বুধবার, ৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

আজ ৫ই সেপ্টেম্বর... অঙ্কুরীশা-র পাতায় প্রকাশিত হল... ৫ই সেপ্টেম্বর শিক্ষক দিবসে অঙ্কুরীশা-য় কবিতাঞ্জলি —।।Ankurisha।। E.Magazine।। Bengali poem in literature।।

   




ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণনের জন্মদিন উপলক্ষে আমরা ভারতবাসী এই দিনটিকে তাঁকে  এবং সমগ্র শিক্ষক জাতিকে শ্রদ্ধা জানিয়ে থাকি।  আসলে শিক্ষা আনে চেতনা। সেই চেতনার আলোকে রাধাকৃষ্ণনের মতো মহান শিক্ষক কে স্মরণ করে এগিয়ে যাব। এগিয়ে আসবেন সেইসব শিক্ষক যাঁরা এখনো ছাত্র তৈরির কাজে ব্রতী আছেন। তাঁরাই  এই দিবসে প্রণম‍্য। 

শিক্ষক দিবসে এই প্রার্থনা করি ছাত্র শিক্ষক মিলিত প্রয়াসে নিশ্চিত  একদিন নতুন সূর্য উঠবে।




একজন আদর্শ শিক্ষক ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণনের জন্মদিন ৫ই সেপ্টেম্বর।আর এই দিনটি ভারতে শিক্ষক দিবস রূপে পালিত হয়। আজ ৫ই সেপ্টেম্বর।আজ এই শিক্ষক দিবসে কবিতাঞ্জলি দিয়ে তাঁর চরণে জানাই  বিনম্র প্রণাম ও শ্রদ্ধাঞ্জলি। 




              

৫ই সেপ্টেম্বর শিক্ষক দিবসে অঙ্কুরীশা-য়  কবিতাঞ্জলি —   

       



কলমে--

১.জ্যোতির্ময় দাশ
২.দীপ মুখোপাধ্যায়
৩.তৈমুর খান
৪.গৌতম হাজরা
৫.সাতকর্ণী ঘোষ 
৬..বিকাশ ভট্টাচার্য 
৭.সুস্মেলী দত্ত
৮..অমিত কাশ্যপ
৯..অঞ্জন ভট্টাচার্য
১০.নাশির আহমেদ(বাংলাদেশ)  
১১.পাপড়ি ভট্টাচার্য
১২.মঙ্গল প্রসাদ মাইতি
১৩.সুবীর ঘোষ
১৪.অশোককুমার লাটুয়া
১৫.শুভঙ্কর দাস
১৬.অমিত গোলুই
১৭.শঙ্কর তালুকদার
১৮.রাখহরি পাল
১৯.স্বপন বিশ্বাস  
২০..চিত্তরঞ্জন সরকার
২১.শুভ্রাশ্রী মাইতি
২২.মনালিসা পাহাডী
২৩.দেবাশীষ মুখোপাধ্যায়
২৪.বৈদূর্য্য সরকার
২৫.তুলসীদাস মাইতি 
২৬.অসীম বিশ্বাস(মুম্বাই) 
২৭.জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়
২৮.তপনজ্যোতি মাজি
২৯.বিমল মণ্ডল 
৩০. বিষ্ণুপদ জানা
৩১.রঞ্জন ভট্টাচার্য 
                








১.
টম্যাটো  কাহিনী 
জ্যোতির্ময়  দাশ

অঙ্কের  স্যার ল-সা-গু র সমাধানের চেষ্টা করেছিলেন ব্লাকবোর্ডে
কোথাও ভুল হচ্ছিল কিছু,অঙ্কটার সঠিক উত্তর পাওয়া
যাচ্ছিল না সেদিন।এক সময় অঙ্ক থেকে মুখ ফিরিয়ে  আমাদের 
সকলকে বিস্মিত  করে স্যার বলেছিলেন, 'খালি পেটে একটা করে
পাকা টম্যাটো  খাবি তোরা সকলে।' বলতে বলতেই একটু
মুচকি  হেসে জহর কোর্টের  পকেট থেকে টুকটুকে  লাল একটা  টম্যাটো 
বারকরে  কামড় দিয়েছিলেন। আশ্চর্য, তারপর  একহাতে টম্যাটো 
আর অন্য হাতে চকখড়ি  ধরে অঙ্কের  উত্তরটা সহজে মিলিয়ে দিলেন। 
এসব আজ থেকে পঞ্চান্ন বছর  আগের কথা;দেশ তখন  সবে মাত্র
স্বাধীন হয়েছে।ইস্কুলে যেতাম আমরা সে সময় হাফপ্যান্ট  পরে,
ভেবেছিলাম  অঙ্কের  উত্তরের সঙ্গে পাকা টম্যাটোর বোধহয় 
কোনও যোগসূত্র  আছে,সময় মতো  টম্যাটো  হাতের কাছে থাকলে
কঠিন সমস্যা গুলোর ঠিকঠাক সমাধান  খুঁজে  পাওয়া যায় সম্ভবত! 


সেই থেকে  বিপাকে পড়লেই  আমি টম্যাটোর কথা ভাবতে  থাকি-
ব্যক্তিগত  যেকোনোও জটিল  সমস্যায় লাল একটা টম্যাটোর জন্যে
সারাজীবন  হন্যে হয়ে রাস্তায়  রাস্তায়  ঘুরে বেড়িয়েছি, 
আর কাকতালীয়  কিনা জানিনা, একটা  গোটা  টম্যাটো  হাতে এলেই
আপাত কঠিন  পারিবারিক  যন্ত্রণাগুলো  সহজ  হয়ে যায় বেশ।



আমাদের কলঙ্কিত এই জীবনযাত্রায় ইদানীং সমস্যার কোনও শেষ  নেই;
ভোটের বুথে যখন  দেখি নির্বাচন  তালিকায় নাম নেই আমার;
নাগরিকত্বহীনতায় বিষণ্ণতা ভুলতে আমি ফিরে আসি টম্যাটোর কাছে-
ছেলেটি  মেধাবী ছিল, কলেজের  শেষ  পরীক্ষার পরেও 
চাকরি  হলো  না কোথাও- রাজনীতির  সঠিক টুপিটা পরতে পারেনি মাথায়;
আমাকে দেখলে এড়িয়ে  যায়,সবদিন বাড়িও ফেরে রাতে-
সন্তানের  অপেক্ষায় গর্ভধারিণী  মা কে সান্ত্বনা দিতে
সকাল  হলেই আমি থলি হাতে  বাজারে  যাই টম্যাটোর সন্ধানে। 


সে দিন বড়ো  বাবু ভি.আর. এস এর চিঠিটা ধরিয়ে দিয়ে  বললেন, 
'দাশ, তেমন কিছু  ভাবনার নেই।চাকরির  বাকি সময়ের  মাইনে আর পেনশন 
এখন  থেকে বাড়িতে বসে বসেই পাবেন সরকারি  বদান্যতায়',

অফিসে  রোজ আসবার দরকার  হবে না আর।'ছুটি হলো, তবু  আনন্দ নেই।
অসময়ে বাড়ি ফিরলে পাড়াপড়শিরা ভাবনায় পড়তে পারে ভেবে
আমি মাঝ পথে বড় বাজারে নেমে পড়ি বাস থেকে,আর
তারপরে সারা দুপুর মরশুমি  টম্যাটোর খবর  নিতে সময় কাটাই। 


অবশ্য  বড়োবাবুর কথা সত্য হয়নি, বছর  ঘুরে গেলেও পেনশন  আসেনি;
আমার অলীক সি আর ফাইলের  সন্ধানে এখন  রোজ আমাকে
হাঁটাহাঁটি  করতে হয় ট্রেজারি অফিস,এজি বেঙ্গল, মহাকরণ- কোথাও
কথা বলার সময় নেই কারোর, আজকাল সারা বছর  ধরেই 
ক্রিকেট  চলতে থাকে বিশ্বজুড়ে- ট্রানজিস্টার  কানে
শচীন, সৌরভের সেঞ্চুরি  নিয়ে ব্যস্ত  থাকে অফিসের সবাই। 


আমার হাতে এখন  অফুরন্ত  সময়,আমি ভাবতে  থাকি শিয়ালদার 
কোলে মার্কেট  থেকে পাইকারি  দরে টুকটুকে  লাল টম্যাটো   এনে
ইউনিয়নের  সবার টেবিলে একটা করে টম্যাটো রেখে এলে কেমন হয়?
তাহলে হয়তো  আমার মতো দীর্ঘমেয়াদী হারিয়ে যাওয়া অন্য সকলের 
স্বপ্নের  সেইসব  অদৃশ্য  ফাইলের  সন্ধান সুনিশ্চিত  পাওয়া  যেতে পারে!


অথবা  বিকল্প হিসেবে এমনও হতে পারে টেবিলে  রাখা প্রতিটি 
সুপক্ব  টম্যাটো  থেকে মহাভারতের  নারায়ণী অক্ষৌহিণী  সৈন্যের  মতো 
বেরিয়ে আসতে পারে তৃতীয় পাণ্ডবকে বিস্মিত  করে অসংখ্য  লাল সেলাম।



২.
শিক্ষক 
দীপ মুখোপাধ্যায় 

খেয়েছি অনেক চড় - থাপ্পড় পড়া না পারলে পরে
এঁকেছি যখন  হিজিবিজি ছবি বই খাতা - পত্তরে।
এতো পড়াশোনা তবুও  কেন যে পিছিয়ে  সবার চেয়ে?
আকাশ রাঙানো  রামধনু  দেখি কম নম্বর পেয়ে।
কি আর করবো ভোঁদা মাথা নিয়ে ঘাড় নিচু মুখ কালো-
মন প্রাণ দিয়ে তবু  শিক্ষক ঢেলেছে জ্ঞানের আলো। 
বলেছেন, তোর হাতের লেখাটা কেন রে বাঁধন ছাড়া
এক্ষুনি তুই কান দুটো  ধরে লাস্ট বেঞ্চিতে  দাঁড়া।
সব বিষয়ের সাজেশন  দেব নোট  দেব তোকে  ছেলে,
দেখবি সবাই  খুশি হয়ে যাবে বেশি নম্বর পেলে।
তাই বেশি কিছু শেখান না ক্লাসে ব্যবসায়ী  ক্রমে ক্রমে -
বলেন, আসিস আমার স্পেশাল  টিউটোরিয়াল  হোমে
শিক্ষক মানে  প্রণম্য লোক এই তথ্যটা মানি,
প্রশ্নটা শুধু  কেন ধান্দার প্রাইভেট টিউশানি?




৩.
আজি এ-প্রণামখানি রাখি
তৈমুর খান

দু-একটা সূর্যমুখী ফোটে
 এই অনন্ত বাগানে কালে কালে;
 আমরা তাঁদের মুখ দেখি, আমরা তাঁদের ভাষা পাই
 আমরাও সেই আলোকে নতুন সূর্যমুখী হতে চাই।

 হাত রাখো শিরে, আশীর্বাদ দাও
 এই অন্ধকারের বিষাদে হেসে উঠুক জ্যোতির্ময়।
 অর্থ-যশ-খ্যাতির ঊর্ধ্বে তুমি প্রজ্ঞার বিস্ময়
 মানবমুক্তির অগ্রদূত; নিষ্ঠা ফিরুক তোমার দীক্ষায়।

 এখনো বিশ্বাস আছে; এখনো স্নেহের সবুজ সমারোহ
 আমাদের আরোগ্য রচনা; আমাদের প্রেমের পরাগ;
 সম্পর্ক এবং সভ্যতার ইতিহাস লিখে চলে মহাকাল;
 এখনো নোয়াই মাথা স্মরণে মননে তোমার ছায়ায়।






৪.

আমার শিক্ষক
গৌতম হাজরা

আমার স্বপ্নের দৃশ্যমাঠ জুড়ে
যারা দাঁড়িয়ে আছেন
তারা আর কেউ নন
আমার শিক্ষক।

আমার জীবনে আলো ফেলে ফেলে
যারা পথ দেখিয়েছেন
তারা আর কেউ নন
আমার শিক্ষক।

প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে আজও
যারা সামনে দাঁড়ান
সকল জ্ঞানের আভা ছড়িয়ে
তারা আর কেউ নন
আমার শিক্ষক

আমার মা -বাবা।





৫.
শিক্ষক দিবস এবং প্রশ্ন চিহ্ন 
সাতকর্ণী ঘোষ

তুমি ছাত্র তুমি নিশ্চিত বুঝবে
শিক্ষক তোমার গুরুজন
তোমার অধ‍্যায়ণকালে তুমি শিষ্য 
শিক্ষানবীশ তবে এতো হইচই কেন?
আকাশ গাঢ় করে কেন বিদ‍্যুৎ হানে
শিক্ষক যদি রাধাকৃষ্ণণ হয়
আপনি কে? ছাত্র প্রশ্ন করো
অর্থ কোনো শিক্ষক তৈরি করে না 
শিক্ষকই অর্থবহ হয়ে দাঁড়ান
বটবৃক্ষের মতো ছাত্রদের ছায়া দেন
তবে কেন এই আঁধার দেখি
চারদিক ছাত্র - শিক্ষক সম্পর্ক বিরূপ দেখি
একান্নবর্তীর মতো এই শিক্ষাবর্তীও কি 
তবে ভেঙে খণ্ড খণ্ড হচ্ছে 
কোন্ নীতি এমন দিশেহারা করছে আমাদের 
যোগ্য ছাত্রের কাছে অযোগ্য শিক্ষক এসে দাঁড়াচ্ছেন
কিংবা ঠিক তার বিপরীত কিছু 
আজ স্মরণ করছি যাঁকে তিনি এমন নন
তিনি এগোলে ছাত্রগণ এগিয়ে যায়
তিনি দাঁড়ালে ছাত্রের মাথা নত হয় 
তিনি রাধাকৃষ্ণণ --- আমরা স্মরণ করি
বরণ করি আজও শ্রদ্ধায় নত হই
এমনই হোক সম্পর্ক -- ছাত্র পথ ছাড়ো
শিক্ষক আসছেন -----
শিক্ষক ইতিহাস হোক  ছাত্ররাও তাই 
বিনম্র সম্পর্ক হোক দুজনের






৬.
 ছুটির ঘণ্টা বাজে স্কুলে 
   বিকাশ ভট্টাচার্য 

একটা ঋজু প্রশস্ত ছায়ার নিচে দাঁড়িয়ে 
আমার শৈশব 
একপাশে মাটকড়াইয়ের ক্ষেত।
ঝাঁঝা রোদ্দুর একটা সবুজ উপত্যকার মতো মাঠ
ধীরে ধীরে জেগে উঠছে বোধের ভেতরে 
আসলে এটাই সেই ভুবনডাঙা 
আমার হৃদয়পুর 

চারপাশ ঘিরে আছে তাল-তমালের সুপারি-নারকেলের 
 নীল বনরাজি  যেন কত কৌন্তেয় শিশু, লব কুশ 
অগ্নিজা জনকদুহিতারা 
খেলা করে। সরব স্ত্রোত্রপাঠে ডুবে যায় 
ছায়া ফেলে হেঁটে যান বিশ্বামিত্র বশিষ্ঠ দ্রোণ...

আমার সম্বিত ফেরে

একটা ঋজু প্রশস্ত বৃক্ষছায়ার নিচে
আমি অপেক্ষারত
আমার দাদুভাইটি এখুনি এসে পড়ল ব'লে

ছুটির ঘণ্টা বাজে স্কুলে 






৭.
মা
সুস্মেলী দত্ত

গেল শৈশব গেল কৈশোর যৌবন গেল চলে
প্রৌঢ় বিকেলে যতবার ভাবি তুমি যেন জ্বলজ্বলে

সেদিনের কথা সেদিনের শোনা পাল্টে উল্টে যুগ
ভাবলে আকাশ ভারি হয়ে যায় ততোধিক খাঁ খাঁ বুক

কত কী বলেছো কিছুই শুনিনি কত কথা আছে বাকি
শুনতে চাইনি... বাইরে ভিতরে বিস্তর ফাঁক ফাঁকি-

এখন বুঝেছি ভুলের মাশুল গুনতে গুনতে আজ
মহাকাশ ছুঁল আমি একা একা বোকাদের মন্তাজ

তবু সার জানি যাপিত জীবনে তুমি ই আমার গুরু
মায়ের শিক্ষা শাসন আদরে তুমি শেষ তুমি শুরু। 




৮.
 রামকৃষ্ণ 
অমিত কাশ‍্যপ

স্পষ্ট মনে পড়ছে, ওই বশির মিয়ার ঘর
একটু এগিয়ে কাশেম চাচা
উন্নয়ন খুলে দাঁড়িয়ে আছে  মুকুন্দপুর
সেই গ্রাম এখন শহরতলি

সভ‍্যতা কেমন ছুঁয়ে দিয়েছে 
যোগাযোগ আর আগে মতো নেই 
বিন্দুবাসিনী শিশু বিদ‍্যালয় থেকে উচ্চ বিদ‍্যালয়
সনাতন হাঁসদা শিক্ষক থেকে প্রধান শিক্ষক 

এখনো তাঁর ভাঙা সাইকেল আর লাঠির ছাতা
বহুদিন পর ফিরছে গ্রামে রামকৃষ্ণ মাহাতো
স‍্যার বলে প্রণাম করে দাঁড়ায়
মোটা ফ্রেমের চশমা মুছে বলেন, রামকৃষ্ণ না






৯.
আমার শিক্ষক অজিত বাবু 
অঞ্জন ভট্টাচার্য

প্রথম যেদিন গেলাম স্কুলে
আদর করে কোলে তুলে
নিলেন আমায় যিনি,
আজও কয়েক দশক পরে
তাঁকে যে খুব মনে পড়ে
তাঁর কাছে তে ঋণী।
স্কুলের সীমানা পার করে
কলেজে আমি, কান ধরে
তখনও তাঁর শাসন!
দু’চোখে আঁধার ভবিষ্যৎ
তিনি দেখালেন সঠিক পথ,
বুকে তে তাঁর আসন।
হতে হতে ঘোর সংসারী
চুল উঠে যায় পাকে দাড়ি
জীবন যুদ্ধে কাবু!
এখনো কাছে ডেকে নেন
ঘুরে দাঁড়ানোর শিক্ষা দেন,
প্রণাম অজিত বাবু।





১০.
প্রতিশ্রুতির মায়ায় বাঁধা 
নাসির আহমেদ 

কত বসন্ত কত গ্রীষ্ম 
কত চৈত্ররাত
হুহু বাতাস ছুঁয়ে গিয়েছে আমার চুল 
কত বর্ষ-নববর্ষে আশার দোলা দুলিয়ে গেছে 
নিরন্তর আশাভঙ্গে 
ছিঁড়েছে মর্মমূল।

তবু আশার সবুজ কুঁড়ি অঙ্কুরিত হবেই জানি
না হলে হয় কিভাবে সুখ- স্বপ্নগাথা এত দুঃখে!
একজনমে বীজ বুনতে বুনতে ক্ষয় বয়স-জমি
কিছু ফুলের কিছু ফলের 
গাছ লাগিয়ে দিন ফুরালো।

ফুল ফোটেনি ফল ধরেনি
তবু আশার বাগান গড়া
জীবন বুঝি এইরকমই আশার চাকা টেনে যাওয়া অন্ধপথে;
বিমূর্ত রাত সাগরতীরে জোছনা-ঢেউ, কাঁপছে বুক শূন্যহাত তবু বাড়াই তৃষ্ণাপোড়া নোনাজলে।

চৈতিরাত পেরিয়ে যায়,
 যাও বর্ষ,নাও বিদায় 
নোনাজলের আগুন জিভে, সাগর দেখা হয় না আর
ঝাউবনের এই সাগর তীরে এসেছিলাম যাচ্ছি ফিরে
তবু আশার সবুজলতা 
আমাকে ঘিরে উঠবে বেড়ে।

কথা দিয়েও কথা রাখে না জেনেও তবু স্বপ্ন-দেখা প্রতিশ্রুতির মায়ায় বাঁধা 
জীবন বুঝি এমনই হয়।








১১.

আমার শিক্ষক 
পাপড়ি ভট্টাচার্য

এক একজন শিক্ষক এক একটা বৃক্ষ
প্রতিটি ছাত্রজীবন গড়ে ওঠে এই বৃক্ষ ছায়ায়
অন্কুর থেকে ফুলে ফলে মায়া মমতায়।
সমুদ্র পাড়ে লাইট হাউসের মত
অতন্দ্র প্রহরী না হলে,দূরবর্তী ভবিষ্যৎ অন্ধকার ।

আমার শিক্ষক এখন এক রূপকথা—
একদিন সুকোমল মনের দুয়ার খুলেছিল
তাঁর রূপকথার  নীতিশিক্ষায়,চিন্তার ধারাপাতে।

ধীরে ধীরে চারাগাছটি মহীরুহ হয়
নিঃশব্দ সূর্যের নানা আলোর অবগাহনে।



১২.

অতুলনীয় রাধাকৃষ্ণন
মঙ্গলপ্রসাদ মাইতি 
 

মুখচোরা আর ভীষণ লাজুক
বড়োই সরল ছেলে 
আর কিচ্ছু চায় না তো সে 
বইটা হাতে পেলে।

খেলাধুলোর দিকেই যখন 
সব শিশুরই মন 
এই শিশুটির সঙ্গী তখন 
বই সর্বক্ষণ।

বইয়ের পাতায় ডুবে থেকেই 
আনন্দ যে পান
জ্ঞানের অতল সমুদ্রতে  
হারিয়ে যেতে চান।   

সব পরীক্ষায় প্রথম তিনি-  
হলেন অধ্যাপক 
হলেন সেরা দার্শনিকও,  
বরেণ্য শিক্ষক।

সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিলেন 
দর্শনেরই আলো
যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে দিলেন 
মন্দ আর ভালো।

সবার প্রিয় এই মানুষটির 
ভারতবর্ষ ধাম
জ্ঞানের তাপস, শিক্ষাব্রতী
রাধাকৃষ্ণন নাম। 

 





১৩.
শিক্ষক দিবস
সুবীর ঘোষ  

আমাদের ছিল ইস্কুল বাড়ি
সামনে দাঁড়িয়ে কত সারি সারি
আকাশমণি বা সোনাঝুরি গাছ
বর্ষার জল গরমের আঁচ।

সামনের মাঠে কত কলরব
মাটির মায়ায় গূঢ় অনুভব
পাঁচ তারিখের সেপ্টেম্বর
প্রতীক্ষাতে থেকে একটি বছর।

গুরুকে প্রণামে অমৃতের সুখ
ছাত্রদলের উজ্জ্বল মুখ
নিজ হাতে গড়া কত উপহার
মায়াবন্ধনে স্মৃতি উপচার ।

হে গুরু, তোমার অসীম করুণা
তুমি না থাকলে শুরুই হত না
এই জীবনের পথে নামা ওঠা
সংসার-মাঝে ফুল হয়ে ফোটা।




১৪.
শিখেছি মেরুদন্ডের নির্মাণ 
   অশোককুমার লাটুয়া 

যে কৃষক মাটিতে বীজ ছড়িয়ে  বলেছিল — একমুঠো স্বপ্ন বুনে দিলাম। স্বপ্ন যখন শস্য ফলাবে সে শস্যই ভবিষ্যতের লক্ষ্মী। 
সেই কৃষক আমার প্রণম্য শিক্ষক। 
গায়ের থেকে ঝরে পড়া নোনতা প্রপাত 
গামছায় মুছে এককাপ চায়ে 
চুমুক দিতে দিতে 
যে রিক্সাওয়ালা বলেছিল — 
শ্রমই শরীরের দেবতা। 
সেই রিক্সাওয়ালা আমার শিক্ষক। 
যে গাছটির ডালপালা সব কেটে নিয়েছিল কেউ 
অথচ বসন্তে ফোটালো বুকে 
অজস্র ফুল 
সেই গাছটিই আমার প্রিয় শিক্ষক। 
" চাঁদের কপালে চাঁদ টিপ দিয়ে যা " — ছড়া শুনিয়েছিল 
মুগ্ধ চোখে যে রমনী 
সেই মা আমার প্রথম শিক্ষক। 
বাবা আমার সেই শিক্ষক 
যে কিনা আঙুল গুনিয়ে আমাকে শিখিয়েছিল হিসেব। 
গুরুমশাই বলেছিল পাঠশালায় — 
পৃথিবীটা গোল, ইতিহাস অতীতের কথা বলে, পাতারাই 
গাছের রান্নাঘর, কাজের সাথে কারণ থাকবেই ইত্যাদি ইত্যাদি 
তারাই আমার চোখের আলোর শিক্ষক। 
থেমে নেই সময়। বয়ে চলেছে নদী। 
নিরন্তর নির্বাচনে এরাও আমার শিক্ষক। 
প্রতিমুহূর্তে আমিই একলব্য, 
আমিই আরুণি এবং অর্জুন। 







১৫.

অবধূত আড়ালে আছেন
শুভঙ্কর দাস

জন্মগ্রহণের অনেক অনেক আগে একটা চাঁদের মতো দেখতে চিল উড়ে আসছে  
রৌদ্রে তার শরীরে সোনা ঝরে
ছায়ায় তার মনে জেগে ওঠে অরণ্য
মাটি স্পর্শ করা মতো একবারে মানুষের রূপ যেই পেল,অমনি একটা উষ্ণ জলের ক্ষুধার্ত  সিংহ আর একটা অফুরন্ত হীরের খনি ঢুকে যায় রক্তমাংসের ভেতর,যা কোনোদিন বের করতে পারেনি
সিংহকে মারলেই সেই নখ দিয়ে চিরে দেয়,এমনভাবে মৃত্যুও সেই দাগ মুছতে পারে না!
খনিকে অবহেলা করলেই তা অমোঘ আকর্ষণ আকাশ ছেয়ে ফেলে,যার কোনো মাটি-মুখ নেই!

কে বসে আছে নৌকার হালে
আমি তো নিজেকেই চিনি না,বুঝি না, দেখিনি কখনো নিজের আসল মুখ,শুধু দৌড় দিই স্পর্শে স্পর্শে

অবধূত আছেন আড়ালে আড়ালে...   






১৬.
প্রকৃত শিক্ষক
অমিত গোলুই


যে মানুষটা আমাকে হাত ধরে
নৌকা ভাসানো শিখিয়েছিল - সে নয় । 
ব্যর্থতার দিনে যে আমার কাঁধে 
হাত রেখে বলেছিল, 
ভেঙে পড়ো না । এগিয়ে যাও ।  - সেও নয় । 

আমার প্রকৃত শিক্ষক হচ্ছেন তিনি -
মাঝ নদীতে ভাসা আমার নৌকাকে
যিনি ডুবিয়ে দিয়েছেন । 
সাফল্যের দিনে করেছেন চরম অপমান । 
যার ব্যবহারে দুঃখ পেলেও
মুখে কিছু না বলে
ভেতরে ভেতরে খোঁজার চেষ্টা করে
ঢেকে ফেলেছি আমার ব্যর্থতার ছিদ্রগুলো । 
যে সেদিন ছোট ছোট সাফল্যের বুকে
বাধার পেরেক হয়ে না বসলে
আজ এত বড়ো সাফল্য আমি কখনোই পেতাম না । 








১৭..
আমার শৈশবের শিক্ষকদের স্মৃতি
শঙ্কর তালুকদার

জীবনের চলা শুরুর পথে সে শৈশব পাড়ে- 
ফেলে আসা সেই মাটির কাছের জল ছবি;
আজ ও তা সজীব এই পৌরত্বের পথ ধরে-
সেই ভাবনার ই ছন্দ জুড়ে যেন এমন কবি!

পাঠশালায় ধুলো উড়িয়ে সেদিন শুরু পড়া
আজ ও সেই গাছতলাতেই যেন আছে মন-
ধূলার আসনে সেই চট বিছিয়েই ক্লাস করা
মহীরুহ সেই সহজ মানুষরা কোথায় এখন ?

সবুজের মাঝে হৃদয় ভরিয়ে ছিল তেমন পাঠ
যেন আলোর রেখায় আকাশ জুড়ে সেই ছবি;
পড়ার মাঝেই ইতিহাসের পাতা ও খেলার মাঠ-
মোর পাঠশালার গুরুমশায়দের সে কথা-ছবি
যেন জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই আজ ও জমাট
কলমের কালির ধারার মতই যে সব শব্দ পাঠ !
 
 সময়ের ছায়ায় ও পথের ধারায় তাঁরা কোথায়?
 নিয়ে চলার পথে ফেলে আসা সে ছেলেবেলায়
 আজও উজ্জ্বল ভাবনার ই মাঝে রয় যে লেখায়
 শিক্ষক দিবসে স্মৃতির ছবিটা থাক শ্রদ্ধা গাথায় !



১৮.

অনন্ত অন্বয়

রাখহরি পাল


মোটা ফ্রেমের বাইফোকালে আমরা যথারীতি

পিতার বয়স দ্বিগুন হলে পুত্র ধরি এক্স

নৌকা ছোটে স্রোতের যখন বিপ্রকর্ষ গতি

সময় মাপতে স্যারের আঙুল দূরন্ত এক্সপ্রেস।


সিঁড়ির পাশে সাত নম্বর, গণিত স্যারের ক্লাস

ভাঙতে ভাঙতে গড়তে শেখান সাঁতরে ওঠা নদী

উল্টোমুখী ট্রেনের ক্ষেত্রে লব্ধি বেগে প্লাস

বিয়োগ করি একই দিকে ছুটতে থাকি যদি।


আমরা ছুটি স্যারের সাথে দৌড়াতে দৌড়াতে

উন্নতি কোণ, ছায়ার দৈর্ঘ্যে পাহাড় মাপি ট্যানে

নৌকা ছোটে ট্রেনও ছোটে সমান্তরাল পথে

পাহাড় ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা রয় আলোর সন্ধানে।


আর্য ভারত গুরু শিষ্যের মধুর রসায়ন

গুরুগৃহে প্রদীপ জ্বেলে ভুল করেনি তা

সেই ধারাতে সঞ্চারিত আজো জ্ঞানাঞ্জন

প্রাচীন, মধ্য, কি আধূনিক হয় নি অন্যথা।







১৯.

আমার শিক্ষক 
 -স্বপন বিশ্বাস

এই যে চারায় ফুল ধরেছে,বাহারি তার পাতা
বলতে পারো মালিটা কে?উলটে দেখো খাতা।
কে ঢেলেছে জল যে গোড়ায় পরম মমতায়
নিড়িয়েছে নরম জমি ভরা আগাছায়?
কে দেখাল আলোর দিশা,মুক্ত আকাশ পানে
কে শেখাল ভরতে ভুবন আনন্দে আর গানে?
এই যে আছাড় খেয়ে উঠি আবার ধুলো ঝেড়ে
প্রতিবাদে তাঁর ভাষাটি নতুন হয়ে ফেরে।
যেতে যেতে হঠাৎ পথে থমকে থামি যদি
তাঁর কথাতে পার হয়ে যাই আজও কঠিন নদী।
মন্ত্র যাহার ধারণ করে নিত্য মোদের চলা
ব্যক্তি গড়া, সমাজ গড়া, দেশের কথা বলা,
শিক্ষাগুরু সবার তিনি---সেই সে দেবতারে
কৃতজ্ঞতায় স্মরণ করি,প্রণাম জানাই তাঁরে।






২০.

শিক্ষক দিবস
চিত্ত রঞ্জন সরকার

শিক্ষক দিবস ছাত্রদের কাছে,
বড় আদরের দিন;
ছাত্ররা সাদরে গ্রহণ করে
পথ চলার ঋণ।

যেমন মা ছাড়া হয়না সৃষ্টি,
এই আমাদের দেহ;
শিক্ষক ছাড়া সত্যের পথ,
পায় না তো কেহ।

জগতে সত্য পথের পথিক,
প্রকৃত শিক্ষকরাই হয়;
এই কঠিন জীবন পথে,
তাঁরাই পথ দেখায়।

অতীতের জ্ঞানী গুণী যারা,
এই ধরায় ছিল;
দুঃখ-কষ্ট সহ্য করে তাঁরা
নতুন জীবন দিলো।

এই সত্যকে নিয়ে সাথে,
যারা পথ চলে;
কভু আধাঁরে পায় না ভয়,
সে কথাই বলে।

আর কতকিছু শিখি মোরা,
প্রতিদিন শিক্ষকের কাছে;
মাতাপিতা প্রথম শিক্ষাগুরু,
থাকে মোদের পাশে।

মায়ের আঁচল ধরে সন্তানের,
শুরু পথ চলা;
জগতে মা ছাড়া সন্তানের,
নাই কিছু বলা।
তেমনই এই জীবন পথে,
শিক্ষকের বড় অবদান;
শুধু প্রকৃত ছাত্ররাই পারে,
রাখতে সেই মান।

ছাত্র-শিক্ষক মিলেমিশে,
যেন হরিহর আত্মা;
আপদে-বিপদে হয়ে ওঠে,
তারাই মানুষের ত্রেতা।

শিক্ষকের বিকল্প এ জগতে,
আর কিছু নাই;
প্রকৃত শিক্ষকই জগৎগুরু,
যেন মোরা খুঁজে পাই।







২১.

দ্বিতীয় ঈশ্বর
শুভ্রাশ্রী মাইতি

জন্মের ভেতর আর একটা জন্ম থাকে
যা আলোর,আকাশের,উত্তরণের।

জীবনের ভেতর আর একটা জীবন থাকে
যা জলের, সাগরের, উদারতার।
 
আশ্রয়ের ভেতর আর একটা আশ্রয় থাকে
যা ছায়ার, বৃক্ষের, নিমগ্নতার।

জন্মের ভেতর আকাশ,সমুদ্র আর বৃক্ষ হয়ে ওঠার অনন্ত সাধনায়
একটা জীবন আলোর প্রদীপ হয়ে মুছে দেয় মরণের অন্ধকার আবিলতা।
একটা হাত ধারালো অস্ত্র হয়ে কেটে দেয় ইন্দ্রিয়ের গোপন কুটিলতা।
একটা হৃদয় মলয় পবন হয়ে পারিজাত করে তোলে পঙ্কিলতা।

মরণের ভেতর শত সহস্র মরণকে দুপায়ে দলে
আমার দ্বিতীয় জন্ম হেঁটে চলে আনন্দ বরাভয়ে।
শিকড় থেকে শিকড়ে ছড়িয়ে পড়ে আশ্চর্য প্রাণরস,সত্তার অভ্যন্তরে।
মাটি থেকে ফুল,নদী থেকে আকাশ,বৃক্ষ থেকে বাতাস আর
প্রতিটি জীবনবোধের অণু -পরমাণুতে ব্যপ্ত এক পরম পদাবলী কথাকার
অন্তর আলোকে দেখলে তিনিই দ্বিতীয় ঈশ্বর,প্রথমের আশ্চর্য উপহার।


২২.

প্রতিটি নবজন্মের পরে
মোনালিসা পাহাড়ী

শিরায় শিরায় বয়ে যায় রক্ত
রক্তের ভেতর বয়ে যায় শিক্ষকের শিক্ষা
যে তরল টিকে থাকার কাঠিন্য জোগায়
প্রতিকূলতায়...
ঋজু রাখে মেরুদন্ড অসম যুদ্ধে, 
ভয়ের চোখে চোখ গেঁথে বাঁচতে শেখায়

হে আমার পরম শিক্ষক
আলো হয়ে আছো জীবনের গহন কুঠুরিতে
প্রতিটি ধ্বংসের মুখে জ্বালাও প্রদীপ
ফিরে আসি নিষ্ঠার বুকে, সত‍্যের সান্নিধ্যে, জ্ঞানের জগতে

তোমাকে কুর্ণিশ করি প্রতিবার
প্রতিটি নবজন্মের পরে
ভিতর অন্তরে...




২৩.

 পূর্ণতার উড়ান
দেবাশীষ মুখোপাধ্যায়  

আগুনটা বুকে জ্বেলে
পুড়িয়ে পবিত্র চারপাশ
লড়াইয়ের সলতেতে বাঁচুক
জীবনের অশেষ অভিলাষ।

ধ্রুবতারা বুকে পুঁতে
ছেলে চলে জীবনের পথ
কালো বোর্ডের শব্দরা শেখায় 
বাঁচার  মহান শপথ।

বীজ আজ মহীরুহ
মানুষের শান্তির নীড়
উপদেশ তাদেরই ছিল
সদা থাক উচ্চ তব শির।

পূর্ণতারই শিক্ষায় থাক
সাফল্যের অদম্য সফর
জীবন বানাও তুমি
মানবতার অমলিন আকর।

এগিয়ে চলার ছন্দ এখন
ছেলেটির বিশ্বাসী পায়
সকল শ্রদ্ধা আজ তাই
সেই মহামানবেরই দিকে ধায়।




২৪.

 স্মরণ
বৈদূর্য্য সরকার   


স্যার শব্দটা শুনলে, ব্ল্যাকবোর্ডে চক খসখস

গম্ভীর গলাখাঁকারি লিকলিকে বেত গোঁফ কালো ফ্রেম

তার পেছনে গভীর জ্বলজ্বলে চোখ...

প্রাইমারি স্কুলে সাদা ধুতি পরা স্যার বেশ মনে পড়ে

অতীত কুয়াশা ঘেরা সাদা স্কুলবাড়ি নইলে মানায় নাকি !

তারা গরীব মাষ্টার হয়ে জীবন শুরুর পর, টিকে

ছিলেন বুনো রমানাথের উত্তরাধিকারী হয়ে ।

হাইস্কুলে উঠে ঈষৎ মস্করা – অঙ্কের খেয়ালি স্যার

একবার চোখে দেখে জ্যামিতির ভুল দেগে দেন

জীবন বিজ্ঞানের জটিল সব টার্ম, কাব্য রস

ইতিহাসের কাহিনী, ইংরাজিতে গালমন্দ, ম্যাপ মুছে যায় ।

উচ্চতে দু’চার টানে কটু স্বাদ রসায়নে ফিজিক্স সমুদ্র

প্রাইভেট পড়া কোচিং সেন্টার পেরিয়ে কার টানে ভাসে তরী..

কে ভেড়াবে কুলে স্যার আপনারা ছাড়া !

কলেজে এসে বেয়াড়া, পাস ক্লাস কাটো, খোলা হাওয়া আস্কারা

দু’চারটে কোর্স পেরিয়ে আসার পরে স্বপ্ন দেখি

সেইসব ভয়ঙ্কর পরীক্ষা এবং উতরে যাওয়ার খিদে,

কিছু ডিগ্রি নিয়ে নানা ঘাটে জল খাওয়ার পর

অক্ষমতা বোঝানোর কোনও শিক্ষক পেলাম না এ জীবনে 

রিইউনিয়ানে গিয়ে আর কী করব, নিজে পড়াতে বসলে

হারিয়ে ফেলছি হাতে লেখা নোট মূল্যবান কথাদের !



২৫.

তিনি 'উত্তরসাধক'

তুলসীদাস   মাইতি


কে শেখে কে বা শেখায়!

নদী- পাহাড়- ঝর্ণা কিংবা চড়ুই পাখি,কাঠ ঠোকরার ঠোঁট-এসবই আমায় পড়িয়েছে রাত্রিদিন।

মাটি কতটা বৃষ্টি শুষে নিলে লাঙ্গল চলে মাঠে

কব্জিতে কত মাত্রার টানে প্রতিকূলেও নৌকো চলে এসব গণিত আমি শিখিনি। প্রকৃত জানার কাছে নত হওয়াও হয়নি শেখা।


অসুখের রাতে মায়ের হাত মাথায় থাকলে যন্ত্রনা 

কীভাবে কমে!

বাবার হাত ধরে মাইলের পর মাইল হেঁটে যেতে যেতে

ছেলে শিখে নেয় সংখ্যার হিসেব আর পথের বিবিধ বাঁকের গভীরতা।


সীমান্তে যুদ্ধ, আধপোড়া দেশে আধছাওয়া ঘরে ভয় পাহারা দেয়। তাজা তরুণ বাজি রেখে যায় তুচ্ছ জীবন- এ প্রেম শিখিয়েছে কারা? 

বইছুট বালিকারা বাঁশি শুনে নয়, কঠিন তর্জনীর ধমকে 

ছুটে যায় ঝকঝকে বাসনের স্তুপে। শূন্য থালায় দেখে নেয় ঘামে ভেজা মুখ!

এভাবেই বেঁচে থাকার স্রোত।


তবুও নদীর মতো পাঠশালা চলে। বয়ে যায় বিদ্যাধৌত জল। পাঠক্রমের সিঁড়ি বেয়ে সভ্যতা  উঠে  যায়।

শত শত বছর ধরে বর্ণপরিচয়ের গান শিখি, শিখি নব-ধারাপাত। 

এসবের অনেকটাই তো শেখান প্রকৃতি- সংসার মাতৃ-পিতৃ বৃক্ষের ছায়া। আর পাশে দাঁড়িয়ে আছেন আর একজন যিনি, তিনি  তো বাকিটা শেখান।

'উত্তরসাধক',শিক্ষক।



২৬.

আমার শিক্ষক 
অসীম বিশ্বাস

এক টুকরো রোদ্দুরের আশায় 
বৃষ্টি ভেজা ছেঁড়া ক্যাঁথা 
মেলে দেয় ভাই
মাটির দাওয়ায় 
বাঁশের মাচায়। 
তক্তপোশে মা একমনে    
চানাচুরের প্যাকেট বাঁধে,
বাবা জিরোয় ফেরি করে ফিরে।
দেখেই মনে হয় 
বৈভব নেই সুখ আছে সংসারে।
আশার জনালা ডিঙিয়ে 
একফালি রোদ আসে 
পড়ার ভাঙা টেবিলে। 
বসে বসে ভাবে কৃষ্ণা 
পড়তেই হবে কলেজে তাকে,
ভরসার প্রদীপ জ্বালিয়ে 
গেছেন হেড মাস্টার মশাই  
তাদের পর্ণকুটিরে। 
দিয়ে গেছেন একখানা শাড়ী, 
একটা ছাতা, কেজি পাঁচেক চাল,
নুন, তেল আর কিছু বই খাতা। 
আজ যেন তাই 
ঘুম ঘুম আসে তার
ফ্যান ভাতের সুবাসে।
 সে স্কুলের সেরা ছাত্রী 
এনেছে ৯৬ শতাংশ নম্বর। 
পড়তে পড়তে 
খিদেয় কত রাত 
কেটেছ চোখের জলে। 
নিঝুম রাতে দেখেছে চাঁদ 
সহস্র তারার সাথে। 
তাই  সে আজ 
করেছে  যে পণ-
করবে স্বপ্ন পূরণ 
পড়ে নক্ষত্র নিয়ে ।



২৭.
যাওয়া তো নয়   

জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়

দৃশ্যপটের রঙিন ছবি কে যে সাজায় কে যে ভাঙে
আমরা ভাবি সবকিছু ঠিক,বদল কোথায় যায় না দেখা
ঝড়-বাদলে মেঘলা দিনের ফাঁকে ফাঁকেই শিমুল রাঙে
হঠাৎ দেখি শীতের পরেই প্রবল বানের সফেদ রেখা।

কখন এসে ফাগুন বলে,আর দেরি নয় ভাগো ভাগো
শীতের বেলা শেষ হয়েছে আমার পালা পড়েছে ভাই
আচম্বিতে নতুন বছর ঘণ্টা বাজায় জাগো জাগো
নতুন নাটক শুরু হবে,মঞ্চ সাজাও সাজো সবাই।

মগ্ন ছিলেন বেখেয়ালে সময় গেছে কাজে কাজেই
কেমন করে পাখির ডানায় বিকেল আসে তলে তলে
আপন ভেবে জগৎটাকে দুঃখ পেলেন মাঝে মাঝেই?
সেইগুলি আজ মুক্তো হয়ে মানিক হয়ে দারুণ জ্বলে।

পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখা জীবন,আহা সাধের জীবন
তোমার জন্য আনন্দ আর দুঃখ ব্যথা বরফ আগুন
স্মৃতির পাহাড় সামনে দাঁড়ায় এখন বাহার তখন ইমন
স্মৃতি নিয়ে সমাজ সাজান সৃষ্টি সুখে আবার জাগুন।


২৮.

 আমার শিক্ষক 

তপনজ্যোতি মাজি 


অধ্যয়নকে সমিধ সংগ্রহ বলতেন আমার পিতামহ I 

বলতেন , জ্ঞানের আগুনে অন্তরের হোমাগ্নি জ্বেলে 

রেখো সারাজীবন I হোমাগ্নি  শুদ্ধ করে অন্তর্লোক , 

হোমাগ্নিতে বিসর্জিত হয় অহংকার আর মনের কোণে 

জমা অন্ধকার 

পিতামহ আমার শিক্ষক I 

গ্রামের বাড়িতে কাঠের আগুনে প্রজ্বলিত উনুনের পাশে 

মায়ের হাতে বোনা আসনে বসে ব্যস্ত মায়ের রান্নার ফাঁকে

ফাঁকে আমার শ্লেট পেন্সিল নিয়ে বর্ণ লিখন ও বর্ণ পাঠের 

শুরু I কলমের অক্ষর প্রবাহ আমাকে  নস্টালজিক করে 

নিভৃত সময়ে I 

মা আমার শিক্ষক I 

নদীসান্নিধ্যে কেটেছে ছেলেবেলা I নদীতীরে বসে বাবা গল্প 

বলতেন রামায়ণ,মহাভারত ,ইলিয়াড ও ওডিসির I কখনও 

উদাত্ত কণ্ঠে আবৃত্তি করতেন  রবীন্দ্র কবিতা কিংবা মেঘনাদ

বধ কাব্য I নদী ,কবিতা এবং বাবা , সুন্দরের সঙ্গে পথচলার 

সেই শুরু I 


নদী ও বাবা আমার শিক্ষক I


 প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে  বিশ্ববিদ্যালয়, দীর্ঘ  পথের দুদিকে 

 বোধিবৃক্ষের মতো দাঁড়িয়ে প্রণম্য শিক্ষকগণ I তাঁদের আলো 

 ছড়িয়ে  আছে  হৃদয়ে I বহুবর্ণ এই আলো  শিখিয়েছে জীবন 

 এক জ্যোতির্ময় যাপন I আমার বোধের শান্ত  আকাশে তাঁরা 

 এক একটি জ্যোতিস্ক I 


  এই জ্যোতিস্কগণ আমার শিক্ষক I 


মনোলোকে তাঁর অবস্থান I তাঁর  সঙ্গে  দেখা হয়নি আমার I

অথচ পান্থজনের সখা তিনি I আমারও I চিত্ত যেথা ভয় শূন্য 

উচ্চ  যেথা শির I অন্তর  মম বিকশিত করো , অন্তরতর হে 

 তিনিই তো শিখিয়েছেন না বলা বাণীর গভীরতা I তিনি জীবন 

 পথিক রবীন্দ্রনাথ I 


 রবীন্দ্রনাথ আমার শিক্ষক I 


এই জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জন তুমি I শিখিয়েছো অনন্য জীবন বোধ I 

চেতনার অসীমে যে উন্মেষ , সেখানে তোমার নীরব সঞ্চার I তুমি 

আমার জন্মভূমির মতো শ্রেষ্ঠ পরম্পরা I এই অক্ষর জীবন , এই 

সমানুভুতিবোধ তোমার অনিন্দিত দান Iএই  শ্রদ্ধা ভালোবাসার ও 

 নিবিড় অনুভবের I 


তুমি আমার শিক্ষক I 




২৯.

আমার শিক্ষক

বিমল মণ্ডল  



রোজ সকালে উঠলে  যিনি   
আমাকে সকালের সূর্য ওঠা থেকে বিকেলের সূর্য অস্ত দেখিয়ে বলতেন,
এই আমাদের জীবন, তবুও সামনে সমুদ্র -তা পেরিয়ে যেতে হবে 

সেই আমার শিক্ষক - যিনি পূর্ণিমার চাঁদ দেখিয়ে বলতেন, জীবনেও অমাবস্যা আসতে পারে!

সত্যিই তাই  সাফল্যের আগে 
আমার জীবনে অমাবস্যার অন্ধকার নামে
সে দিন ঘোর অন্ধকার অনুভব করেছিলাম
জীবন কেড়ে নেওয়া অমাবস্যাকে   

সেই আমার শিক্ষক -যিনি আমার সাফল্যের দিনে জড়িয়ে কেঁদেছিলেন

 আসলে আমার শৈশব,  কৈশোর ও যৌবনে 
অভাব হেঁটে ছিল যাঁর হাত ধরে

সেই আমার শিক্ষক-  যিনি আমার মা।  



৩০.
প্রণমি তোমায়
বিষ্ণুপদ জানা

আলবেলে বাতাস। সবুজ শ্বাস নিতে নিতে, কাদা মাটির পথ ধরে ; ঘাস পাতা দাঁতের কেটে পা দিতাম গ্রামের পাঠশালা

প্রশান্ত মুখশ্রী। মাথায় ঝাঁকড়া চুল। পরনে দেহাতি ধুতি ও পাঞ্জাবি। পায়ে নাগরা চটি চশমা চোখে - লোকটি

কি স্কুলে পড়বে !

আঁধারের আলো জ্বেলে কিশলয় বর্ণপরিচয়ের অ আ ক খ, জল পড়ে পাতা নড়ে, বনে থাকে বাঘ - আজও উচ্চারণ করে অন্তরে জন্মান্তরে

আজীবন ছাত্রদরদী পরোপকারী লোক-  পায়ে মাথা নত করি। সভ্যতার আলো দিগন্ত রঙিন । 
জ্ঞানের শূন্যতা মাঝে প্রণাম। 



৩১.

সমন্বয়
রঞ্জন ভট্টাচার্য 


স্মৃতির সরণি বেয়ে আসা উপলব্ধি 
শুধু আর ভাবায় আর ভাবায় !
কেমন ছিল ছাত্রাবস্থার  দিনগুলি 
শিক্ষক সমন্বয়ে ...
আজ কী দেখি অগোচরে সামাজিক
অবক্ষয়ে দিনগুলি ,
পথিকের পথ চলা শুরু শৈশবেই 
ঘটনাচক্রে বহু বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে হয় মহীরুহ 
তবে কী পথ ভুলে অন্য পথে 
সমন্বয়ের চাবিটা আজ ক্ষয়িত ।
বীণার ঝংকারে সৃষ্টসুখ আজ বেসুর 
এটাই কী পথ? 
পথিক কী পথভ্রষ্ট !
কে দেখাবে আসল কী বা নকল'ই বা কী!


 
          
           

      
    

  


 
            




















কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন