুন বছর ঘণ্টা বাজায় জাগো জাগো
নতুন নাটক শুরু হবে,মঞ্চ সাজাও সাজো সবাই।
মগ্ন ছিলেন বেখেয়ালে সময় গেছে কাজে কাজেই
কেমন করে পাখির ডানায় বিকেল আসে তলে তলে
আপন ভেবে জগৎটাকে দুঃখ পেলেন মাঝে মাঝেই?
সেইগুলি আজ মুক্তো হয়ে মানিক হয়ে দারুণ জ্বলে।
পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখা জীবন,আহা সাধের জীবন
তোমার জন্য আনন্দ আর দুঃখ ব্যথা বরফ আগুন
স্মৃতির পাহাড় সামনে দাঁড়ায় এখন বাহার তখন ইমন
স্মৃতি নিয়ে সমাজ সাজান সৃষ্টি সুখে আবার জাগুন।
২৮.
আমার শিক্ষক
তপনজ্যোতি মাজি
অধ্যয়নকে সমিধ সংগ্রহ বলতেন আমার পিতামহ I
বলতেন , জ্ঞানের আগুনে অন্তরের হোমাগ্নি জ্বেলে
রেখো সারাজীবন I হোমাগ্নি শুদ্ধ করে অন্তর্লোক ,
হোমাগ্নিতে বিসর্জিত হয় অহংকার আর মনের কোণে
জমা অন্ধকার
পিতামহ আমার শিক্ষক I
গ্রামের বাড়িতে কাঠের আগুনে প্রজ্বলিত উনুনের পাশে
মায়ের হাতে বোনা আসনে বসে ব্যস্ত মায়ের রান্নার ফাঁকে
ফাঁকে আমার শ্লেট পেন্সিল নিয়ে বর্ণ লিখন ও বর্ণ পাঠের
শুরু I কলমের অক্ষর প্রবাহ আমাকে নস্টালজিক করে
নিভৃত সময়ে I
মা আমার শিক্ষক I
নদীসান্নিধ্যে কেটেছে ছেলেবেলা I নদীতীরে বসে বাবা গল্প
বলতেন রামায়ণ,মহাভারত ,ইলিয়াড ও ওডিসির I কখনও
উদাত্ত কণ্ঠে আবৃত্তি করতেন রবীন্দ্র কবিতা কিংবা মেঘনাদ
বধ কাব্য I নদী ,কবিতা এবং বাবা , সুন্দরের সঙ্গে পথচলার
সেই শুরু I
নদী ও বাবা আমার শিক্ষক I
প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয়, দীর্ঘ পথের দুদিকে
বোধিবৃক্ষের মতো দাঁড়িয়ে প্রণম্য শিক্ষকগণ I তাঁদের আলো
ছড়িয়ে আছে হৃদয়ে I বহুবর্ণ এই আলো শিখিয়েছে জীবন
এক জ্যোতির্ময় যাপন I আমার বোধের শান্ত আকাশে তাঁরা
এক একটি জ্যোতিস্ক I
এই জ্যোতিস্কগণ আমার শিক্ষক I
মনোলোকে তাঁর অবস্থান I তাঁর সঙ্গে দেখা হয়নি আমার I
অথচ পান্থজনের সখা তিনি I আমারও I চিত্ত যেথা ভয় শূন্য
উচ্চ যেথা শির I অন্তর মম বিকশিত করো , অন্তরতর হে
তিনিই তো শিখিয়েছেন না বলা বাণীর গভীরতা I তিনি জীবন
পথিক রবীন্দ্রনাথ I
রবীন্দ্রনাথ আমার শিক্ষক I
এই জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জন তুমি I শিখিয়েছো অনন্য জীবন বোধ I
চেতনার অসীমে যে উন্মেষ , সেখানে তোমার নীরব সঞ্চার I তুমি
আমার জন্মভূমির মতো শ্রেষ্ঠ পরম্পরা I এই অক্ষর জীবন , এই
সমানুভুতিবোধ তোমার অনিন্দিত দান Iএই শ্রদ্ধা ভালোবাসার ও
নিবিড় অনুভবের I
তুমি আমার শিক্ষক I
২৯.
আমার শিক্ষক
বিমল মণ্ডল
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন